Thursday 28th of March 2024
Home / ফসল / আম বাগানের নিচের পতিত জমিতে হলুদ চাষ

আম বাগানের নিচের পতিত জমিতে হলুদ চাষ

Published at ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১৯

নওরীন ইসলাম তমা এবং মো. আকতারুল ইসলাম (ময়মনসিংহ): বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে কৃষি। এদেশের মাটি ও আবহাওয়া কৃষির জন্য খুবই উপযোগী। বাংলাদেশে মোট আবাদি জমির পরিমাণ প্রায় ২ কোটি ১ লাখ ৯৮ হাজার একর। প্রতি বছর জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে গ্রাম ও শহর সৃষ্টির ফলে আবাদি জমির পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় সীমিত ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার করে অধিক ফসল উৎপাদনের জন্য প্রতিকূল পরিবেশ সহিষ্ণু নতুন জাত এবং নতুন প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার এখন সময়ের দাবি।

আম বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফল। বিবিএস ২০১৪ এর তথ্য অনুসারে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাংশের প্রায় ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে আমের চাষাবাদ করা হয় এবং মোট উৎপাদন ৯.৫ লক্ষ মে. টন। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর ও নওগাঁ প্রধান আম উৎপাদনকারী জেলা। বর্তমানে আম উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে সপ্তম। সাধারণত দ্রুত বর্ধনশীল আমের জাত বা বড় আকৃতির গাছ হলে ১২ মিটার বা প্রায় ৪০ ফুট দূরত্বে একটি করে গাছ লাগাতে হয়। এই দূরত্বে গাছ লাগালে এক বিঘা জমিতে প্রায় ৯টি গাছ লাগানো যায়। মধ্যম আকৃতির গাছ হলে ১০ মিটার বা ৩৫ ফুট দূরত্বে একটি করে গাছ লাগানো যায় এবং দূরত্ব অনুযায়ী এক বিঘা জমিতে ১৩টি গাছ লাগানো যায়। খাটো আকৃতির জাত যেমন- বারি আম-৩ (আম্রপলি) হলে ৬-৮ মিটার দূরত্বে একটি করে গাছ লাগানো যায় এবং এ দূরত্ব অনুযায়ী এক বিঘা জমিতে প্রায় ২০-২৭টি গাছ লাগানো যায়। জাতভেদে আম গাছের রোপণ দূরত্ব ৬×৬ মিটার; ১০×১০ মিটার এবং ১২×১২ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে।

এ থেকে সহজেই অনুমেয় যে আম বাগানের নিচে অনেকটা জায়গা পতিত অবস্থায় থাকে। এছাড়া আম গাছ লাগানোর পর পরই ফল আসেনা। তাই বছরখানিক অপেক্ষা করতে হয় ফলন পেতে। ফলে এই পতিত জমি ব্যবহার করার মাধ্যমে কৃষকরা সহজেই তাদের আয়ের একটি নতুন পথ পেতে পারে। কিন্তু আম গাছের নিচে ছায়া থাকায় এসব স্থানে সব ধরনের ফসল চাষ করা সম্ভব হয়না। এক্ষেত্রে যেসব ফসল ছায়াযুক্ত স্থানে জন্মায় এমন ফসল চাষাবাদ করা যেতে পারে। এসব ছায়াযুক্ত স্থানে কৃষকরা আদা, হলুদ জাতীয় ফসল চাষাবাদ করতে পারে। মসলা হিসেবে হলুদ বাংলাদেশে খুবই জনপ্রিয়। মসলা ছাড়াও আচার অনুষ্ঠানে ও ওষুধি গুনাগুন হিসেবে হলুদের ব্যবহার ব্যাপক। বর্তমানে দেশে মোট চাহিদার তুলনায় হলুদের ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে হলুদের চাষাবাদ করা হয় এবং মোট উৎপাদন প্রায় ১ লক্ষ ৮০ হাজার টন।

হলুদের জাত নির্বাচন: উচ্চ ফলনশীল হলুদের জাত সমূহ চাষ করা ভাল। খারিফ-১ মৌসুমে বারি হলুদ-৪ ও বারি হলুদ-৫ রোপণ করা যেতে পারে।

