
নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের অর্থনীতিতে প্রাণিসম্পদ খাতের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, উৎপাদন থেকে বিপণন—সব প্রক্রিয়ায় প্রাণিসম্পদ খাতের নীরব অবদান এখন জাতীয় প্রবৃদ্ধির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। তবে এই উৎপাদন বজায় রাখা এবং নির্বিঘ্ন রাখতে পারাই বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বুধবার (২৬ নভেম্বর) সকালে রাজধানীর আগারগাঁওস্থ বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র,জাতীয় প্রাণিসম্পদ সপ্তাহ ২০২৫ -এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এক শুভেচ্ছা বার্তায় (ভিডিও) তিনি এ কথা বলেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বল্প পুঁজিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নারীর ক্ষমতায়ন, বাণিজ্যিক খামার ও সহায়ক শিল্প গড়ে তোলা, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনসহ সুস্থ, সবল ও মেধাবী জাতি গঠনে প্রাণিজ আমিষ যোগানে গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে প্রাণিসম্পদ খাত এখন প্রতিষ্ঠিত।
তিনি বলেন, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের বিভিন্ন উৎপাদনমুখী প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং বেসরকারি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের ফলে দেশে ডিম, দুধ ও মাংস উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে যা নাগরিকদের প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ করছে।
তিনি আরো বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, প্রাণিজাত খাদ্যের অপ্রতুলতা, এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স, প্রাণিজ উপজাত ব্যবহার, মানুষ ও প্রাণীর মধ্যে পরস্পর সংক্রমণযোগ্য রোগসমূহ দমন, ইমারজিং ও রিইমারজিং রোগ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বর্তমান সময়ে প্রাণিসম্পদ খাতের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী অন্তবর্তীকালীন সরকার এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। সপ্তাহ ব্যাপী এই উদ্যোগ সরকারের প্রচেষ্টাকে আরো বেগবান করবে। পাশাপাশি, গবাদিপশু পালনে নতুন নতুন প্রযুক্তি প্রান্তিক খামারীদের মাঝে নতুন উদ্যোক্তা তৈরী করবে, যা দেশের সর্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতারের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি বলেন, পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, দুধ, ডিম ও মাংসের দাম সামান্য বাড়লে নানান ধরণের কথা শোনা যায়, কিন্তু এসব উৎপাদনে জড়িত মানুষের গল্প খুব কমই সামনে আসে। তিনি বলেন, দুধের ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে আমদানি করতে হলে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়, অথচ প্রান্তিক চাষি ও খামারিদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহের মাধ্যমে সেই নির্ভরতা কমানো সম্ভব।
খামারের খাদ্য ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে উপদেষ্টা বলেন, বড় খামারিগণ অনেক সময় পশুকে এমন খাদ্য দেন যা শুধু পশুর জন্য নয়, মানবস্বাস্থ্যের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ। প্রাণীরা মানুষের ভালোবাসা পায়, নিষ্ঠুরতা নয়—এটিই হওয়া উচিত মূল নীতি। তিনি আরও বলেন, জাতীয় পর্যায়ে এত বড় পরিসরে প্রাণিসম্পদ সপ্তাহ উদযাপন এবারই প্রথম। এর আগে প্রাণিসম্পদ সপ্তাহ পালিত হলেও তা জাতীয় স্তরে আয়োজন করা হয়নি।
দেশে উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও উৎপাদন বৃদ্ধির চিত্র তুলে ধরে পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, বর্তমানে নিবন্ধিত ৮৫ হাজার ২২৭টি বাণিজ্যিক খামার এবং প্রান্তিক পর্যায়ে প্রায় ১ লাখ ৯১ হাজার পোল্ট্রি খামার রয়েছে। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৬ কোটি ৬৮ লাখ ডিম উৎপাদিত হচ্ছে, যেখানে দেশীয় উদ্যোক্তাদের অবদান অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেছেন, প্রাণিদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করা যাবেনা। কোন প্রাণির নিষ্ঠুর আচরণ করলে তাদের শাস্তির মুখে পড়তে হবে। উপদেষ্টা বলেন, জাতীয় পর্যায়ে এতো বড় পরিসরে প্রাণিসম্পদ সপ্তাহ পালন এবারই প্রথম হচ্ছে। এর আগে প্রাণিসম্পদ সপ্তাহ পালিত হয়েছে তবে জাতীয় পর্যায়ে আয়োজন করা হয়নি। এ বছর প্রতিপাদ্য রাখা হয়েছে “দেশীয় জাত, আধুনিক প্রযুক্তি: প্রাণিসম্পদে হবে উন্নতি”।
উপদেষ্টা আরো বলেন, আমাদের গ্রামীণ জনগোষ্ঠী বিশেষ করে নারীরা তাদের পরিবারের সদস্যের মতোই যত্ন করে পালন করেন। এদের খাদ্যাভ্যাস স্থানীয় পরিবেশের সাথে খাপ খায়, রোগ বালাই অনেক কম হয়। এর উৎপাদনশীলতা কম হলেও, এদের উৎপাদন খরচও কম। এই জাতগুলো রক্ষা করা জরুরি কারণ এর সাথে গ্রামীণ মানুষের জীবিকাও সরাসরি জড়িত। দেশি জাত সংরক্ষণে গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের এই সময়ে দেশীয় জাতের গবাদিপশুর টিকে থাকার সম্ভাবনাই বেশি। মিথেন এমিশনের দিক থেকেও এগুলো কম নিঃসরণকারী। দেশীয় জাত রক্ষার বিষয়ে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কেন্দ্রে গবেষণা হচ্ছে।
তিনি বলেন, পবিত্র রমজান মাসে নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠীর কাছে স্বল্পমূল্যে প্রানিজ আমিষ সরবরাহ করা হয়। এই কর্মসুচিটি সমাজে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এ বছর (২০২৫) পবিত্র রমজান মাসে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে এবং খামারিদের সহযোগিতায় মোট ৪৯৫টি ভ্রাম্যমাণ বিক্রয় কেন্দ্রের মাধ্যমে দুধ, মাংস ও ডিম পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এই বিশেষ উদ্যোগের মাধ্যমে এ বছর ৯ লাখ ৬৮ হাজার জন ভোক্তার মাঝে মোট ৩১ কোটি ৭৩ লাখ ১২ হাজার টাকার সমমূল্যের প্রাণিজ পণ্য বিক্রয় করা হয়েছে। উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ খাতকে এগিয়ে নিতে আমাদের অগ্রাধিকার—নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও রেসিডিউ নিয়ন্ত্রণ, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ, জলবায়ু-সহনশীল খামার ব্যবস্থাপনা, স্থানীয় জাত সংরক্ষণ ও উন্নয়ন, এবং এলডিসি–গ্র্যাজুয়েশন–পরবর্তী বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার প্রস্তুতি।
তিনি বলেন, প্রাণিসম্পদের উন্নয়নে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিদের দেশীয় জাত পালনের সুবিধা এবং জলবায়ু সহনশীলতা সম্পর্কে প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি ও দেশীয় জাত পালনে খামারিদের প্রণোদোনা প্রদানে গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

