ড. মো. শামছুল আলম১ ও মো. নাজমুল হাসান মেহেদী২: গাছের সংযোজন যোগ্য অংশ (আদিজোড় ও উপজোড়) পরস্পর সংযুক্ত হয়ে যখন একটি একক গাছ হিসাবে বৃদ্ধি লাভ করে তখন তাকে গ্রাফট বলে এবং এ প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় গ্রাফটেজ। গ্রাফটেজ হলো গ্রাফটিং এর সাধারণ বা সমষ্টিগত পদ্ধতি এবং এর অন্তর্গত প্রত্যেকটি পদ্ধতিকে গ্রাফটিং বলা হয়। জীবিত কলা সম্পন্ন দু’টি উদ্ভিদাংশের পারস্পারিক জোড়া লাগাই হলো গ্রাফটেজের মূলনীতি। আমের যৌন ও অযৌন উভয় পদ্ধতিতেই বংশবিস্তার করা যায়। বীজ থেকে উৎপাদিত চারায় মাতৃগাছের গুণাগুন অক্ষুন্ন থাকে না এবং ফল ধরতেও অনেক সময় লাগে। এ জন্য কলমের মাধ্যমেই এর বংশবিস্তার করা হয়ে থাকে। আমাদের দেশে সাধারণত এপ্রিল থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত ফল গাছের বংশবিস্তার করা হয়ে থাকে। আমের ক্ষেত্রে অবশ্য জোড় কলমের মাধ্যমে বিশেষ করে ক্লেফট ও ভিনিয়ার কলমের মাধ্যমে বংশবিস্তার করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে অনুন্নত গাছকে উন্নত গাছে রুপান্তর করার জন্য সাধারণত টপ ওয়ার্কিং করা হয়ে থাকে। তবে নচ ও বার্ক গ্রাফটিং এর মাধ্যমে অনুন্নত গাছকে উন্নত জাতের গাছ ও ফলবান বৃক্ষে রুপান্তর করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে কম বয়সী থেকে বয়স্ক এবং অনুন্নত একটি গাছে কয়েক রকমের ভালো জাত দ্বারা নচ অথবা বার্ক গ্রাফটিং করে উন্নত গাছে রুপান্তর করে একই গাছ থেকে কয়েক রকমের ফল পাওয়া সম্ভব হবে।নচ ও বার্ক গ্রাফটিং অপেক্ষাকৃত সহজ ও কম ব্যয়বহুল এবং সফলতার হারও বেশি।
গবেষণা ফলাফল: বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) এর উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের আওতায় একটি গবেষণায় দেখা যায় যে, ৩টি ৫ বছর বয়সী, ৩টি ১০ বছর বয়সী, ৩টি ১৫ বছর বয়সী এবং ৩টি ২০ বছর বয়সী অনুন্নত আম গাছকে ১মিটার উচ্চতায় কেটে তার উপর উন্নত জাতের আম (আম্রপালি, বারি আম-৪, বাউ আম-১৪/ব্যানানা, গোপালভোগ ও বাউ আম-৬/পলিএম্ব্রায়নি) এর ৫টি করে নচ ও ৫টি করে বার্ক গ্রাফটিং করে সফলতার হার বিবেচনায় দেখা যায় যে ৫ বছর বয়সী গাছে ৮০% নচ গ্রাফটিং ও ৮০% বার্ক গ্রাফটিং, ১০ বছর বয়সী গাছে ৬০% নচ গ্রাফটিং ও ৮০% বার্ক গ্রাফটিং, ১৫ বছর বয়সী গাছে ৬০% নচ গ্রাফটিং ও ৭৫% বার্ক গ্রাফটিং এবং ২০ বছর বয়সী গাছে ৫০% নচ গ্রাফটিং ও ৭০% বার্ক গ্রাফটিং সফল হয়েছে। জাতের বিবেচনায়, আম্রপালি জাতে নচ ও বার্ক গ্রাফটিং এ সফলতার হার বেশি পাওয়া গেছে।
