বৃহস্পতিবার , ডিসেম্বর ৫ ২০২৪

কম্বাইন হারভেস্টার -এর নিরাপদ সংরক্ষণ ও দীর্ঘস্থায়ী ব্যবহারের জন্য করণীয়

ড. মোহাম্মদ এরশাদুল হক : সুচিন্তিতি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও তার সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে কৃষিকে লাভজনক ও রিস্ক ফ্রি করা যায়। বর্তমান করোনা ভাইরাস জনিত আপদকালিন সময়ে কৃষি ক্ষেত্রে সদাশয় সরকারের ২০০ কোটি টাকা উন্নয়ন সহায়তা প্রধান খাদ্য শস্য বোরোধান সংগ্রহকে করেছে নিশ্চিত, লাভজনক ও নিরাপদ। কৃষকদের বিনিয়োগ ও সরকারের সহায়তা দীর্ঘমেয়াদী ও টেকসই করতে প্রয়োজন হারভেস্টার যন্ত্রগুলোর সঠিক যত্ন ও রক্ষণাবেক্ষন। ২০১৫ সালে দেশে শস্য কাটার ক্ষেত্রে মাত্র ১% যান্ত্রিকীকরণ লক্ষ্য করা গেলেও কৃষি মন্ত্রণালয়ের রোডম্যাপ অনুযায়ী আগামী ২০২১ সাল নাগাদ দেশের ফসল কর্তনে যান্ত্রিকীকরন ৩০% এ উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে সরকার ইতিমধ্যে বিভিন্ন প্রনোদনা সহ আগামী পাঁচ বছরে আরো ১৫৫০০ টি কম্বাইন হারভেস্টার প্রদানসহ নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করছে। আমরা জানি, প্রচলিত পদ্ধতিতে হাতে কাটা-মাড়াই করতে এক একর জমির জন্য ১৮-২৫ জন শ্রমিকের প্রয়াজন হয়। এ ছাড়া বোরো মৌসুমে ধান ছাড়াও অন্যান্য রবি ফসল যেমন গম, ভুট্টা, আলু, সবজি ও ফলও সংগ্রহ করতে হয়। ফলে বোরো সংগ্রহের এ সময়টিতে বিশেষ করে ধান সংগ্রহে চোখে পড়ার মত কৃষি শ্রমিকের ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। এই শ্রমিক সমস্যা সমাধানে কম্বাইন হারভেস্টার গুরুত্বপূর্ন অবদান রাখবে।

ছোট ও কম দামী কম্বাইন নিয়ে এ দেশে কম্বাইনের মাঠ পর্যায়ে যাত্রা শুরু হয়। সে পর্যায়ে বিভিন্ন ব্যান্ডের এক হাজারের উপরে কম্ব্ইান মাঠে রয়েছে যার অনেকগুলো ভালো কাজ না করলেও ঐ যন্ত্রগুলো দ্বারা চালক, মেকানিক, এন্টারপ্রেনিওর ও নীতি নির্ধারকদের মানসিক ও কর্মকৌশল ভিত্তিক লার্নিং হয়েছে। সে সময়ের উল্লেখযোগ্য একটি শিক্ষা হলো যে, হারভেস্টার গুলোর ২৫-৩০ ভাগ জীবনকাল কমেছে নতুন হারভেস্টারের প্রথম লোড দেয়ার নীতিমালা না মানা ও প্রথম সার্ভিসিং (৫০ ঘন্টা পর) না করার কারনে; ৩৫-৪০ ভাগ জীবনকাল হারিয়েছে সংরক্ষণকালীন নিয়ম না মানার ফলে আর ৩০-৪০ ভাগ হারভেস্টার কর্ম ক্ষমতা হারিয়েছে স্পেয়ার পার্টসের অভাবে। অব্যবহৃত পড়ে থাকা অনেক হারভেস্টার এখনও প্রয়োজনীয় স্পেয়ার পার্টস সহ সঠিক মেরামতের দ্বারা কর্মউপযোগী করা সম্ভব। অর্থাৎ মানসম্মত যন্ত্র, প্রশিক্ষিত চালক ও স্পোয়ার পার্টস সহ ক্রমাগত কারিগরি সহায়তা না হলে হারভেস্টার তার অর্থনৈতিক লাইফ পর্যন্ত পৌছতে পারেনা।

অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে, ৩৫ অশ্বশক্তির নিচের কোন কম্বাইন কারিগরি ও অর্থনৈতিক দুই দিক দিয়ে লাভজনক হয়নি। এ লক্ষে এ পর্যায়ে কম্বাইন হারভেস্টারের মডেল নির্বাচনে মাঝারী সাইজকে প্রাধান্য দেয়া যথার্থ হয়েছে। মাঠে প্রাপ্য মাঝারিমানের একটি কম্বাইন হারভেস্টার ঘন্টায় প্রায় ১ একর জমির ধান কেটে মাড়াই-ঝাড়াই করে বস্তা বন্ধি করতে পারে। সে হিসেবে এক একটি যন্ত্র দৈনিক গড়ে ৬-৮ একর জমির ধান কাটতে পারে। সময়মত ফসল সংগ্রহ করার ফলে সংগ্রহত্তোর ক্ষতি অনেকাংশে হ্রাস পায়, প্রতিকুল আবহাওয়ায় ফসল নস্ট হয়না, মোটের উপর উৎপাদন খরচ কমে। এতসব সুবিধা থাকা সত্বেও যে সব কারনে কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহারে কৃষক উদ্যোগী হয়ে এগিয়ে আসেনি তার অন্যতম কারন হলো প্রাথমিক বিনিয়োগের পরিমান বেশি কিন্তু যন্ত্রের ব্যবহার করা যায় বছরে মাত্র ৬০-৯০ দিন। এ জন্যই দরকার সরকারের উন্নয়ন সহায়তা। কৃষক বান্ধব সরকার সহজেই বিষয়টি অনুধাবন করায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহন শুরু হয়েছে। তারপরেও কৃষকের নিয়মিত অভিযোগ যন্ত্রের গুনগত মান নিয়ে। তবে বর্তমানে সরকারের উন্নয়ন সহায়তার অন্তর্ভুক্ত সবকয়টি যন্ত্রই কারিগরি দিক দিয়ে বিশ^মানের। তাহলে কি কারনে কৃষকরা যন্ত্র নিয়েও ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে তা উল্লেখ করা জরুরি।

কম্বাইন হারভেস্টার একটি উচ্চ প্রযুক্তির নলেজ বেইজড মেশিন যেখানে যন্ত্রের পাশাপাশি যন্ত্রচালককেও দক্ষ ও জ্ঞান সম্পন্ন হতে হয়। কারন ধানের জাত, ঘনত্ব, ধান খাড়া কিংবা হেলানো এসব অবস্থায় যন্ত্রের বিভিন্ন অংশের সেটিংস পরিবর্তন করতে হয়। শুকনো ধান ক্ষেতে যে গতিতে যন্ত্র চালনা করা যায় বৃষ্টি পরবর্তী ভেজা ক্ষেতে যন্ত্র চালনার গতি কমাতে হয় ও বিশেষ খেয়াল রাখতে হয় যাতে থ্রেসিং চেম্বারে জ্যাম না লাগে। প্রত্যেকটা যন্ত্রেই এসব অপশন ধাকলেও প্রত্যেক চালকই তার ব্যবহার করে সুফল নিতে পারছেন না। এ জন্য যন্ত্রচালককে ভাল কারিগরি জ্ঞান সমৃদ্ধ হতে হবে। বিগত দিনে দেখা গেছে যে, প্রশিক্ষত চালক ও মানসম্পন্ন যন্ত্রের সমন্বয়ই কেবল হারভেস্টারের বানিজ্যেক সফলতা এনে দিতে পারে। ভালো যন্ত্রের সাথে সাথে প্রশিক্ষিত চালক তৈরি করাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই মহুর্তে রাতারাতি প্রশিক্ষিত চালক তৈরি সম্ভব না হলেও দীর্ঘমেয়াদে প্রশিক্ষিত চালক তৈরির কার্যকর ব্যবস্থা এখনই শুরু করতে হবে। দ্রুততম সময়ে আমাদের কৃষকরাও চালনায় পারদর্শি হচ্ছে কিন্তু তাদের অধিকাংশেরই আরো কিছু জরুরি বিষয়ে সচেতন হওয়া দরকার। এ বিষয়গুলো ফ্যাক্ট শিট আকারে বাংলায় সরবরাহ করলে চালকরা সহজে আয়ত্ব করতে পারবেন। এখানে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা যৌক্তিক মনে করছি।

