Tuesday 19th of March 2024
Home / uncategorized / উপকূলীয় অঞ্চলের লবণাক্ত পতিত জমিতে বিনা চাষের আলুর বাম্পার ফলন

উপকূলীয় অঞ্চলের লবণাক্ত পতিত জমিতে বিনা চাষের আলুর বাম্পার ফলন

Published at মার্চ ৩, ২০২১

ফকির শহিদুল ইসলাম (খুলনা) : দেশের সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে বিস্তীর্ণ এলাকা শুষ্ক মৌসুমে লবণাক্ততার কারনে বিপুল পরিমাণ কৃষি জমি পতিত থাকে। যে কারনে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের এসব কৃষি জমিতে বিভিন্ন ফসল ফলানোর জন্য খুলনার কয়রায় একাধিক ফসলের মাঠ পরিক্ষামূলকভাবে তৈরি করেছেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট সরেজমিন গবেষণা বিভাগ । তেমনি একটি ফসল বিনা চাষে আলু চাষ পদ্ধতির সফলতা পায়  কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট সরেজমিন গবেষণা বিভাগ  । সরেজমিন গবেষণা বিভাগের খুলনা প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. হারুনুর রশিদের নিকট থেকে স্থানীয় কৃষকরা বিনা চাষে আলু রোপনে উৎসাহিত হয়ে ইতিমধ্যে ব্যাপক সফলতা পেয়েছেন। ফলে এলাকার কৃষকদের মধ্যে বিনাচাষের আলু  উৎপাদনে আগ্রহ বেড়েছে। বিনা চাষে আলুর উৎপাদনে ধারাবাহিক তাদের সফলতায় স্থানীয় কৃষকের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে আলু চাষ। জানা যায়, ঘূর্ণিঝড় আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত কয়রা উপজেলার কয়রা সদর ইউনিয়নের তিন নম্বর কয়রা গ্রামের কয়েকজন কৃষক ২০২০ সালে বিনা চাষে আলু চাষ শুরু করেন। এ অভিনব চাষাবাদ দেখে এলাকার অনেক কৃষক সরেজমিন কৃষি গবেষণা বিভাগের পরামর্শক্রমে বিনা চাষে আলু আবাদে ঝুকে পড়েছেন।

খুলনা শহর থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরের সুন্দরবনসংলগ্ন উপকুলীয় কয়রা উপজেলা ।  উপজেলা সদর  থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দুরত্বে ৩নং কয়রা গ্রাম।  গ্রামের কয়েকজন কৃষক ২০২০ সালে বিনা চাষে আলু চাষ শুরু করেন। এ অভিনব চাষাবাদ দেখে এলাকার অনেক কৃষক সরেজমিন কৃষি গবেষণা বিভাগের পরামর্শক্রমে বিনা চাষে আলু আবাদে ঝুকে পড়েছেন। কৃষক আব্দুল হালিম জানান, বিগত বছর স্থানীয় কৃষকদের বিনা চাষে আলু উৎপাদন দেখে তার মধ্যে আগ্রহ জাগে। তিনি বর্ষাকাল শেষ হওয়ার পরই সরেজমিন গবেষণা বিভাগের সহযোগিতায় পানি সরে যাওয়ার পরই কাদার মধ্যে ৩৩ শতক জমিতে বিনা চাষে আলু রোপণ করেন। পরে আলুর ক্ষেতে খড়কুটা দিয়ে ঢেকে দেন। তার এই পদ্ধতি চাষ করা দেখে প্রতিবেশীরা তাকে ‘পাগল’ বলে অনেকেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে থাকেন। অথচ মহারাজপুর গ্রামের আব্দুল হালিমসহ আরও কয়েকজন চাষীর বিনা চাষে আলু চাষ করে লাভবান হওয়ায় অনেকের মুখে ছাই পড়েছে।

উপকূলীয় লবণাক্ত জমিতে আলুর ভালো ফলন দেখে কৃষি গবেষণা বিভাগ ও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, কম খরচে ও কম সার-পানি ব্যবহার করে বেশি ফসল পাওয়া যাবে। ওই বিভাগের এমএলটি সাইটের কয়রার দায়িত্বরত বৈজ্ঞানিক সহকারী জাহিদ হাসানই এলাকায় পতিত জমি দেখে বিনা চাষে আলু রোপণ করতে উদ্বুদ্ধ করেন কৃষককে। প্রথমে কেউ রাজি না হলেও পরে রাজি হয়ে ঝুঁকি নেন আব্দুল হালিম। ৩৩ শতক জমিতে রোপণ করেন ২২০ কেজি আলুর বীজ।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল শাহাদাৎ বলেন, ধান কাটার পর জমি তখনো পুরোপুরি শুকায় না জমিতে কাদা থাকে। সেই কাদা মাটির ওপর দড়ি টানিয়ে সারি সোজা করে আলুর বীজ বসিয়ে দিতে হয়। আলুর ওপর গোবর ছড়িয়ে তার ওপর খড় দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। কৃষক আব্দুল হালিমের বিশ্বাস ছিল না বিনা চাষে গাছের গোড়ায় এত আলু হবে।
আব্দুল হালিম বিনা চাষের আলুর ক্ষেতের খড় সরিয়ে গাছ তুলে দুই হাত ভরে আলু দেখিয়ে বলেন, আলুর আকারও বেশ বড়। কয়েক দিন পর বাজারে বিক্রি করা যাবে। বিনা চাষে রোপণ করা ওই গোলআলুর সবুজ গাছের সঙ্গে এলাকার কৃষকের বিস্ময় আর আগামীর স্বপ্নও যেন ফুটে উঠেছে।

