Saturday 27th of April 2024
Home / এক্সক্লুসিভ / খামারীদের টাকা নিয়ে প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার নয়-ছয়ের অভিযোগ!

খামারীদের টাকা নিয়ে প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার নয়-ছয়ের অভিযোগ!

Published at আগস্ট ৬, ২০২৩

মো. মাহফুজুর রহমান (চাঁদপুর সংবাদদাতা) : চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ ও উত্তরে ১৬০ জন খামারীর প্রত্যেকের জন্য ২০ হাজার টাকা নির্ধারণ করে ছাগল ও মুরগী পালনে ঘর তৈরী বাবদ মোট ৩২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। পাশাপাশি নির্ধারিত নকশা প্রনয়ন করে এসব ঘর নির্মাণের নিয়ম বেঁধে দেন সংশ্লিষ্ট দপ্তর। সে অনুযায়ী ঘর নির্মাণ ও টাকা উত্তোলন করার কথা খামারীদের নিজেদেরই।

তবে এ নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে নিজস্ব নিয়মে পুরো প্রক্রিয়াটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে নিজস্ব ঠিকাদারের মাধ্যমে ঘর নির্মাণ কার্যক্রম চালিয়ে নিচ্ছেন -বলে অভিযোগ উঠেছে মতলব উত্তরের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা মতলব দক্ষিণ উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. জাকির এর বিরুদ্ধে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের অধিনে খামারিদের নিয়ে মুরগী ও ছাগল উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে তৈরী করা হয়েছে উৎপাদনকারী দল। যেসব দলের নাম করণ করা হয়েছে প্রোডিউসার গ্রুপ নামে। প্রতিটি প্রোডিউসার গ্রুপে (পিজি) খামারী সদস্যের সংখ্যা ৪০ জন। প্রাণি সম্পদের উৎপাদন বাড়াতে এসব খামারীদের জন্য মুরগী ও ছাগলের ঘর (শেড) নির্মাণ বাবদ জনপ্রতি ২০ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেয় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর।

সেই ধারাবাহিকতায় মতলব দক্ষিণ উপজেলার নায়েরগাঁও উত্তর ইউনিয়নে একটি ও মতলব উত্তর উপজেলায় ৩ টি সহ মোট ৪ টি প্রোডিউসার গ্রুপের জন্য বরাদ্ধ হয় ৩২ লাখ টাকা। এই টাকা সরাসরি খামারীদের ব্যাংক হিসেবে জমা হওয়ার কথা। তবে এই নির্মাণ কাজে সরাসরি খামারীরা যুক্ত থাকার কথা থাকলেও পছন্দের ঠিকাদারদের মাধ্যমে অনিয়মকে নিয়ম বানিয়ে এসব ঘর (শেড) নির্মাণ কার্যক্রম শুরু করেছেন মতলব দক্ষিণ উপজেলার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ও মতলব উত্তরের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা ড. জাকির।

খামারীরা জানান, ডা. জাকির শুরুতে বরাদ্ধকৃত অর্থ খামারীদের ব্যাংক হিসেবে জমা বলে জানিয়ে তাদের সোনালী ব্যাংকে নতুন হিসেব খুলতে নির্দেশ দেন।

 প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তার দেখানো প্রক্রিয়া মেনে সোনালী ব্যাংক মতলব শাখায় জনপ্রতি ১ হাজার টাকা জমা রেখে নতুন হিসেব খুলেন খামারী সদস্যরা। হিসেব খোলার কয়েকদিনের মাথায় খামারীদের ডেকে নিয়ে খালি চেক বইয়ে সই নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে বলেন প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা। টাকা উঠিয়ে কর্মকর্তা নিজেই ঘর বানিয়ে দিবেন বলে জানিয়ে দেন খামারীদের।

“এসব বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক ও যুগ্ম-সচিব মোহাম্মদ আবদুর রহিম বলেন, পুরো প্রক্রিয়ার কোথাও ঠিকাদার বা নিজস্ব ব্যক্তিদের মাধ্যমে ঘর নির্মাণ কার্যক্রমের কোন নির্দেশনা প্রদান করা হয়নি।”

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এই প্রকল্পের অধীনে প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখতে খামারীদের এই অর্থ বরাদ্ধ দেওয়া হয়। তবে বরাদ্ধের নিয়মানুযায়ী একটি নির্দিষ্ট  নকশা ও কাঠামোর মাধ্যমে শেডগুলো নির্মাণের নির্দেশনা দেয় অধিদপ্তর।

নির্দেশনায় বলা হয়, নকশা ও কাঠামোগত পরিমাপ ঠিক রেখে খামারীরা নিজ উদ্যোগে মুরগী ও ছাগলের জন্য শেড নির্মাণ করবেন। পরবর্তীতে একজন পর্যবেক্ষণ কর্মকর্তা এসব শেডের মান ও কাঠামো পর্যবেক্ষণ করে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে খামারীদের বরাদ্ধকৃত অর্থ বুঝিয়ে দিবেন।