প্রত্যেক চালক মাঠে নামার পূর্বে নিজের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করবে। এরপর নিশ্চিত করতে হবে যন্ত্রের লুব্রিকেন্টের পরিমান ও ইঞ্জিনে পানির পরিমান। ব্যটারী চার্জ সহ পুরো ইলেকট্রিক সিস্টেম,কনভেয়ার সিস্টেম, মাড়াই চেম্বার চেক করে নিতে হবে। আর চেক করতে হবে প্রত্যেকটা নাটবোল্টের সঠিক টাইট, বেল্টের ও চেনের সঠিক টান ও সেন্সরের কার্যকারিতা। চলমান এই করোনা পরিস্থিতিতে আমরা যেমন নাককে ঢেকে রেখে নিজেকে প্রটেকটেড রাখার চেষ্টা করছি তেমনি হারভেস্টারকে রক্ষা করতে হয় ধুলা বালি থেকে যাতে ইঞ্জিনের ভিতরে প্রবেশ না করে। এজন্য এয়ার ক্লিনার ফিল্টারটিকে ভরা মৌসুমে দিনে ২-৪ বার পরিষ্কার করতে হবে। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত একটি এয়ার ক্লিনার ফিল্টার হারভেস্টারের সাথে রাখা ভালো। প্রতিদিন সকালেই রেডিয়েটরে পরিমান মত পরিষ্কার পানি ঢেলে নিতে হবে ও রেডিয়েটর ফিন পরিষ্কার আছে কি-না তা দেখে নিতে হবে; অনেকে রেডিয়েটর ক্যাপ খুলে রাখে যা ইঞ্জিনের জন্য খুবই ক্ষতিকর। মাঠে নামার পূর্বে আরো চেক করে দেখে নিতে হবে যে, ধানের ক্ষেতে পার্চিং এর খুটি বা অন্য কোন খুটি/ধাতব দন্ড আছে কি-না। এ বিষয়গুলো নিশ্চিত হয়ে মাঠে নামতে হবে। কাজ শেষে আবারো যন্ত্রটি পরি¯কার করে রাখতে হবে।

যন্ত্র সরবরাহকালীন সময়ে সাধারনত বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান সব ইঞ্জিন অয়েল,গিয়ার অয়েল ও হাইড্রলিক অয়েল সরবরাহ করে থাকে। যন্ত্রগুলো চালনার প্রথম ৫০ ঘন্টার যতœ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নো লোড ও হাফ লোডে প্রত্যেক গিয়ারে ৪ ঘন্টা করে চালিয়ে তারপর ফুল লোডে চালাতে হবে এবং প্রথম ৫০ ঘন্টা চালনা পূর্ণ হলে সকল অয়েল ফেলে দিতে হয়। এসময় খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, অয়েল গুলোর সাথে লোহার কুচি ও নানা অপদ্রব্য বের হয়ে আসছে। এই প্রথম বারের সার্ভিসিং এর উদাসিনতা, অসাবধানতা বা ভুলের কারনে যন্ত্রগুলো তার জীবনকালের বিরাট অংশ হারিয়ে ফেলে। এরপর নিয়মিত (১৫০-২০০ ঘন্টা) বিরতিতে কম্বাইন হারভেস্টারে লুব্রিকেন্ট চেক করা ও ঘাটতি পুরন করা খুবই জরূরী কেননা এটা যন্ত্রের রক্তের মত কাজ করে। সাধারনত যন্ত্রের সাথে সরবরাহকৃত ম্যানুয়ালে এসব লেখা থাকে। কিন্তু আমাদের দেশের কৃষকরা ইংরেজিতে তত পারদর্শি নয় বিধায় বাংলায় ব্যবহারবিধি বা ম্যানুয়াল সরবরাহের উদ্যোগ নিতে হবে।

