
চট্টগ্রাম সংবাদদাতা: ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ এলএনজি আমদানির পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর দাবিতে চট্টগ্রামের কর্নফুলী নদীর তীরে যুব পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি আমদানির ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরতা দেশের অর্থনীতি, পরিবেশ ও জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠছে—এমন প্রেক্ষাপটে নতুন করে এলএনজি প্রকল্পে বরাদ্দ বন্ধ করে সৌর ও বায়ু বিদ্যুতে সমপরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের দাবি জানানো হয়।
আজ বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) কর্নফুলী নদীর পাড়ের ব্রিজঘাটা এলাকায় এ যুব পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। জেটনেটবিডির সহযোগিতায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আইএসডিই-বাংলাদেশ এই কর্মসূচির আয়োজন করে।
সমাবেশে বক্তারা বলেন, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রতি বছর প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকার জ্বালানি আমদানি করতে হচ্ছে, যার একটি বড় অংশ ব্যয় হচ্ছে এলএনজি আমদানিতে। গ্যাসের ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও গত চার বছরে সরকার ১১টি এলএনজি-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দিয়েছে। এর মধ্যে চারটি কেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং সাতটি এখনো নির্মাণ শুরুর অপেক্ষায় রয়েছে। অথচ পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত না হলে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র কার্যত অলস অবস্থায় পড়ে থাকার আশঙ্কা রয়েছে।
বক্তারা জানান, গ্যাসের ঘাটতি মোকাবিলায় সরকার ২০১৮ সাল থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি শুরু করে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দুটি বেসরকারি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়, যার সার্ভিস চার্জ বাবদ প্রতিদিন প্রায় সাড়ে চার লাখ ডলার পরিশোধ করতে হচ্ছে। বর্তমানে প্রতি ঘনমিটার এলএনজি আমদানিতে ব্যয় হচ্ছে ৭৯ দশমিক ৩৩ টাকা, অথচ বিদ্যুৎখাতে তা বিক্রি করা হচ্ছে মাত্র ১৪ দশমিক ৭৫ টাকায়। ফলে প্রতি ঘনমিটারে সরকারের লোকসান দাঁড়াচ্ছে ৬৪ দশমিক ৫৮ টাকা।
সমাবেশে আরও বলা হয়, এলএনজি সরবরাহ নিশ্চিত করা না গেলে নির্মাণাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো অলস বসে থাকবে, কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদন না হলেও সরকারকে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হবে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদেরকে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে ১৭ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে। অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই আর্থিক চাপও দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বক্তারা বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও মধ্যপ্রাচ্যের চলমান ভূরাজনৈতিক সংকটের কারণে এলএনজি ও পেট্রোলিয়াম জ্বালানির সরবরাহ দিন দিন আরও অনিশ্চিত হয়ে উঠছে। এ অবস্থায় নতুন এলএনজি টার্মিনাল ও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ দেশের অর্থনীতির জন্য দীর্ঘমেয়াদে বড় ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। পাশাপাশি প্রতি বছর প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার জ্বালানি আমদানির ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপরও তীব্র চাপ সৃষ্টি হচ্ছে।
তারা আরও বলেন, জ্বালানি আমদানি ও ক্যাপাসিটি চার্জের ক্রমবর্ধমান ব্যয় জাতীয় বাজেটকে সংকুচিত করে দিচ্ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও যোগাযোগের মতো অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাতে, যা সামগ্রিকভাবে জনকল্যাণ ও মানবসম্পদ উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
বক্তারা স্মরণ করিয়ে দেন, সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় মোখার সময় মহেশখালীর এলএনজি টার্মিনাল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় চট্টগ্রামসহ সারা দেশে টানা তিন দিন গ্যাস সরবরাহ বন্ধ ছিল। এতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ও শিল্পকারখানা মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। একদিকে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে, অন্যদিকে জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক এই ব্যবস্থা পরিবেশের ওপরও গুরুতর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
সমাবেশ থেকে বক্তারা অবিলম্বে এলএনজি আমদানি বাতিল করে সমপরিমাণ অর্থ সৌর ও বায়ুবিদ্যুৎসহ নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগের জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানান।
যুব পদযাত্রায় সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন ক্যাব কেন্দ্রীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন, সিআরসিডির নির্বাহী পরিচালক ও ক্যাব চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাধারণ সম্পাদক কাজী ইকবাল বাহার ছাবেরী, জেলা সামাজিক উদ্যোক্তা পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক মো. জানে আলম, আইএসডিই’র কর্মসূচি কর্মকর্তা রাইসুল ইসলাম, ইন্টার্ন মো. সাইমন ইসলাম, ক্যাব যুব গ্রুপ কর্ণফুলী উপজেলার সভাপতি মো. আরেফীন, যুগ্ম সম্পাদক ইমরান হোসেন তারা এবং ক্যাব যুব গ্রুপ চট্টগ্রাম মহানগরের সদস্য সিদরাতুল মুনতাহা প্রমুখ।