নচ গ্রাফটিং: আম, পেয়ারা, কামরাঙ্গা, আপেল, পীচ, চেরী সহ প্রায় সব ফল গাছে এ কলম করা যায়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটি ফাটল জোড়কলমের মত গাছের পুরোনো অংশ পরিবর্তন বা বয়স্ক ও অনুন্নত গাছের উন্নতি সাধনে এবং অফলন্ত গাছকে ফলবান বৃক্ষে রুপান্তর করার জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ কলমের পদ্ধতি মোটামুটিভাবে ফাটল জোঁড় কলমের মতই। তবে মূল পার্থক্য হলো এতে আদিজোড়ে কোন ফাটল তৈরী করা হয় না। আদিজোড় ও উপজোড়ে গোঁজ তৈরী করা হয় অথবা আদিজোড়ের মাথা করাত দ্বারা সমান করে কেটে তাতে লম্বালম্বিভাবে ক্রমশ উপরের দিকে গভীর করে কাঠ তুলে ফেলা হয়।
সুবিধা:
- মাতৃগাছের গুণাগুন সম্পন্ন এবং কাক্ষিত ফল দানে সক্ষম।
- গাছের পুরোনো অংশ পরিবর্তন বা বয়স্ক ও অনুন্নত গাছের উন্নতি সাধন করা যায়।
- কাটিং এর মতো পানি, আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের দরকার হয় না বলে বেশি যত্ন ও পরিচর্যার প্রয়োজন পড়ে না।
- রোগবালাই, কীটপতঙ্গ প্রতিরোধী এবং পরিবেশ সহনশীল গাছ পাওয়া যায়।
- স্বল্প পরিসরে অনেক কলম এবং তুলনামূলকভাবে খরচ কম হয়।
- তেমন কোন কারিগরি জ্ঞান বা দক্ষতার দরকার হয় না বলে যে কেউ এ কলম করতে পারে। তাছাড়া এ কলম হতে জন্মানো গাছে অল্প সময়ে ফুল ও ফল ধরে।
নচ ও বার্ক গ্রাফটিং
কলমের উত্তম সময়: মার্চ-আগস্ট মাস তবে বাতাসের আর্দ্রতা বেশি থাকলে সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত করা যাবে। অর্থাৎ বর্ষাকাল এ কলম করার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।
সায়ন বা উপজোড় নির্বাচন:
- সায়নের বয়স অবশ্যই পরিপূর্ণ হতে হবে। নির্বাচিত উপজোড় বা সায়ন অবশ্যই উৎকৃষ্ট, কাঙ্খিত ও একটি নামকরা জাতের ফলবতী গাছ থেকে সংগ্রহ করতে হবে। শীর্ষ শাখায় সর্বদাই কার্বোহাইড্রেটের সঞ্চয় কম থাকে বিধায় এটিকে কখনো উপজোড়ের জন্য নির্বাচন করা সঙ্গত নয়, তেমনি ফুল-কুঁড়িসহ উপজোড়ও পরিহার করা উচিত। সাধারণত সুস্থ, সতেজ, সবল তেজদীপ্ত খাট, মধ্য পর্ববিশিষ্ট ৫/৬ মাস বয়স্ক এবং চলতি মৌসুমের বর্ধনশীল শাখা উপজোড় বা সায়ন হিসেবে সর্বোত্তম। চলতি মৌসুমের ডালের পাতাগুলো যখন গাঢ় সবুজ হবে, ডালের ডগায় কুঁড়ি স্ফীত বা ফোটা ফোটা ভাব হবে এবং রোগ বালাই ও কীটপতঙ্গের আক্রমণ মুক্ত হবে এবং একই সাথে যে গুলোর আকৃতি স্টক চারার মত তখন ঐ ডালকে উপযুক্ত সায়ন হিসেবে বিবেচনা করা যাবে। নির্বাচিত সায়ন শাখা কুঁড়িসহ কেটে আনতে হবে এবং অগ্রভাগের সুপ্ত কুঁড়ি বাদে অন্যসব পাতা কেটে ফেলতে হবে। সায়নের দৈর্ঘ্য ১০-১৫ সে.মি. বা ৪-৬ ইঞ্চি হতে হবে।
- অল্পসংখ্যক কলম করতে হলে মা গাছের দক্ষিণ দিক হতে সায়ন নির্বাচন করতে হবে। অধিকসংখ্যক হলে সকল দিক থেকেই সায়ন নেওয়া যাবে।
- অতি বৃদ্ধ বা অতি কচি সায়ন বাদ দিতে হবে।
নচ গ্রাফটিং কলম করার পদ্ধতি