আমাদের দেশে প্রধানত দুই ধরনের কম্বাইন হারভেস্টার রয়েছে- ১) হোল ফিড টাইপ যেখানে খড় সহ আস্ত ধান গাছটিই যন্ত্রের মধ্যে প্রবেশ করে বিধায় খড় কেটে যায় ও ২) হেড ফিড টাইপ যেখানে শুধু ধানের শীষ যন্ত্রের মধ্যে প্রবেশ করে বিধায় খড় আস্ত থাকে। হোল ফিড সিসটেম চালানো সহজ ও সমস্যাও কম হয় কিন্তু আমাদের দেশে ধানের খড়ের নানাবিধ ব্যবহার ও বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে বিধায় হেড ফিড সিসটেম বেশি জনপ্রিয়। সরকারের উন্নয়ন সহায়তায় বিশ^মানের ইয়ানমার, কুবোতা, ডেডং, ওয়ার্ল্ড, লাকি স্টার, সাইফেং এর মত ব্রান্ডকে নির্বাচন করা হয়েছে । ফলে মাঠে চালনার সময় নস্ট হওয়ার প্রবণতা কম দেখা গেলেও অদক্ষ চালক ও নানাবিধ কারনে সমস্যা আসা অস্বাভাবিক নয়। যদিও উন্নয়ন সহায়তার কম্বাইন হারভেস্টার গুলোতে ১ বছরের ওয়ারেন্টি ও ২ বছরের সার্ভিস ওয়ারেন্টি দেয়ার কথা তবুও তার সঠিক প্রাপ্রতা নিশ্চিত করতে হবে।

ধান সংগ্রহের পিক টাইমে যদি কোন কম্বাইন হারভেস্টার নষ্ট হয় এবং তার একটি ক্ষুদ্র পার্টস সংগ্রহেও যদি ২-৫ দিন সময় অপেক্ষা করতে হয় তবে মালিকের মাথায় হাত। যন্ত্রগুলো নতুন হওয়ার এখনও গ্রামে গঞ্জে এর স্পেয়ার পার্টস পৌছায়নি। আবার এ যন্ত্রের অভিজ্ঞ মেকানিকও অপ্রতুল। তাই প্রত্যেকটা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানেরই স্পেয়ার পার্টস সহ এখন অতি জরুরী মেকানিক সেবার একাধিক দল গঠন জরুরি, সার্ভিস ভ্যানসহ যাতে দ্রুততম সময়ে মাঠে পৌছতে পারে। মেকানিক ও চালকদের প্রশিক্ষণের বিষয়টি তাই গুরুত্বের সাথে চিন্তা করতে হবে। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে, প্রশিক্ষিত চালক একটি মাঝারি মানের যন্ত্র দিয়েও লাভজনক ব্যবসা পরিচালনা করতে পারে; আবার অদক্ষ চালকের কারনে অনেক ভালো মানের যন্ত্র কারিগরি ও ব্যবসায়িক উভয়দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হেেয়ছে। জ্ঞান নির্ভর যন্ত্রের জন্য এটাই একটা প্রিকন্ডিশন যে, চালককে প্রশিক্ষিত হতে হবে।

আমরা যদি সাইকেল আর মটরসাইকেলের উদাহরন দেখি তবে দেখব যে, মটরসাইকেল যেহেতু জ্ঞান নির্ভর যন্ত্র তাই এর জন্য চালকের প্রক্ষিণের সনদ (লাইসেন্স) চাওয়া হয়। কৃষি ক্ষেত্রে জ্ঞান নির্ভর যন্ত্র যেমন কম্বাইন হারভেস্টার, ট্রাক্টর ও রাইসট্রান্সপ্লানাটারের জন্য নিকট ভবিষ্যতে লাইসেন্সিং ব্যবস্থাও চালৃ করা যেতে পারে। ট্রাক্টরের ব্যাপারেতো এ বিষয়গুলো এখনই প্রায়শই আলোচনায় আসতে শোনা যায়। উন্নত হারভেস্টার গুলোর ড্যাস বোর্ডে কতগুলো মিটার আছে এবং কতগুলো সিগনাল লাইট জ¦লে। এসব মিটার ও সিগনাল লাইট সম্পর্কে বিস্তারিত ধারনা চালকের অবশ্যই ধাকতে হবে। কতগুলো হারভেস্টারে নিরাপত্তার জন্য চালককে সহায়তা করতে সেন্সর যুক্ত করা হয়েছে কিন্তু সেন্সর গুলো কখন কি সিগনাল দিচ্ছে তা সম্পর্কে ধারনো না ধাকলে দূর্ঘটনা ঘটা অস্বাভাবিক নয়। এ ব্যপারে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টেটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের কৃষি শক্তি ও যন্ত্র বিভাগ ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কৃষি প্রকৌশলী ও তাদের প্রশিক্ষণ সুবিধাকে কাজে লাগানো যেতে পারে।