তবে এ নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ডা. জাকির খামারীদের কাছ থেকে স্বাক্ষরসহ ব্ল্যাঙ্ক চেক নিয়ে ঘর নির্মাণের আগেই টাকা উত্তোলন করে সেইসব টাকা সরবরাহ করেন নিজস্ব কথিত ঠিকাদারদের কাছে।

অনিয়মকে নিয়ম বানিয়ে ভিন্ন পদ্ধতিতে ড. জাকির নিজস্ব নিয়মে পছন্দের ঠিকাদারদের মাধ্যমে কাজ করিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন খামারীরা।

মতলব দক্ষিণ ও উত্তর উপজেলার একাধিক প্রোডিউসার গ্রুপ (পিজি) সদস্যরা বলেন, নিয়মানুযায়ী আমরা নিজেরা নির্দিষ্ট কাঠামো মেনে শেড নির্মাণ করার ইচ্ছা পোষণ করলেও আমাদের এই সিদ্ধান্তকে না মেনে প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা নিজেই শেড নির্মাণ কাজ নিজের মতো করিয়ে নিবেন বলে আমাদেরকে চাপ সৃষ্টি করেছেন। এতে আমরা বাধ্য হয়ে কাজের দায়িত্ব তাদের উপর ছেড়ে দেই।

“ছাগল ও মুরগীর জন্য ঘর নির্মাণ কার্যক্রমে ঠিকাদার নিয়োগ বা কোন টেন্ডার প্রক্রিয়া না থাকলেও এই নিয়মকে তোয়াক্কা না করে কথিত ঠিকাদার নিয়োগ ও কোন চুক্তিপত্র ছাড়াই নিজস্ব নিয়মে যে কার্যক্রম পরিচালনা করছেন ডা. জাকির তা সম্পূর্ণভাবে নিয়ম বহির্ভূত বলে জানান প্রকল্পের উপ-পরিচালক ড. হিরন্ময় বিশ্বাস।”

তিনি বলেন, “কোন টেন্ডার প্রক্রিয়ার নিয়মতো নে-ই বরং খামারীদের সাথে নির্ধারিত স্ট্যাম্পে চুক্তিবদ্ধ হয়ে নির্ধারিত নকশার ঘর নির্মাণ কার্যক্রম পরিচালনা করার নির্দেশ দেওয়া আছে।”

খামারীরা অভিযোগ করে বলেন, শেড নির্মাণের জন্য প্রাণিসম্পদের দেওয়া নির্দিষ্ট কাঠামোর তথ্য চাইলে প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা তা দিতে অস্বীকৃতি জানান। এছাড়াও একাধিক খামারী বলেন, তাদেরকে নির্দিষ্ট নকশা ও কাঠামোর কোন তথ্য না দিয়ে উল্টো বিভ্রান্তমূলক তথ্য দিয়ে নানাভাবে পুরো কার্যক্রমকে একটি জটিল প্রক্রিয়া হিসেবে উপস্থাপন করেন।

মতলব দক্ষিণ উপজেলার নায়েরগাঁও উত্তর ইউনিয়নের প্রোডিউসার গ্রুপ আঁধারা দেশি-মুরগী উৎপাদনকারী দলের সভাপতি আছমা বেগম বলেন, কোন নকশা বা ঘর তৈরীর তথ্য না দিয়ে আমাদের নিজস্ব ব্যাংক একাউন্টের খালি চেক এ সই নিয়ে এবং অপর আরেকটি কাগজে সই নিয়ে তারা নিজেরাই টাকা উত্তোলন করবে বলে জানান। সে অনুযায়ী আমিও তাদের দেয়া চেক এ সই করি।

একই প্রোডিউসার গ্রুপের সহ-সভাপতি সালেহা বেগম বলেন, ১৫ দিন পর ব্যাংকে টাকা আসবে এই বলে আমাদের সোনালী ব্যাংক মতলব দক্ষিণ শাখায় একাউন্ট করিয়েছে। পরে তারা নিজেরাই টাকা তুলে কাজ করবেন বলে জানান। একই ঘটনার বর্ণনা দেন গ্রুপটির অন্যান্য সদস্যরা।

এদিকে ছাগল ও মুরগীর ঘর নির্মাণ কার্যক্রমে অনিয়মের একই ফিরিস্থি তুলে ধরেন মতলব উত্তরের ফতেপুর পূর্ব ইউনিয়নের প্রোডিউসার গ্রুপ (পিজি) লুধুয়া দেশী-মুরগী উৎপাদনকারী দলের  সদস্যরা।

গ্রুপটির সদস্য রাধা রানী বলেন, আমরা নিজেরাই ঘর নির্মাণ করতে চেয়েছি কিন্তু স্যাররা আমাদের করতে না দিয়ে নিজেরাই করে দিবে বলে জানিয়েছে

