Tuesday 19th of March 2024
Home / ফসল / বীজ আলু সংরক্ষণে অনুসরন করতে হবে যে ৭টি ধাপ

বীজ আলু সংরক্ষণে অনুসরন করতে হবে যে ৭টি ধাপ

Published at মার্চ ৩, ২০২২

কৃষিবিদ মো. হামিদুল ইসলাম : খাদ্য হিসেবে আলুর ব্যবহার কম বেশি বিশ্বব্যাপী। কৃষিমন্ত্রণালয়ের এক রিপোর্ট অনুসারে, বাংলাদেশে শুধুমাত্র খাদ্য তালিকায় আলুর বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৭০ লাখ টনের বেশি। আর বীজ হিসেবে ব্যবহার হয় প্রায় ৭.০৮ লাখ টন। কিন্তু আমাদের হতাশের কারণ এই যে, শুধুমাত্র পরিকল্পিত সংরক্ষণের অভাব ও কারিগরি ত্রুটির কারণে উৎপাদিত আলুর ২০% নষ্ট হয়ে যায়। তাই বীজ আলু সংরক্ষণের জন্য নিম্নের ধাপগুলো অনুসরণ করতে হবেঃ

হাম পুলিং

রিজের উপর থেকে গাছ অপসারণ বা টেনে উপড়ে ফেলাই হলো হাম পুলিং। খাবার আলুর জন্য হাম পুলিং ততোটা জরুরী না হলেও, বীজ আলুর জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ। এতে আলুর ত্বক পুরু হয়, গাছের রোগ (ভাইরাস) আলুতে ছড়ায় না এবং হলোহার্টের মতো ফিজিওলজিক্যাল ডিজঅর্ডার সহজেই এড়ানো যায়। বীজ আলুর জন্য রীজের আর্দ্রতা বিবেচনায় আলু উঠানোর ১০-১২ দিন পূর্বে হাম পুলিং করতে হবে। হাম পুলিং করার সময় শিকড়ের টানে উঠে আসা আলু সাথে সাথে ঢেকে দিতে হবে। অনেক চাষীই ঢেকে দিতে দেরি করে কিংবা প্রখর রৌদ্রে বীজ আলু ফেলে রাখে। একই সময়ে বেশি হাম পুলিং করার কারণে আলু মাটির ভেতর ঢেকে দিতে অনেকটা দেরি হয়ে যায়। ফলে বীজ আলু হিট ইনজুরিতে পড়ে ক্ষতির সম্ভাবনা যথেষ্ট বেড়ে যায়।

কিউরিং

বীজ আলু হাম পুলিং করার পর রীজের মধ্যে ১০-১২ দিন রেখে কিউরিং করা হয়। তাছাড়া আলু উঠানোর পর অবস্থা বিবেচনায় ১-৪ দিন বাতাস চলাচল করে এমন শুকনো জায়গায় রেখে বীজ আলু পুনরায় কিউরিং করা হয়- যাতে উঠানোর সময় ত্বকের ক্ষত শুকিয়ে যায়।

শেড হাউজ

বীজ আলুর জন্য শেড হাউজ একটি অত্যন্ত মৌলিক ধাপ। কেননা- বীজ আলুর কোষে অধিক তাপমাত্রায় শ্বাসনিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। ফলে হলোহার্ট বা ব্লাকহার্টের মতো অপূরণীয় ক্ষতির প্রাথমিক ধাপ এখান থেকেই ঘটতে থাকে। বীজ আলু উঠানোর দুই একদিন আগেই শেড হাউজ রেডি রাখতে হবে।

কালেকশন/আলু উঠানো

মেঘলা দিনে বা বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকলে আলু উঠানো ঠিক নয়। তবে দ্রুত উঠিয়ে সরিয়ে নিতে পারলে- বীজ আলুর জন্য ভাল। জমি থেকে বীজ আলু সংগ্রহের জন্য সকাল বেলা অল্টারনেট রীজে লাঙল টেনে দেয়া যেতে পারে। লেবার দ্বারা লাঙল টেনে দিলে আলুতে কম ইনজুরি হয়। গরুর লাঙলে- গরুর পায়ের আঘাতে আলু থেঁতলে যায়। কোদাল বা মেশিনে উঠালে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন আলু কেটে না যায়। উঠানোর পর বীজ আলুর গায়ের পানি শুকিয়ে গেলে যত দ্রুত সম্ভব শেড হাউজে আনতে হবে। বস্তায় কিংবা অ্যালুমিনিয়াম ডিশে ভরে শেড হাউজে নিয়ে আসা ভালো। বাঁশের খাঁচা ব্যবহার করলে বীজ আলুর ত্বক নষ্ট হতে পারে। সেক্ষেত্রে কাপড় বা চট দিয়ে খাঁচাটি মুড়িয়ে বা সেলাই দিয়ে নেওয়া যেতে পারে।