সাম্প্রতিক গুরুত্ব বিবেচনায় গনমাধ্যম বিশেষ করে টিভি চ্যানেলগুলোতে এ যন্ত্র চালনা, রক্ষণাবেক্ষণ ও সম্ভাব্য সমস্যার তথ্য ভিত্তিক প্রামাণ্য চিত্র এবং অভিজ্ঞ কৃষি প্রকৌশলীর মাধ্যমে অনলাইন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বোরো মৌসুমের ধান সংগ্রহের পরে কম্বাইন হারভেস্টারগুলোর যথাযথ সংরক্ষনের উদ্যোগ নিতে হবে। আগামী আমন মৌসুম আসার আগে সীমিত আউসে কিছু কম্বাইন হারভেস্টারের ব্যবহার ছাড়া প্রায় ৪-৫ মাস যন্ত্রগুলোর তেমন কোন কাজ থাকবে না। কৃষককে চিন্তা করতে হবে যে, আপনার বিনিয়োগ ও সরকার যে উন্নয়ন সহায়তা দিয়েছে তার দীর্ঘমেয়াদী সুফল পেতে আপনাকে এগিয়ে আসতে হবে। এজন্য প্রত্যেক যন্ত্রের জন্য স্বল্পখরচের হলেও সংরক্ষণাগার তৈরির ব্যবস্থা করতে হবে, কেননা সঠিকভাবে সংরক্ষনের অভাবে এ সময়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হারভেস্টার তার কার্যক্ষমতা হারাবে।

সংরক্ষণাগারে রাখার পূর্বে কয়েকটি কাজ করতে হবে যথাঃ ১) হারভেস্টারের বাইরের অংশ ভালোভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করতে হবে যাতে কোন কাঁদা ও মবিল গায়ে লেগে না থাকে; ২) ক্্রলার সিটেমের রাবার ট্র্যাকের কাদা পরিষ্কার করতে কোন ধরনের ধারালো বা মেটালিক বস্তু ব্যবহার করা যাবে না; ৩) থ্রেসিং সিলিন্ডার, ভাইব্রেশন চালুনি, অগার ও সাইড কভার খুলে ভেতরকার সকল শস্য (ধান) ও খড় বের করে পরিষ্কার করতে হবে, এসব জায়গায় ধান বা খড় থাকলে ওগুলো খেতেই ইদুর আসবে ও হারভেস্টারের অন্যান্য অংশ ক্ষতি করবে; সংরক্ষণের সময় অগারের মুখ, গ্রেইন ট্যাংকের মুখ ও অন্যান্য ছিদ্র পুরাতন সুতি কাপড় দিয়ে বন্ধ করে দিতে হবে; ৪) হাইড্রোলিক অয়েল, গিয়ার অয়েল, ইঞ্জিন অয়েল ও অন্যান্য লুব অয়েল চেক করতে হবে, মান হারালে পরিবর্তন বা প্রয়োজনে পরিপূর্ণ করতে হবে; ৬) রেডিয়েটর চেক করতে হবে ও কোলেন্ট অর্থাৎ ভালো মানের পরিষ্কার পানি দ্বারা পূর্ণ করতে হবে; ৭) ইলেক্ট্রিক লাইন চেক করতে হবে ও প্রয়োজনে মেরামত করতে হবে যাতে কোনভাব্ইে বডি আর্থিং বা লিক না থাকে; ৮) সকল চেইন, বিয়ারিং, কাটারবার ও অন্যান্য চলমান অংশে লুব্রিকেন্ট দিতে হবে; ৯) সম্ভব হলে পুরো হারভেস্টারে মরিচা প্রতিরোধী জেল মাখিয়ে রাখতে হবে; ১০) সকল গ্রিজিং পয়েন্টে ভালো মানের গ্রিজ ব্যবহার করে রাখতে হবে, নিন্মমানের গ্রীজ ভালোর চেয়ে ক্ষতি বেশি করবে; ১১) সকল বেল্ট টেনশন চেক করতে হবে; ১২) হারভেস্টারের সকল নাট-বোল্ট টাইট দিতে হবে; ১৩) এয়ার ক্লিনার ফিল্টার, ফুয়েল ফিল্টার ও হাইড্রলিক ফিল্টার চেক করে পরিষ্কার বা মান সম্মত নতুন ফিল্টার দিয়ে বদল করতে হবে; ১৪) কাটারবার অংশটি ও রিল সিস্টেমের রিলটি ইটের ফ্লোরের ত্রিপল বিছিয়ে এর উপর নামিয়ে রাখতে হবে। অতপর হারভেস্টারকে একটি সংরক্ষিত উচুঁ ও ইট বিছানো কক্ষে সংরক্ষণ করতে হবে।