অপর এক সদস্য লাভলী বেগম জানান, তারা আমাদের কাছে ব্ল্যাংক চেক এ সই নিয়ে টাকা উঠিয়ে নিবে বলেছে। পরবর্তীতে আমাদের একাউন্টে টাকা এসেছে এমন একটি মেসেজ পাই। এরপরেই টাকাগুলো কেউ উঠিয়ে নিয়েছে এমন আরো একটি মেসেজ আমাদের ফোনে আসে।

যদিও এসব অভিযোগের বিষয়ে মতলব দক্ষিণ উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ও মতলব উত্তর উপজেলায় অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা ডা. জাকির বলেন, খামারীরা ঘর নির্মাণ কার্যক্রমকে জটিল মনে করে আমাদেরকে ঘর নির্মাণের কথা জানালে আমরা ঠিকাদার নিয়োগ করি

কিন্তু ডা. জাকিরের এই বক্তব্য মিথ্যা আখ্যা দিয়ে খামারীরা অভিযোগ করে বলেন, আমাদের সাথে এমন কোন আলোচনাই করেননি ডা. জাকির বরং আমরা নিজেরাই নকশা চেয়ে ঘর নির্মাণের কথা জানালে তিনি আমাদেরকে বিভ্রান্ত করে নিজেই ঘর নির্মাণ কার্যক্রম পরিচালনার কথা জানান।

এদিকে ডা. জাকির বলেন, নিয়মানুযায়ী ঠিকাদার বা খামারীরা নিজেদের অর্থ ব্যয় করে ঘর নির্মাণ সম্পন্ন করার পর একটি পর্যবেক্ষণ শেষে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে সরকারি বরাদ্ধকৃত অর্থ তাদের নিজস্ব ব্যাংক একাউন্টে পাবেন।

তবে এই নিয়ম না মেনে কিভাবে ঘর নির্মাণের আগেই ডা. জাকিরের নিয়োগকৃত ঠিকাদাররা অগ্রিম টাকা হাতে পেলো সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোন সদুত্তোর দিতে পারেননি।

ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা বখতিয়ার উদ্দিনের সমন্বয়ে ঠিকাদার নির্বাচন করা হয়েছে বলে জানান।

এদিকে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা বখতিয়ার উদ্দিনের কাছে জানতে চাইলে মুখে কুলুপ এঁটে বিষয়টি এড়িয়ে যান তিনি।

অপরদিকে মতলব দক্ষিণে ঘর নির্মাণের দায়িত্ব পাওয়া উপজেলার পৌর এলাকার অন্তর্গত উত্তর নলুয়ার বাসিন্দা কথিত ঠিকাদার কাসেম আলী দেওয়ান মুঠোফোনে জানান, তাকে ঘর তৈরীর জন্য নির্দেশ দেন ডা. জাকির। ঘর নির্মাণ বাবদ অগ্রীম টাকাও দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মতলব উত্তরে এসব ঘর নির্মাণ বাবদ একজন কথিত ঠিকাদার অগ্রিম ৪ লাখ টাকা এবং অপর একজন ২ লাখ টাকা ডা. জাকির হোসাইনের মাধ্যমে পেয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন।

বরাদ্ধকৃত ছাগল ও মুরগী পালনের ঘর নির্মাণ কার্যক্রম প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রকল্পটির চীফ টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর ড. মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী বলেন, বাংলাদেশ লাইভস্টক রিসার্চ ইন্সটিটিউট থেকে আমরা একটি নকশা দিয়েছি। সে অনুযায়ী খামারীরা যেকোন মাধ্যমে এটি নির্মাণ করবেন এবং পুরো কার্যক্রমটি তদারকি করার জন্য আমাদের লোকজন নিয়োগ করা হয়েছে।

ঠিকাদার নিয়োগের বিষয়ে তিনি বলেন, কোন টেন্ডার প্রক্রিয়া যেহেতু করা হয়নি সুতরাং ঠিকাদার নিয়োগের কোন নির্দেশ দেয়া হয়নি। খামারীরা স্থানীয় কারিগর দিয়ে নকশা মেনে ঘর নির্মাণ করতে পারবেন।

তবে খামারীদের ঘর নির্মাণ কার্যক্রম তদারকির দায়িত্বে থাকা মনিটরিং অফিসার মাহমুদুল হাসান জানান, ঘর নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর তদারকির দায়িত্ব আমার। নিয়মানুযায়ী ঘর নির্মাণ নকশা মেনে তৈরী হওয়ার পর অর্থ ছাড়ের বিষয়টি সব শেষে প্রক্রিয়া করা হয়। তবে কি কারণে এবং কিভাবে অর্থ ছাড় আগে করা হলো সেটি আমার জানা নেই।

This post has already been read 2311 times!