- এ পদ্ধতিতে প্রথমে বয়স্ক, অনুন্নত এবং অফলন্ত গাছকে গোড়া থেকে ১ মিটার বা সুবিধাজনক স্থানে কেটে ফেলা হয় (চিত্র)। এরপর মাথা করাত দ্বারা সমান করে কেটে দেওয়া হয়। এরপর কাটা অংশে কপার ফাংগিসাইড/আলকাতরা দেওয়া হয় যাতে কোন রোগের আক্রমণ না হয়। এরপর কাটা অংশ থেকে লম্বালম্বিভাবে নীচের দিকে প্রায় ২ ইঞ্চি পরিমাণ অংশে গোঁজের মতো কেটে কিছুটা কাঠসহ বাকল তুলে ফেলা হয়। অনুরূপ মাপে উপজোড়ের নিচের প্রান্ত গোঁজের মতো কেটে আদিজোড়ের কর্তিত অংশে সুন্দরভাবে খাপ খাইয়ে স্থাপন করা হয়। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন আদিজোড় ও উপজোড়ের বাকল ভালোভাবে মিশে যায়।
- এরপর পলিথিন ফিতা দিয়ে সায়নকে আদিজোড় এর সাথে ভালোভাবে বেঁধে দেওয়া হয়। আদিজোড় এর কাটা অংশের উপরে সায়নকে পলিথিন ফিতা দিয়ে ভালোভাবে বেঁধে দেওয়া হয়।
- এরপর পলিথিন দিয়ে সায়ন ও আদিজোড়কে এমনভাবে ঢেকে দেওয়া হয় যাতে কর্তিত অংশে কোন পানি না যায়।
- সায়ন থেকে কুঁশি বের হলে পলিথিন এর কভার খুলে দেওয়া হয়।
বাকল গ্রাফটিং:
পার্শ্ব পদ্ধতির এটি একটি বিশেষ রুপ। জোড় কলমের বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে এটি অধিকতর সহজ ও সফল পদ্ধতি। সাধারনত গাছের বাকল যখন কাঠ থেকে সহজে আলাদা করা যায় তখনই বাকল কলম করা হয়ে থাকে। এর জন্য উপযুক্ত সময় হলো বসন্তকাল। এ পদ্ধতিটি নচ গ্রাফটিং এর মতই। প্রথমে আদিজোড়কে মাথা থেকে কেটে ফেলা হয় এবং কর্তিত প্রান্ত এর শীর্ষ থেকে নিচের দিকে ৫ সে.মি. লম্বা ও কিছুটা চওড়া করে বাকল আলগা করা হয়। এরপর ২-৩ টি কুঁড়িযুক্ত ১২-১৫ সে.মি. দীর্ঘ ও ৬-১২.৫ সে.মি. ব্যাসের উপজোড় সাধারনত এ ধরণের কলম করার জন্য নির্বাচিত করা হয়। এ উপজোড় এর নিচের প্রান্ত থেকে ৫ সে.মি. লম্বা ও তিযকভাবে একটি কর্তন দেয়া হয়। অতঃপর উপজোড়কে আদিজোড়ের আলগা বাকলের মাঝ স্থাপন করা হয়। এরপর জোড়া লাগানো অংশসহ সম্পূর্ণ সায়নটি পলিথিন ফিতা দিয়ে বেঁধে দিতে হবে। প্রয়োজনে সায়নকে আদিজোড়ের সাথে ভালো ভাবে বাঁধার জন্য সুতলি ব্যবহার করা যেতে পারে। এ উপায়ে একটি কান্ডে একাধিক জাতের একাধিক কলম করা যেতে পারে।
পরবর্তী পরিচর্যা:
- ৩০-৪০ দিনের মধ্যে কলমকৃত শাখা থেকে কুঁশি গজাবে যা পলিথিন এর বাইরে থেকে দেখা যাবে (চিত্র)।
- গজানো পাতা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লে পলিথিন খুলে দিতে হবে।
- রুটস্টক ও সায়নের জোড়ার নিচে রুটস্টকে কুঁশি (অফস্যুট) বের হলে তা ভেঁঙ্গে দিতে হবে।
- সায়নে গজানো পাতা পুষ্ট হওয়ার পরপরই রুটস্টক ও সায়নের জোড়ার পলিথিন কেটে দিতে হবে।
পোকামাকড় ও রোগবালাই
সায়ন থেকে পাতা বের হওয়ার পর প্রধানত: পাতা কাটা উইভিল, জাব পোকা ও পাতাখেকো শুঁয়োপোকা পোকা দ্বারা আক্রান্ত হয়।
পাতা কাটা উইভিল
- এ পোকা কচি আমপাতার নিচের পিঠে ছোটছোট গর্ত করে ডিম পাড়ে।
