
নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের তামাক কোম্পানিগুলো অর্থনীতিতে দশভাবে ক্ষতি করছে। সবমিলিয়ে বছরে প্রায় দেড় রাখ কোটি টাকার অর্থনৈতিক ক্ষতি করছে তামাক কোম্পানিগুলো। এসব ক্ষতির মধ্যে প্রকৃত কর ফাকি, শুভঙ্করের শুল্ক ফাকি, জনগনের বর্তমান স্বাস্থ্যে ব্যয়, নন কমিউনিকেবল ডিজিজ বৃদ্ধিতে স্বাস্থ্য খাতে ক্ষতি, তামাক চাষে কৃষকের মূল্য বঞ্চিত করা, রফতানির বিপরীতে শুল্ক মওকুফে ক্ষতি, বৈষম্য তৈরি ও দারিদ্র প্রবানতা বৃদ্ধির ক্ষতি, কোম্পানগিুলোর পারিচালন ব্যয়ে অচ্ছতায় ক্ষতি, অর্থনৈতিক সুযোগ ব্যয় এবং পরিবেশের ক্ষতি।
বুধবার (৫ নভেম্বর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরো (বিইআর) কনফারেন্স রুমে কোম্পানির আগ্রাসনে বাড়ছে তামাক চাষ, জনস্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তায় হুমকি শীর্ষক কর্মশালায় এসব তথ্য উঠে আসে। কর্মশালার আয়োজন করে ঢাবির অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরো, বাংলাদেশ কৃষি সাংবাদিক ফোরাম (বিএজেএফ) ও বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক ফর টোব্যাকো ট্যাক্স পলিসি (বিএনটিটিপি)। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিএজেএফ এর সাধারণ সম্পাদক আবু খালিদ ও মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিএনটিটিপির টেকনিক্যাল কমিটির সদস্য ও বিএজেএফের গবেষনা সম্পাদক সুশান্ত সিনহা।
মূল প্রবন্ধে সুশান্ত সিনহা বলেন, তামাক পাতা রপ্তানিতে ২৫% শুল্ক প্রত্যাহার তামাক চাষ বৃদ্ধির প্রধান অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে। তিনি তামাক পাতা রপ্তানি ও চাষ বৃদ্ধির উপাত্ত তুলেধরে বলেন, শুল্ক প্রত্যাহারের ফলে রপ্তানি বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে তামাক চাষ যা পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতিতে ভয়ানক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। আবার দেশের বৈষম্য ও দারিদ্র প্রবন জেলাগুলোতে তামাক চাষ বাড়ছে। ফলে তামাক চাষ এই অঞ্চলের বৈষম্য বাড়াচ্ছে। কোম্পানিগুলো সরকারকে শূল্ক ফাকি ও কর ফাকি দিতে সরকারের প্রভাবশালীদের নিয়োগ দিচ্ছে। এতে করে কোম্পানিগুলো আইন ও নীতি তাদের পক্ষে নিচ্ছে। যেখানে তামাক চাষ হচ্ছে সেখানকার মানুষ অপুষ্টিহীনতায় ভুগছে। এছাড়া তামাকের মূল্য নির্দারন কমিটিতে তামাক কোম্পানি প্রতিনিধিদের থাকার মাধ্যমে কৃষকদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন ও কর বৃদ্ধি ঠেকাতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে সরকারকে বিভ্রান্ত করছে তামাক কোম্পানি। একইসঙ্গে বহুজাতিক তামাক কোম্পানিগুলো মূল্য ও কর হার বৃদ্ধিকে নেতিবাচক হিসেবে তুলে ধরতে চোরাচালানের গল্প ও অকার্যকর প্রমাণ করতে রাজস্ব কম দেখানোর অপচেষ্টা করছে। তামাক কোম্পানিগুলো প্রাণঘাতী পণ্যের ব্যবসা করে বিপুল মুনাফা করে। তারা তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে মিথ্যা তথ্য ছড়ায়। সরকারের উচিৎ তাদের কথা আমলে না নিয়ে জনস্বার্থে অতিদ্রুত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালি করা এবং একটি টেকসই তামাক কর ব্যবস্থা গড়ে তুলতে একটি কমপ্রিহেন্সিভ তামাক কর নীতি প্রণয়ন করা।