হারভেস্টারটি একটি বড় ত্রিপাল বা প্লাস্টিক কভার দ্বারা ঢেকে রাখতে হবে। সংরক্ষণকালে কয়েকটি কাজ নিয়মিত করতে হবে যথাঃ ১) প্রতি ৭-১০ দিনে হারভেস্টার বের করে স্টার্ট দিয়ে কমপক্ষে ১০ মিনিট চালাতে হবে। অন্যথায় এর ব্যাটারী, ইলেক্ট্রিক সিস্টেম ও ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্থ হবে; অল্প সময় চালালে প্রতিবার চালনার পরে ব্যাটারীর কালো টার্মিনালটি খুলে রাখতে হবে ও স্টাটের আগে লাগিয়ে নিতে হবে; ২) ইদুর যাতে ক্ষতি করতে না পারে সেজন্য ইদুরমারার বিষ টোপ বা গ্যাস ট্যবলেট ব্যবহার করতে হবে, মনে রাখতে হবে বর্তমান হারভেস্টার গুলোর ইলেক্ট্রিক সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্থ হলে ওয়ারেন্টি পাওয়া যাবেনা এবং কোন কোন ক্ষেত্রে মেরামত করাও কষ্টকর; ৩) কোন ভাবেই সংরক্ষণাগারে হারভেস্টারে যাতে পানি প্রবেশ না করে কেননা পানি মেটালে মরিচা ধরায়, বিয়ারিং নষ্ট করে, কাটারবারের কার্যক্ষমতা কমায়।

এভাবে যত্ন করে রাখার পড়েও আগামী আমন মৌসুমে হারভেস্টারগুলো মাঠে নামানোর পূর্বে আবারো কিছু বিষয় নিশ্চিত হতে হবে; যথাঃ ১) হারভেস্টার ভালো ভাবে পরিস্কার করে সকল চলমান অংশে লুব্রিকেটিং অয়েল ও গ্রীজ সরবরাহ করতে হবে; ২) ফুয়েল ট্যাংক, রেডিয়েটর ট্যাংক, লুব অয়েল সাম ও হাইড্রলিক ট্যাংক পরীক্ষা করে দেখে ট্যাংক পরিমানমত পূর্ণ করতে হবে এবং এদের সংশ্লিষ্ট লাইন চেকআপ করতে হবে; ৩) সকল ফিল্টার পরিষ্কার বা পরিবর্তন করতে হবে; ৪) সকল চেইন ও বেল্টের টান পরীক্ষা করতে হবে; ৫) ব্যাটারী টার্মিনাল সংয়োগ দিয়ে প্রত্যেক ইলেকট্রিক লাইনের সংযোগ ও ব্যাটারীসহ অন্যান্য সকল সিগনালের কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখতে হবে; ৬) অগার, গ্রেইন ট্যাংকের মুখ ও অন্যান্য ছিদ্র যে কাপড় দিয়ে বন্ধ ছিল তা খুলে দিতে হবে; ৭) ফুয়েল পাম্প, হাড্রলিক পাম্প ও অয়েল পাম্পের কার্যকারিতা ঠিক করে নিতে হবে; কাটার বারের ব্লেড গুলোর মধ্যেকার নির্ধারিত ফাঁক চেক করতে হবে ও প্রয়োজনীয় লুব্রিকেন্ট দিতে হবে; ৮) কোন রকম লোড ছাড়া আইডল অবস্থায় স্টার্ট দিয়ে ইঞ্জিন ও হারভেস্টারের বিভিন্ন অংশ কাজ করছে কিনা তা পরখ করে নিতে হবে; ৯) সম্ভব হলে কোম্পানির প্রশিক্ষিত মেকানিক দিয়ে দূর্বল ও নষ্ট পার্টসগুলো মেরামত করে নিতে হবে; ১০) ফিল্টার সমূহ, বেল্ট ও অন্যান্য জরুরী কিছু স্পেয়ার পার্টস সংগ্রহ করে রাখতে হবে; ১১) নিজে না চালালে প্রশিক্ষিত, সৎ ও সিনসিয়ার চালক নিয়োগ দিতে হবে; ১২) একাধিক মেকানিকের নাম্বার চালকের সাথে রাখা যাতে যে কোন প্রয়োজনে মেকানিকের পরামর্শ নেয়া যায় বা ডাকা যায়; ১৩) বানিজ্যিক ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন এলাকায় এখন থেকেই যোগাযোগ করে কমিশন এজেন্টের মাধ্যমে জমির মালিকদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে যাতে এক এলাকার জমিতে পরিকল্পিতভাবে সমজাতের ধান চাষ করে, অন্যথায় অনেক সময় জমিতে হারভেস্টার ডুকানোর জায়গা পাওয়া যায়না ।

