Friday 26th of April 2024
Home / পরিবেশ ও জলবায়ু / সুন্দরবনে ডলফিন ও কুমিরের জীবনচক্র ব্যাহত হওয়ার আশংকা

সুন্দরবনে ডলফিন ও কুমিরের জীবনচক্র ব্যাহত হওয়ার আশংকা

Published at মে ১, ২০১৮

ফকির শহিদুল ইসলাম(খুলনা): সুন্দরবনের যে জল ছিল ইরাবতী ডলফিনের স্বচ্ছন্দ বিচরণস্থল, কয়লার রাসায়নিক, জ্বালানী তেল মিশে সেই জলই এখন হয়ে উঠেছে বিলুপ্ত প্রায় জলজ প্রাণীর কাল। বিশ্বে ইরাবতী ডলফিনের সবচেয়ে বড় বিচরণ ক্ষেত্র বিশ্বঐতিহ্য সুন্দরবনে ছড়িয়ে থাকা স্বাদু পানির নদীগুলো। আর এ কারণে সুন্দরবনের দক্ষিণ দিকের তিনটি এলাকাকে ২০১১ সালে এই ডলফিনের অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়। অথচ মানবসৃষ্ট একের পর এক বিপর্যয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিশ্বঐতিহ্য সুন্দরবনের জীব বৈচিত্র আজ হুমকির মধ্যে রয়েছে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং ডলফিন সংরক্ষণ নিয়ে গবেষণায় কাজ করা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সুন্দরবনের নদীগুলোতে কয়লাভর্তি কার্গো জাহাজ ডুবি ও ২০১৪ সালে তেলবাহী ট্যাংকার ডুবির দুর্ঘটনায় কারণে সবচে বেশি হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে বিশ্বের বিপন্ন প্রজাতীর ইরাবতী ডলফিন। শনিবার (১৪ এপ্রিল) রাতে মংলা বন্দরের পশুর চ্যানেলের সুন্দরবনের অভ্যন্তরের হারবাড়িয়া এলাকায় এমভি বিলাস নামে একটি কার্গো জাহাজ ৭৭৫ টন কয়লা নিয়ে ডুবে যায়। জাহাজটি ডুবে যাওয়ায় কয়লার রাসায়নিক পদার্থ পানির সাথে মিশ্রনের ফলে রাসায়নিক তেজশক্রিয়ায় ফলে মৎস্য সম্পদ, ডলফিন ও কুমিরের জীবনচক্র ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি সুন্দবনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র হুমকির মুখে পড়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ইরাবতী ডলফিনের বিচরণ ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত এলাকায় কয়লাভর্তি জাহাজডুবির দুই সপ্তাহ পার হলেও ডুবে যাওয়া কয়লা বোঝাই কার্গো জাহাটিকে পুরোপুরি উদ্ধারে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়ায় এ আশংকা প্রকাশ করা হয়। সুন্দরবনের অভ্যন্তরের হারবাড়িয়া এলাকায় ৭৭৫ টন কয়লা নিয়ে এমভি বিলাস নামে একটি কার্গো জাহাজটি ডুবে যায়। এ ঘটনার পর বন্দর কর্তৃপক্ষের হারবার বিভাগ জাহাজটি উদ্ধারে ১৫ দিনের সময় বেঁধে দেয়। বন্দর কর্তৃপক্ষের দেয়া সময় পার হলেও কয়লাভর্তি কার্গোজাহাজটি উদ্ধার করতে পারেনি এর সাথে সংশ্লিষ্টরা।

জাহাজ উদ্ধারের সাথে জড়িতরা জানান, ডুবে যাওয়া কার্গোজাহাটিতে তিনটি ফাটল খুঁজে পেয়েছেন ডুবুরিরদল। জাহাজ থেকে কয়লা তোলার সময় ডুবুরিরা এসব ফাটল খুঁজে পান বলে জানিয়েছেন তারা। উদ্ধারকারীরা আরো জানান, বর্তমানে কয়লা তোলার কাজ চলছে। দুই এক দিনের মধ্যে এ কাজ শেষ হবে। এরপর জাহাজটি উদ্ধারের জন্য কাজ শুরু করা হবে। এর জন্য আরো অন্তত ২০ দিন সময় লাগতে পারে। ডুবুরিরা জানান, এ ব্যাপারে বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিতভাবে অবহিত করে সময় চাওয়া হবে।