গ্রেডিং

বীজ আলু গ্রেডিং করার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন পচা, ফাটা, কাটা, থেঁতলান, সবুজ, কাটুুই পোকার ক্ষত, রোগাক্রান্ত, স্ক্যাব দাগ, অনাকাঙ্ক্ষিত দাগ ও অস্বাভাবিক আকারের আলু কোনভাবেই বীজ আলুর মধ্যে চলে না যায়। সাধারণত কয়েকটি ধাপে বীজ আলু গ্রেডিং করা হয়- মিনি টিউবার, ব্রিডার-১, গ্রেড-এ (২৮-৪০ মিমি), গ্রেড-বি (৪১-৫৫ মিমি), আন্ডার সাইজ এবং ওভার সাইজ। প্লান্টলেট থেকে যে মিনি টিউবার চাষ করা হয়, তার পুরোটাই বীজ আলু হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। বীজ আলু হিসেবে ওভার সাইজ গ্রেড – অনেকাংশে অলাভজনক। তবে কেমিষ্ট এগ্রোবায়োটেক লিঃ নিজস্ব ল্যাবে কালচার করা প্লান্টলেট থেকে উন্নত মানের মিনি টিউবার কালটিভেট করে। তারপর নিজস্ব জমিতেই প্রাক-ভিত্তি, ভিত্তি ও প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদন করে এবং ভিত্তি ও প্রত্যায়িত বীজ আলু গ্রেড-এ, গ্রেড-বি, আন্ডার সাইজ- এই তিনটি গ্রেডে বাজারজাত করে থাকে । তাই কেমিষ্টের বীজ আলুর গ্রেডিং ও কোয়ালিটির প্রশ্নে চাষী নিশ্চিন্তে শতভাগ আস্তা রাখে।

পরিবহন

বীজ আলু পরিবহনেও অধিক সতর্ক থাকতে হবে। বস্তা করার পর যতদ্রুত সম্ভব হিমাগারে নিতে হবে। গাড়িতে উঠানো-নামানোর (লোড-আনলোড) সময় কোন অবস্থাতেই খালি গাড়িতে বা আনলোডিং পয়েন্টের মাটিতে সজোরে বস্তা ফেলা যাবে না। প্রয়োজনে দুজন লেবার বস্তা ধরে নিচের লেয়ার সাজাতে হবে।

হিমাগার ব্যবস্থাপনা

হিমাগার ব্যবস্থাপনা- হিমাগার কর্তৃপক্ষই করে থাকেন। তবে আমাদের সচেতন থাকতে হবে- সংশ্লিষ্ট হিমাগারে দক্ষ ফোরম্যান আছে কিনা। তারা ঠিকমতো গ্যাস ইন করেন কিনা, তাপমাত্রা (বীজ আলুর জন্য ৩.৩-৪.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস)  ঠিক রাখেন কিনা, আর্দ্রতা (৮০%-৯০%) চেক করে ব্যবস্থা নেন কিনা। অনেক হিমাগার ইনসুলেটিং করা থাকে না- সেগুলো টেবিল পটাটোর জন্য (তাপমাত্রা ১২.৭-১৫.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস)। তাই বীজ রাখার জন্য উপযুক্ত কিনা/ অতীতে এই হিমাগারের বীজ আলুর মান কেমন ছিল- সেদিকও বিবেচনায় আনতে হবে। হিমাগার কর্তৃপক্ষের সাথে চুক্তির সময়- প্রিকুলিং (১৬-১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ৪৮-৭২ ঘণ্টা) ও লট চেঞ্জের তারিখ/সর্বোচ্চ কতবার, লট চেকিং শিডিউল, কোন কারণে বস্তা ছিঁড়ে গেলে বা নিচের লেয়ারের কোন বস্তার বীজ আলু পচে গেলে- তাৎক্ষণিক কাস্টমারকে জানানো এবং সর্টিং এর ব্যবস্থা, প্রিহিটিং ব্যবস্থা, শেডিং সুবিধা, বীজ আলুর ক্ষেত্রে মার্কেটিং অবস্থা বিবেচনায় এনে সর্বোচ্চ দিন পর্যন্ত হিমাগারে রাখার শর্ত উল্লেখ থাকতে হবে।

এভাবে, প্রতিটি ধাপে উপর্যুপরি সচেতন থাকলে এবং হিমাগার কর্তৃপক্ষ ও হিমাগার পরিচালনা সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে মিউচুয়ালী রিলেশন ডেভেলপ করতে পারলে- বীজ আলুর সংরক্ষণ জনিত ব্যাপক ক্ষতির হাত থেকে সহজেই সুরক্ষা পাওয়া সম্ভব।

লেখক: এ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার (অপারেশন এন্ড এডমিনিস্ট্রেশন), কেমিষ্ট এগ্রোবায়োটেক লি.

This post has already been read 4756 times!