
মো. খোরশেদ আলম জুয়েল: বিশ্বব্যাপী পশু খাদ্য উপাদান (Animal Feed Ingredients) বাজার দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। সম্প্রতি গ্লোব নিউজওয়্যারে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২৫ সালে এই বাজারের আকার দাঁড়াবে প্রায় ৪২.৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০৩৪ সালের মধ্যে বেড়ে পৌঁছাবে ৫৮.৭৯ বিলিয়ন ডলারে। প্রতিবেদনের তথ্যমতে, আগামী এক দশকে বাজারটি গড়ে বার্ষিক ৩.৬ শতাংশ হারে (CAGR) প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে।
বিশ্বজুড়ে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, নগরায়ন এবং প্রাণিজ প্রোটিনের প্রতি মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধির ফলে পশু খাদ্যের বাজারে ব্যাপক পরিবর্তন আসছে। পুষ্টিসমৃদ্ধ ও টেকসই খাদ্য উপাদানের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে, যা প্রাণিসম্পদ খাতকে আরও আধুনিক ও দক্ষ করে তুলছে। গ্লোব নিউজওয়্যারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে শস্য ও ধানজাত উপাদান বাজারে সবচেয়ে বড় অংশ দখল করেছে, যা ২০২৪ সালে মোট বাজারের প্রায় ৩৫ শতাংশ।
তবে আগামী বছরগুলোতে কার্যকরী খাদ্য উপাদান বা functional additives—যেমন প্রোবায়োটিক, প্রি-বায়োটিক, এনজাইম ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট—এর ব্যবহার দ্রুত বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই উপাদানগুলো প্রাণীর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা, বৃদ্ধি ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে কার্যকর ভূমিকা রাখছে।
প্রাণীর ধরনভেদে মুরগি বা পোলট্রি খাত এখনো বিশ্ব বাজারে শীর্ষে রয়েছে; ২০২৪ সনের রিপোর্ট অনুযায়ী খাতটি প্রায় ৪১ শতাংশ বাজার দখল করে আছে। পাশাপাশি, সামুদ্রিক মাছ ও জলচাষভিত্তিক প্রাণীর খাদ্য উপাদানের বাজারও দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। বিশেষত দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে জলচাষ খাতের দ্রুত বিকাশ এই প্রবণতাকে আরও ত্বরান্বিত করছে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, পশুখাদ্যে প্রোটিন সাপ্লিমেন্টের প্রাধান্য সবচেয়ে বেশি, যা ২০২৪ সনে বাজারের প্রায় ৭৮ শতাংশ অংশ দখল করে। প্রোটিনসমৃদ্ধ খাদ্য প্রাণীর স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য হওয়ায় খামারিদের মধ্যে এর ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। একই সময়ে শুকনো উপাদান (Dry ingredients) বাজারে প্রায় ৭৮ শতাংশ শেয়ার দখল করে রেখেছে, যদিও তরল উপাদানও জনপ্রিয়তা পাচ্ছে এর সহজ হজম ও দ্রুত শোষণের কারণে।
উৎসভেদে দেখা যায়, গত বছরের এক প্রতিবেদনে দেখা যায় এক্ষেত্রে উদ্ভিদ-ভিত্তিক কাঁচামাল বর্তমান বাজারের নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং মোট বাজারের প্রায় ৫৪ শতাংশ দখল করে আচে। পরিবেশবান্ধব উৎপাদন পদ্ধতি, কম খরচ এবং টেকসই সরবরাহের কারণে এই ধারা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি, কীটপোকা, শৈবাল, শিল্প বর্জ্য এবং বায়োটেকনোলজি-ভিত্তিক উপাদানকেও সম্ভাবনাময় বিকল্প হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ভৌগোলিকভাবে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল বাজারে সবচেয়ে বড় অংশীদার, যেখানে গত বছরের রিপোর্ট অনুযায়ী অঞ্চলটি মোট বাজারের প্রায় ৩৮ শতাংশ শেয়ার দখল করেছে। এই অঞ্চলে চীন, ভারত, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনাম—দেশগুলোতে পশুপালন ও জলচাষ খাতের দ্রুত বিকাশ বাজার বৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে। অন্যদিকে ল্যাটিন আমেরিকা আগামী দশকে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে বলে প্রতিবেদনে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, বিশেষত ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা এই অঞ্চলের নেতৃত্ব দেবে।
বাজারের সম্প্রসারণের পেছনে কাজ করছে একাধিক কারণ—বিশ্বজুড়ে প্রাণিজ খাদ্যের চাহিদা বৃদ্ধি, উন্নত পুষ্টির প্রতি সচেতনতা, টেকসই উৎপাদন ব্যবস্থা এবং পশুর স্বাস্থ্য রক্ষায় উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগ। তবে এই প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। বিকল্প খাদ্য উপাদানের মান নিয়ন্ত্রণ, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি এবং গবেষণাভিত্তিক প্রযুক্তি ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা অনেক দেশের জন্য বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
গ্লোব নিউজওয়্যারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাজারে সক্রিয় প্রধান কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে কারগিল (Cargill), এডিএম (ADM), ডিএসএম-ফিরমেনিচ (DSM-Firmenich), ইভোনিক (Evonik), নিউট্রেকো (Nutreco), অলটেক (Alltech), অ্যাডিসিও (Adisseo) এবং নোভাস ইন্টারন্যাশনাল (Novus International)। এ প্রতিষ্ঠানগুলো বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে প্রাণিসম্পদ খাতের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে।
সম্প্রতি কেমিন ইন্ডাস্ট্রিজ তাদের নতুন খাদ্য নিরাপত্তা সমাধান “Prosidium” বাজারে এনেছে, যা পশুখাদ্যে ক্ষতিকর প্যাথোজেন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, দেশের পোলট্রি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের ক্রমবর্ধমান বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে পশুখাদ্য উপাদানের চাহিদাও দ্রুত বাড়ছে। স্থানীয়ভাবে উপাদান উৎপাদন ও উদ্ভাবনী গবেষণার মাধ্যমে বাংলাদেশ এ খাতে আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে শক্তিশালী অবস্থান নিতে পারে। মাননিয়ন্ত্রণ, খাদ্য নিরাপত্তা ও গবেষণাভিত্তিক উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে দেশীয় পশুখাদ্য শিল্প আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সক্ষম হয়ে উঠবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
গ্লোব নিউজওয়্যারের বিশ্লেষণ ইঙ্গিত দিচ্ছে, বিশ্ব পশুখাদ্য উপাদান বাজার আগামী দশকে শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুযোগই নয়, বরং বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা ও প্রাণিস্বাস্থ্যের উন্নয়নে এক নিরব বিপ্লবের দিকনির্দেশনা বহন করছে।