- এরপর ডিমসহ কচিপাতাটি (লাল পাতা) রাতের বেলা বোঁটা থেকে একটু দূরে কাঁচি দিয়ে কাটার মতো করে কেটে ফেলে দেয় (চিত্র)। এতে গাছের নুতন পাতা ধ্বংস হয় এবং খাবার তৈরি কমে যায়। ফলে চারা বা গাছ দুর্বল হয়ে যায়।
দমন ব্যবস্থা
- আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে গাছে কচিপাতা দেখার সাথে সাথে প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২০ মিলিলিটার সুমিথিয়ন ৬০ ইসি (৪ কর্ক) মিশিয়ে গাছসহ গাছের গোড়ার মাটি ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।
- এ পোকা দিনের বেলায় গাছের নিচে পড়ে থাকা পাতার নিচে ও আগাছার মধ্যে লুকিয়ে থাকে। তাই গাছের নিচে পড়ে থাকা কচিপাতা দেখামাত্র সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
- গাছতলা আগাছামুক্ত ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
পাতা খেকো শুঁয়োপোকা
- এ পোকার কীড়া (বাচ্চা) চারাগাছ ও বড় আম গাছের পাতায় আক্রমণ করে। স্ত্রী মথ আমপাতার উপরের পিঠের কিনারায় লাইন করে মুক্তার দানার মত সাদা ডিম পাড়ে।
- ডিম ফুটে কীড়া বের হলে, কীড়াগুলো প্রথমে ঐ পাতার ওপর গুচ্ছাকারে থাকে, পরে গাছে ছড়িয়ে যায় এবং পাতার মধ্যশিরা রেখে পুরো পাতা খেয়ে ফেলে।
- আক্রান্ত গাছ সম্পূর্ণ বা আংশিক পাতাশূন্য হয়ে পড়ে। এতে গাছের খাবার তৈরি বাধা পায় এবং গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে।
দমন ব্যবস্থা
- ডিমসহ পাতা দেখামাত্রই সংগ্রহ করে পুড়িয়ে মারতে হবে ।
- গুচ্ছাকারে বা ছড়ানো অবস্থায় থাকা শুঁয়োপোকাগুলো সংগ্রহ করে পা-দিয়ে পিষে বা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। পা-দিয়ে পিষে মারার সময় অবশ্যই পায়ে স্যান্ডেল বা জুতা থাকতে হবে।
- আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২০ মিলিলিটার ডাইমেক্রন/ডায়াজিনন ৬০ ইসি (৪ কর্ক) বা সুমিথিয়ন ৫০ ইসি (৪ কর্ক) মিশিয়ে পাতা ও ডাল-পালাসহ গাছের গোড়ার মাটি ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।
পাতাকাটা উইভিল ও পাতা খেকো শুঁয়োপোকা ছাড়াও যদি অন্য কোন পোকা দ্বারা আক্রান্ত হয় তাহলে যে কোন কীটনাশক যেমন-ডেসিস, সাইপেরিন, সিমবুশ ইত্যাদির যেকোন একটি ২ মি.লি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্পোর করা যেতে পারে।
তবে যদি কোন রোগ দেখা যায়,সে ক্ষেত্রে যে কোন ছত্রাকনাশক যেমন-ডাইথেন এম ৪৫, থিওভিট, ব্যাভিষ্টিন ইত্যাদির যেকোন একটির ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্পোর করা যেতে পারে।
লেখক১: ড. মো. শামছুল আলম, উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ, বিনা; লেখক২: মো. নাজমুল হাসান মেহেদী, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ, বিনা।