বোরো মৌসুমে দেশের প্রায় এক কোটি ১৭ লক্ষ ৫০ হাজার একর জমিতে বোরো ধান চাষ হয়েছে। একটি কম্বাইন হারভেস্টার দিয়ে দিনে ৬-৮ একর জমির ধান কাটা গেলে ও একটি যন্ত্র টানা ২৫ দিন কাজ করলেও মোট আবাদকৃত বোরোর জমির ধান কাটতে ছোট বড় মিলিয়ে অন্তত পয়ষট্টি হাজারটি কম্বাইন প্রয়োজন। সরকার এবছরে মাত্র ১৩০০ টি কম্বাইন হারভেস্টার উন্নয়ন সহায়তার মাধ্যমে সরবরাহ করছে যা প্রয়োজনের তুলনায় শতকরা দুই ভাগেরও কম। কিন্তু সুখের কথা হলো এই অল্প সহায়তাতেই কম্বাইন হারভেস্টার বিক্রেতা, ক্রেতা ও ব্যবহারকারীদের মধ্যে একটি যোগসূত্র তৈরি হচ্ছে ও কর্মচঞ্চলতা আসছে। এর ফলে নতুন নতুন কৃষকের মধ্যে কম্বাইন হারভেস্টার ক্রয়ের আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে, স্থানীয় পর্যায়ে যন্ত্র চালকের কর্মক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে, যন্ত্র মেরামতের জন্য মেকানিক সেবার সুযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে যা নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করবে। স্পেয়ার বিক্রির জন্য বাজার তৈরি হচ্ছে যার ফলে নতুন ব্যবসার ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে।

এছাড়া ল্ইাট ইঞ্জিনিয়ারিং সেক্টরে স্থানীয় পর্যায়ে স্পেয়ার পার্টস তৈরির উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে। উন্নত দেশের কৃষি যান্ত্রিকীকরনের অভিজ্ঞতাও এই বলে যে, কম্বাইন হারভেস্টারের মত যন্ত্র অভিযোজনের জন্য প্রথম দিকে সরকারি বিনিয়োগ প্রাইভেট সেক্টরের বিনিয়োগের তুলনায় বেশি থাকবে এবং ক্রমান্বয়ে প্রাইভেট সেক্টরের বিনিয়োগ বাড়বে ও সরকারী বিনিয়োগ কমবে। আমাদের দেশে সরকারের এই উন্নয়ন সহায়তা ও তার ইতিবাচক প্রভাব কম্বাইন হারভেস্টার ভিত্তিক যান্ত্রিকীকরনের পথে সঠিক অগ্রযাত্রার ইঙ্গিত বহন করছে। চালক, মালিক, মেকানিক ও সরবরাহকারীদের যথাযথ দায়িত্ব পালন ও অন্যান্য সীমাবদ্ধতা দুর করা গেলে দীর্ঘমেয়াদে কৃষি যান্ত্রিকীকরনের সুফল ঘরে তোলা যাবে। অন্যান্য সেক্টরের মত কৃষি সেক্টরও উন্নয়নের মহাসড়কে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাবে।

লেখক: উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, এফএমপি ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর।

This post has already been read 7304 times!

Check Also

খামারীদের টাকা নিয়ে প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার নয়-ছয়ের অভিযোগ!

মো. মাহফুজুর রহমান (চাঁদপুর সংবাদদাতা) : চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ ও উত্তরে ১৬০ জন খামারীর প্রত্যেকের …