কৃষি গবেষণা কয়রার বৈজ্ঞানিক সহকারী জাহিদ হাসান বলেন, দক্ষিণাঞ্চলে আমন ধান কাটার পর মাটি শুকাতে অনেক বেশি সময় নেয়ায় সঠিক সময়ে আলু চাষ করা কঠিন হয়ে পড়ে। ধান কাটার পর জমি ফাঁকা হবার সঙ্গে সঙ্গেই বিনা চাষে আলু আবাদের সুযোগ ঘটে। এই পদ্ধতিতে আলুর আবাদ করলে আলু বেশি সুস্বাদু হয় এবং এর আকারও অনেক বড় হয়।

খুলনার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. হারুনর রশিদ বলেন, বাংলাদেশের উপকূলীয় দক্ষিণাঞ্চলে আমন ধান কাটার পর বিস্তীর্ণ জমি পতিত থাকে। মূল কারণ দীর্ঘ জীবনকাল সম্পন্ন আমন ধান, এঁটেল মাটি, স্বল্পমেয়াদী শীত এবং জমিতে ‘জো’ না আসা। এসব প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলা করার জন্য বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ধাবিত লবণ ও তাপ সহনশীল আলুর জাত বারি আলু-৭২, ৭৩, ও ৭৮ এ ধানের খড় ব্যবহার করে বিনা চাষে আলু উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন।তিনি বলেন, এ পদ্ধতিতে খরচ কম, চাষের প্রয়োজন নেই। মাটিতে লবণ উঠার আগেই বাড়তি একটা ফসল ঘরে তুলতে পারে। ওই পতিত জমিতে যদি এলাকার কৃষকরা বিনা চাষে আলু উৎপাদন কৌশল দেখে ও শিখে নিয়ে চর্চা করেন তবে তাঁরাও লাভবান হবেন। আর এভাবেই পরিবার ও দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় তাঁরাও অবদান রাখতে পারবেন বলে তিনি বিশ্বাস করেন। তিনি আরও বলেন, কয়রায় প্রথমবারের মতো বিনা চাষে আলু আবাদ করে সফলতা এসেছে। ধীরে ধীরে চাষাবাদ বাড়াতে পারলে স্থানীয় কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। এটি যেমন কৃষকের জন্য অনেক সাশ্রয়ী হবে, তেমনি অনেক পতিত জমিও চাষের আওতায় আসবে।

উল্লেখ,গত বছরের মার্চে কয়রার বিভিন্ন ফসলের গবেষণা মাঠ সরেজমিনে পরিদর্শন করেন অষ্ট্রেলিয়ার রিসার্স প্রোগ্রাম ম্যানেজার সিএসআইআরও ড. এরিক হার্টনার, পরিচালক ডাল গবেষণা কেন্দ্র মোঃ রইচ উদ্দীন চৌধুরী, সরেজমিন গবেষণা বিভাগ সিএসও ড. আক্কাজ আলী, চেয়ারম্যান এএরএস ড. আব্দুল হামিদ, সিএসও বারি ড. ইউছুপ আকন্দ, পিএসও বারি ড. ওমর আলী, পিএসও বারি খুলনা ড. হারুনুর রশিদ, এসএসও ড. ফারুক হোসেন, এসএসও ড. মোশররফ হোসেন, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ড. মোঃ তাজউদ্দীন। দেশী ও বিদেশী কৃষি বিজ্ঞানীরা  গবেষণামূলক ফসলের মাঠ পরিদর্শন করেন । এর মধ্যে কয়রা উপজেলার বেদকাশি, মহারাজপুর ও আমাদীতে মুগ ডালের মাঠ, ৩নং কয়রা গ্রামের একাধিক কৃষকের গম, বিটি বেগুন, টমেটো, রসুন, তরমুজ ও ঢেড়স ক্ষেত । মাঠ পরিদর্শন কালে দেশী ও বিদেশী কৃষি বিজ্ঞানীরা দেশের উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত জমিতে এ ধরনের ফসল উৎপাদন সম্ভব বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। সরেজমিনে উক্ত বিজ্ঞানীরা কৃষকের সাথে সরাসরি কথা বলেন এবং এসময় একাধিক কৃষক গবেষণা মূলক ফসলের উৎপাদন দেখে উৎসাহিত হয়েছেন এবং স্বতস্ফুতভার্বে ফসল করার আগ্রহ প্রকাশ করেন।

This post has already been read 2331 times!