মো. খোরশেদ আলম (জুয়েল): দেশের গুরুত্বপূর্ণ পোল্ট্রি, মৎস্য ও ডেইরি খাতের ফিড শিল্পকে সহায়তা দিতে এই সেক্টরে ব্যবহৃত খাদ্য উপকরণ আমদানির ওপর শুল্ক ছাড়ের সময়সীমা আরও পাঁচ বছর বাড়িয়েছে সরকার।
গত ২৯ মে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আবদুর রহিম খান, এনডিসি স্বাক্ষরিত জারি করা এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এস.আর.ও. নং-২০৩ আইন/২০২৫/২৫/কাস্টমস শিরোনামের এই প্রজ্ঞাপনটি আজ (২ জুন) থেকে কার্যকর হয়েছে এবং তা আগামী ৩০ জুন ২০৩০ সন পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। উক্ত প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ২০২০ সালের ৩ জুন জারি হওয়া পূর্ববর্তী প্রজ্ঞাপন এস.আর.ও. নং-১২৮-আইন/২০২০/৭৯/কাস্টমস বাতিল করা হয়েছে।
দেশের ফিড শিল্প বর্তমানে প্রায় এক কোটি মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ জীবিকার সঙ্গে জড়িত। স্থানীয়ভাবে ফিড উৎপাদনের বড় একটি অংশ আমদানিকৃত কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় শুল্ক ছাড়ের এই পদক্ষেপ শিল্পে উল্লেখযোগ্য স্বস্তি এনে দেবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
নতুন এই নির্দেশনায় পোল্ট্রি, মৎস্য ও ডেইরি ফিড প্রস্তুতিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন কাঁচামাল, খাদ্য উপযোগী রাসায়নিক উপাদান ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উপাদানের আমদানির ক্ষেত্রে কাস্টমস ডিউটি, মূল্য সংযোজন কর (মূসক), সম্পূরক শুল্ক এবং অগ্রিম আয়কর থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে অন্তর্ভুক্ত এইচ.এস. কোড অনুযায়ী অন্তত একশ’র বেশি উপকরণ এই সুবিধার আওতায় এসেছে। এসব উপাদানের মধ্যে রয়েছে সয়াবিন মিল, গুয়ার মিল, গমের ভূসি, রাইস ব্রান, মাছের গুঁড়ো (ফিশ মিল), ফিস ওয়েল (ফিড গ্রেড),এনিমেল ওয়েল (ফিড গ্রেড), প্রাকৃতিক নির্যাস, মিট অ্যান্ড বোন মিল (এমবিএম), প্রোবায়োটিক, অ্যামিনো অ্যাসিড, প্রিমিক্স, হরমোন, এনজাইম, ভেটেরিনারি ওষুধ, ভেজিটেবল ফ্যাট, ফিড গ্রেড এসিড, রঙ ও ঘ্রাণ উপাদানসহ আরও বহু গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল ও ফিড অ্যাডিটিভস। এসব উপাদান প্রাণিসম্পদ ও জলজসম্পদের নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য প্রস্তুত এবং উৎপাদনশীলতা বাড়াতে অপরিহার্য।
তবে এই শুল্ক ছাড় সব প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য নয়। আমদানিকারককে অবশ্যই প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কর্তৃক নিবন্ধিত অথবা তালিকাভুক্ত অথবা ক্যাটাগরি-১ বা ক্যাটাগরি-২ হিসাবে লাইসেন্সধারী অথবা পোল্ট্রি খামার অথবা গবাদি পশুর খামার অথবা মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক নিবন্ধিত অথবা তালিকাভুক্ত অথবা ক্যাটাগরি-১ বা ক্যাটাগরি-২ হিসাবে লাইসেন্সধারী অথবা মৎস্য বা চিংড়ি খামার অথবা মৎস্য বা চিংড়ি খামার হ্যাচারি অথবা ফিসিং ট্রলার অথবা মৎস্য প্রক্রিয়াজাত কারখানা, যেসব প্রতিষ্ঠান পশুসম্পদ অধিদপ্তর বা মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক অনুমোদিত এবং নির্দিষ্ট লাইসেন্সধারী, অথবা অ্যানিম্যাল হেলথ কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (AHCAB) অথবা বাংলাদেশ অ্যাকুয়া প্রোডাক্ট কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশন (BAPCA) অথবা বাংলাদেশ ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন (FIAB) অথবা বাংলাদেশ অ্যাগ্রো ফিড ইনগ্রিডিয়েন্টস ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন (BAFIITA) অথবা শ্রিম্প হ্যাচারি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (SHAB) এর সদস্য, তাদের ক্ষেত্রেই এই ছাড় প্রযোজ্য হবে।
এক্ষেত্রে উল্লেখিত প্রতিষ্ঠান সমূহের অবশ্যই পূর্বানুমোদনপত্র গ্রহণপূর্বক আমদানি কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে এবং নির্ধারিত ফরম্যাটে আমদানি, ব্যবহার ও সরবরাহ সংক্রান্ত তথ্য প্রতিটি চালানের জন্য সংরক্ষণ ও প্রতিবেদন আকারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবর দাখিল করতে হবে। বিশেষভাবে Meat and Bone Meal (MBM), Fish Meal এবং Protein Concentrate-এর মতো কিছু উপাদানের আমদানির ক্ষেত্রে পৃথক পূর্বানুমোদন বাধ্যতামূলক রাখা হয়েছে। এছাড়া আমদানিকৃত প্রতিটি পণ্যের গায়ে অবশ্যই “শুধুমাত্র প্রাণিসম্পদ, হাঁস-মুরগি ও মৎস্য খাতে ব্যবহারের জন্য” বলে সুনির্দিষ্টভাবে লেবেলিং থাকতে হবে।
প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়েছে, প্রতি ছয় মাস অন্তর আমদানিকারকদের একটি বিস্তারিত হিসেব জমা দিতে হবে যেখানে আমদানিকৃত পণ্যের পরিমাণ, উৎস, ব্যবহার এবং সরবরাহের বিস্তারিত উল্লেখ থাকবে। প্রয়োজনে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ সরকার অনুমোদিত পরীক্ষাগারে রাসায়নিক বিশ্লেষণ করাতে পারবে, এবং কোনো অসঙ্গতি ধরা পড়লে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা আমদানিকারকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এই সমস্ত তথ্য ও ব্যবস্থাপনা কাস্টমস আইন, ২০২৩ এবং মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২ অনুযায়ী পরিচালিত হবে।
পোল্ট্রি, ডেইরি ও মৎস্য খাতে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি ও বৈশ্বিক সরবরাহ সংকটের প্রেক্ষাপটে এই দীর্ঘমেয়াদি শুল্ক ছাড় শিল্পে বিনিয়োগ স্থিতিশীলতা এবং উৎপাদন ব্যয় হ্রাসে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। শিল্প সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর মতে, এটি একদিকে যেমন নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের ভিত্তি মজবুত করবে, অন্যদিকে ভোক্তা পর্যায়ে ডিম, দুধ ও মাছের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতেও সাহায্য করবে।
সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় ও নিয়মিত তদারকির মাধ্যমে এই শুল্ক সুবিধার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশের ফিড শিল্পের জন্য এটি একটি মাইলফলক হয়ে উঠবে, যা সামগ্রিকভাবে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে – শিল্প সংশ্লিষ্টদের বিশ্বাস।