বিএজেএফের সভাপতি সাহানোয়ার সাইদ শাহীন বলেন, তামাক কোম্পানিগুলো সাধারনত ১০ ভাবে দেড় লাখ কোটি টাকার অর্থনৈতিক ক্ষতি করছে। যে পরিমানে স্বাস্থ্য ক্ষতি হচ্ছে সে তুলনায় রাজস্ব আসছে অনেক কম। তামাক চাষের কারণে পরিবেশ ও স্বাস্থ্য ক্ষতি বৃদ্ধির পাশাপাশি রাজস্ব ফাঁকিও বাড়ছে। সবমিলিয়ে দেশে তামাক চাষের কারণে বছরে দেড় লাখ কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তামাক পাতার মূল্য নির্ধারনী কমিটিতে তামাক কোম্পানির প্রতিনিধিই বেশি। যারা তামাক কিনবে তারাই আবার তামাক পাতার দাম নির্ধারণ করে দিবে সেটা হতে পারে না। তাই তামাকের আগ্রসর রোধে তামাকের বিকল্প ফসল কৃষকের হাতে পৌছাতে হবে। তামাক রপ্তানিতে শুল্ক বাড়াতে হবে। তামাকের মূল্য নির্ধারণ কমিটিতে অধিক সংখ্যক কৃষক, কৃষি ভিত্তিক সংগঠন ও গবেষক প্রতিনিধি রাখতে হবে।
বিএনটিটিপির টেকনিক্যাল কমিটির সদস্য ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ক নীতি বিশ্লেষক অ্যাডভোকেট মাহবুবুল আলম তাহিন বলেন, সরকার খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে। কিন্তু তামাকজাত দ্রব্যের মূল্য ও কর হার বৃদ্ধির ক্ষেত্রে নানা ধরনের টালবাহানা করে। হাইকোর্টের এপিলেড ডিভিশনের আদেশে বলা হয়েছে তামাক চাষ কমাতে হবে এবং দেশে নতুন করে কোনো ধরনের তামাক কোম্পানি স্থাপনের অনুমতি দেয়া যাবে না। কিন্তু এ আদেশ অমান্য করা হচ্ছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে দেশে তামাক চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং নতুন করে নিকোটিন পাউচ উৎপাদনের জন্য বহুজাতিক একটি তামাক কোম্পানিকে অনুমতি দেয়া হয়েছে। যা হাইকোর্টের আদেশের পরিপন্থী। এই সিদ্ধান্ত জনস্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ পরিনতি নিয়ে আসবে। তিনি সরকারকে এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, একটা সিগারেটের দোকানে যে পরিমাণ ট্যাক্স দেয় তা আরো বাড়ানো দরকার। দেশে মাত্র তিনটা কোম্পানি তামাকজাত দ্রব্য সিগারেট নিয়ন্ত্রণ করে। চোরাচালানের কথা বলা হলেও আসলে কেউ ধরা পড়ে না। আসলে সরকারের প্রভাবশালী অংশ এটাকে মদদ দিচ্ছে। বহুজাতিক কোম্পানি সরকারকে বোঝাচ্ছে যে কর বাড়ানো যাবে না কিন্তু তারা কর দিচ্ছে নামমাত্র। সরকার নিকোটিন কারখান। করার অনুমোদন দিচ্ছে। সরকারের সকল আইন লঙ্ঘন করে এটা করা হচ্ছে। কেউ কিছু বলছে না। তামাক চাষ এখন পাহাড়ে হচ্ছে। সরকারের কৃষি বিভাগও কিছুই করছে না প্রকৃতপক্ষে। ফলে তামাক চাষ অঞ্চলে দরিদ্রতা বাড়ছে। অন্যদিকে কোটি কোটি টাকার মুনাফা করছে কোম্পানি।
সভাপতির বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বিএনটিটিপির টেকনিক্যাল কমিটির আহ্বায়ক ড. রুমানা হক বলেন, আমাদেরকে তামাক চাষ থেকে বের হয়ে আসার উপায় খুঁজতে হবে। এর প্রাথমিক পদক্ষেপই হলো দ্রুত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করা। এছাড়া দেশের কৃষকরা যাতে তামাক চাষ থেকে বের হয়ে অন্য ফসলের ন্যায্য মূল্য পায় সেটা নিয়েও সবাইকে একত্রে কাজ করতে হবে। একইসঙ্গে তামাক পাতা ও তামাকজাত দ্রব্য রপ্তানিতে ২৫ শতাংশ শুল্ক পুনর্বহাল করতে হবে। কারণ তামাক থেকে যে পরিমান রাজস্ব আয় হচ্ছে তার দ্বিগুণের বেশি তামাকজনিত রোগে স্বাস্থ্য ব্যয় হচ্ছে।
তিনি বলেন, কর না বাড়ানোর কারণে কোম্পানিগুলো অতিরিক্ত মুনাফা করছে। তামাক চাষিদের ফাঁকি দিয়ে একটা মুনাফা করার পাশাপাশি দেশের জনগণের পকেট কাটছে। ২২ হাজার কোটি টাকা কর দেয় সরকার আর আমাদের দেশের জনগনের ৩০ হাজার কোটি টাকার স্বাস্থ্য ক্ষতি হয়। আমরা যা দেখি আসলে তা নয়, প্রকৃতপক্ষে তামাক কোম্পানির দৌরাত্ম্য অনেক বেশি। সিগারেট চোরাইচালান আসলে তেমন হয় না বলেই মত। এ বিষয়ে সরকার আরো ভালোভাবে দেখবে এবং চোরাচালান বন্ধ করতে হবে। তবে এরকম অজুহাত দিয়ে কর বাড়ানো যাবে না এমনটি আসলে নয়। এমআরপি মূল্যের বেশি দামে কেন কিনবে জনগণ? অন্য জিনিসের দাম বেশি না দিলেও সিগারেটে বেশি দিতে হয়। এসব বিষয়ে সরকার গুরুত্ব দিবে আশা করি।