অপরদিকে, দীর্ঘমেয়াদী কয়লা পানিতে ভিজে থাকার কারণে এর ক্ষতিকারক পদার্থ ইতোমধ্যে পানিতে মিশে গেছে। এতে অঙ্কুরোদগম ক্ষতিগ্রস্থ হওয়াসহ মাছের শরীর থেকে মানুষের শরীরে প্রবেশের আশঙ্কা করছেন গবেষকরা। ডুবে যাওয়া লাইটার জাহাজ এমভি বিলাস’র মালিক ঢাকার ব্যবসায়ী মো. সোহেল অসুস্থ থাকায় তার পরিবর্তে জাহাজটি উদ্ধারের তদারকি চালাচ্ছেন বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি মো. বাহারুল ইসলাম বাহার।

কয়লা ও কার্গো উদ্ধারকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি নৌযান শ্রমিক নেতা মো. বাহারুল ইসলাম বাহার বলেন, সুন্দরবনে কয়লার জাহাজডুবির পর শনিবার পর্যন্ত ১৫ দিন পার হয়েছে। তবে এখন কয়লা উত্তোলনের কাজ চলছে। এরপর জাহাজ উত্তোলনে কাজ শুরু হবে। তিনি বলেন, এখনও অন্তত ২০ দিন সময় লাগবে পুরো কাজ শেষ হতে। তবে এর আগেই বন্দরের বেঁধে দেওয়া ১৫ দিন সময় শেষ হওয়ায় তারা উদ্ধারকাজে আরো ২০ দিন সময় চেয়ে মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে একটি লিখিত আবেদন প্রক্রিয়াধীন। পাম্পের সাহায্যে ডুবন্ত জাহাজ থেকে এখন মাটি পানি মিশ্রিত কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে। পরে ৪০০ টন ধারণ ক্ষমতার একটি বাল্কহেডে রাখা হচ্ছে মিশ্রণ কাজে। এ পর্যন্ত জাহাজে থাকা ৭৭৫ টন কয়লার দুই তৃতীয়াংশ উত্তোলন সম্ভব হবে। এরপর জাহাজ উদ্ধারের কাজ শুরু হবে। পুরো জাহাজটি টেনে তোলার চেষ্টা চালানো হবে। তা সম্ভব না হলে কেটে তোলা হবে। মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের হারবার মাস্টার কমান্ডার মো. ওয়ালিউল্লাহ বলেন, নিয়ম অনুযায়ী ডুবন্ত জাহাজটির কর্তৃপক্ষকে উদ্ধারের জন্য ১৫ দিন সময় বেঁধে দিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। সে সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। এখন সময় বৃদ্ধির আবেদন করলে তা বিবেচনা করা হবে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, এসব কয়লা পানিতে ভিজে থাকার কারণে ক্ষতিকারক পদার্থ পানিতে ইতোমধ্যে মিশে গেছে। কয়লার জাহাজটি যে স্থানে ডুবেছে সেখানে ইরাবতী ডলফিনের বিচরণ ক্ষেত্র। কুমিরের প্রজননেরও সময় এটা। ফলে কয়লার বিষাক্ত রাসায়নিকের কারণে ডলফিন ও কুমিরের জীবনচক্র ব্যাহত হতে পারে।

সুন্দরবন নিয়ে গবেষণাকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, মানবসৃষ্ট দুর্যোগ ঠেকাতে হবে। কয়লাসহ কার্গোডুবি প্রাকৃতিক নয়, মানবসৃষ্ট। এ ধরণের বিপদ সুন্দরবনের পিছু ছাড়ছে না। তিনি বলেন, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌযান চলাচলের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টরা শর্ত মানছেন না। শর্তগুলো পালন হচ্ছে কিনা, তা নিয়ে কর্তৃপক্ষেরও মনিটরিং নেই।

এদিকে, হাড়বাড়িয়ায় কয়লাসহ কার্গোডুবির ঘটনায় বৃহস্পতিবার (১৯ এপ্রিল) বিভাগীয় কর্মকর্তার কার্যালয়ে প্রাথমিক একটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তদন্ত কমিটি। তবে সেই প্রতিবেদনে সুন্দরবন ও এর আশপাশের পরিবেশ ও সুন্দরবনের জীববৈচিত্রের ওপর এর প্রভাব নিয়ে কিছু বলা হয়নি। কার্গো উদ্ধার হলে এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক মো. শাহিন কবির।

পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. মাহমুদুল হাসান বলেন, বনবিভাগের তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া গেলেও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ হয়নি। তবে কয়লার রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, তা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। ওই এলাকার পানি সংগ্রহ করা হয়েছে। কয়েক ধাপে সংগ্রহ করা ও পরীক্ষার মাধ্যমে পানির তারতম্য বের করার চেষ্টা চলছে।

This post has already been read 1907 times!