উপযুক্ত পরিবেশ ও মাটি: সব ধরনের পরিবেশেই (উষ্ণ, অর্ধউষ্ণ ও আদ্র জলবায়ু) হলুদ চাষ করার জন্য উপযোগী। বার্ষিক ১০০ থেকে ২০০ সে.মি বৃষ্টিপাত হলুদ চাষের জন্য উপযোগী। সব ধরনের মাটিতে হলুদ চাষ করা যায়। তবে দো-আঁশ ও বেলে-দো-আঁশ মাটি হলুদ চাষের জন্য অতি উত্তম।

বপনের সময়: সাধারণত মধ্য এপ্রিল থেকে মে মাসের ১ম সপ্তাহ (বৈশাখের ১ থেকে ৩য় সপ্তাহ) হলুদ লাগানোর উপযুক্ত সময় । রোপণের ৯-১০ মাস পর ফসল উত্তোলন করা হয়।

সার ব্যবস্থাপনা: জমির উর্বরতার উপর সারের পরিমাণ নির্ভর করে। সাধারণত প্রতি হেক্টরে সারের পরিমাণ হলো :

   সারের নাম     মোট পরিমাণ (কেজি)    শেষ চাষের সময় প্রয়োগ (কেজি)                পরবর্তী পরিচর্যা হিসেবে প্রয়োগ
     ১ম কিস্তি      ২য় কিস্তি     ৩য় কিস্তি
      গোবর                ৫ টন                         সব             –              –             –
     ইউরিয়া                ৩০৪                           –          ১৫২           ৭৬          ৭৬
     টিএসপি               ২৬৭                         সব            –               –            –
    এমওপি              ২৩৩                        ১১৬             –            ৫৯           ৫৮
    জিপসাম              ১১০                         সব              –             –

ফসল সংগ্রহ: সাধারণত হলুদ লাগানোর ৯-১০ মাস পর পাতা শুকিয়ে গেলে হলুদ সংগ্রহ করা হয়।

হলুদ চাষের সুবিধা: হলুদ চাষের সুবিধা হচ্ছে শুধুমাত্র প্রথমবার হলুদ কিনে লাগাতে হয় এরপর থেকে নিজের জমির চাষকৃত হলুদ দিয়ে পরবর্তী আবাদ করতে পারে একজন কৃষক। ছায়াযুক্ত জায়গায় খুব সহজেই হলুদের চাষ হয়। তাই বিভিন্ন ফসলের সাথে আন্তঃফসল হিসেবে হলুদ চাষ করা যায়। এছাড়া অন্য ফসলের তুলনায় হলুদ চাষে সার, সেচ কম লাগে। চাষের জমি পরিচর্যা কম করতে হয়। অন্য একটি সুবিধা হচ্ছে হলুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশী তাই রোগবালাই কম হয়। এতে করে কীটনাশকও কম লাগে।

হলুদ চাষের অর্থনৈতিক গুরুত্ব: কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, এক বিঘা জমিতে মোটামুটি ৭০ হতে ১০০ মণ পর্যন্ত কাঁচা হলুদ উৎপাদন সম্ভব। কাঁচা হলুদ বর্তমানে ১৬শ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া গুড়া হলুদ কেজি প্রতি সাড়ে ৩ শত টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় দিন দিন চাষীরা নতুন উদ্দীপনায় হলুদ চাষে নামছেন। কিন্ত তাতেও হলুদের ঘাটতি দূর হচ্ছে না। তাই আম বাগানের নিচের জমি পতিত না রেখে আন্তঃফসল হিসেবে হলুদ চাষ করলে হলুদের ঘাটতি যেমন দূর হবে তেমনি অর্থনৈতিক ভাবেও স্বাবলম্বি হওয়া সহজ হবে। হলুদ চাষের ক্ষেত্রে মহিলারাও সহজেই অংশ নিতে পারবে। এতে করে একদিকে যেমন মহিলাদের স্বাবলম্বী হতে পারবে অন্য দিকে তারা পারিবারিক আয় বৃদ্ধিতে অংশ নিতে পারবে।

লেখক: নওরীন ইসলাম তমা, প্রভাষক, কৃষি অর্থনীতি বিভাগ, এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ এবং মো. আকতারুল ইসলাম, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বিনা, ময়মনসিংহ।

This post has already been read 4226 times!