Thursday 28th of March 2024
Home / তারকা কৃষক / এক সময়ের রিকশাচালক, এখন তিনি সফল কৃষক

এক সময়ের রিকশাচালক, এখন তিনি সফল কৃষক

Published at অক্টোবর ২৫, ২০১৮

মাহফুজুর রহমান (চাঁদপুর প্রতিনিধি): চাঁদপুর জেলা বাংলাদেশের এক বৈচিত্র্যময় কৃষিসমৃদ্ধ অঞ্চল। এ জেলার মতলব উত্তর উপজেলা শাকসবজি চাষের প্রধান এলাকা হিসেবে পরিচিত। কৃষি খাতে অসামান্য অবদান রাখায় বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার-১৪২০ স্বর্ণপদকে ভূষিত হয়েছিলেন এ উপজেলারই একজন কৃষি কর্মকর্তা।

কৃষক-কৃষানীর সংস্পর্শে সোনালী মাটিতে রুপালি ফসল উপজেলার প্রায় অনেক কর্মহীন, ভূমিহীন, বেকার যুবক যুবতীর জীবনও বদলে দিয়েছে। এমনই একজনের বদলে যাওয়া জীবনের গল্প শুনতে গিয়েছিলাম মতলব উত্তর উপজেলার ছেংগারচর পৌরসভার ঢালীকান্দি গ্রামে। চলুন তাহলে শুনি এবার তার সংগ্রাম ও সাফল্যের কাহিনী।

অভাব,অনটন আর কষ্টে ভরা সংসারের এক বীরযোদ্ধা হাসান ঢালী। একমাত্র ছেলে আর মেয়েকে নিয়ে তার ছোট পরিবার। সংসার ছোট হলেও ঠিকমতো চালাতে তাকে হিমশিম খেতে হয় নিত্যদিনই। চাল থাকলে ডাল নেই, কখনো নুন নেই বা তেল নেই।

আমাদের দেশে এ রকম একটা পরিবার চালাতে কর্তার শ্রম বিক্রি ছাড়া আর কি ই বা করার থাকে। এটা ২০০৭-২০০৮ সনের কথা। অভাবের তাড়নায় হাসান তখন রিক্সা চালানো বেছে নেয়।সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে, দিনশেষে একরাশ ক্লান্তি নিয়ে বাড়ি ফেরে হাসান, সংসারধর্ম যে পালন করতে হবে তাকে! পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য নিত্যদিনই তাকে জীবনের সাথে যুদ্ধ করতে হয়। রিক্সা ঘুরবে তো জীবনের চাকা ঘুরবে, আর না হয় থেমে যাবে, কিন্তু এভাবে আর কতদিন? তবুও কোন বিকল্প পথ না পেয়ে, হাজারো প্রতিবন্ধকতা নিয়ে রিক্সা নিয়ে বের হতে হয় তাকে। কখনো রোদ, কখনো বৃষ্টি কিংবা অসুখ-বিসুখ কিছুই থামাতে পারেনা হাসানের রিক্সার প্যাডেল।

জীবনের ঐ পর্যায়ে আত্মীয়-স্বজন বিদেশ যাওয়ার জন্য পরামর্শ দেয় তাকে। কিন্তু এ বিষয়টি নিয়ে সম্পূর্ণ বিরোধিতা আছে তার। সে দেশের বাহিরে যাবে না, দেশের মাটিতেই যেকোনো কাজ নিয়ে বেঁচে থাকবে। সংসারকে আগলে নিয়ে আমৃত্যু বেঁচে থাকার দৃঢ় সংকল্প ছিল তার মাঝে।

তার মতোই খেঁটে খাওয়া মানুষজন সেসময় অন্য এলাকায় গিয়ে কৃষি জমিতে কাজ করে (বদলি দিয়ে) জীবিকা নির্বাহ করতো। হঠাৎ’ই একদিন সে চিন্তা করতে লাগলো, জমি তো আমাদেরও আছে তাহলে আমি বসে থাকবো কেন? মাটিকেই আপন করে বেঁছে নেয় কৃষিকে। মাটি আঁকড়ে নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে নেয়। তার এলাকায় তখন কৃষিতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিল সিদ্দিক ঢালী, মোহাম্মদ আলী ঢালী, ইব্রাহীম শিকদার। তাদের পরামর্শ ও দিক নির্দেশনায় বীজ নিয়ে নিজ জমিতে শুরু করে শীম চাষ। শুরুতে অনেক প্রতিবন্ধকতা থাকলেও ধীরে ধীরে কৃষি আর মাটির সাথে মিশতে থাকে সে। মাটিকে আপন করে এগুতে থাকে তার পথচলা।

সফল কৃষক হাসান ঢালীর সাথে প্রতিবেদক।

মাটি আর কৃষিকে নিয়ে হাসান ঢালীর আত্মসাধনার এখন ১০ টি বছর পেরিয়ে। হাসান এখন আর রিক্সা চালায় না। সংসারও খুব ভালোভাবে চলছে তার। অভাব-অনটন এখন আর তাকে ছুঁতে পারে না। স্বপ্ন তার এখন আকাশছোঁয়া। ছেলে-মেয়েকেও ঠিকমত পড়ালেখা করাচ্ছে। একমাত্র ছেলে নুরন্নবী এবার এস.এস.সি দিবে। ছেলে তার একদিন অনেক বড় চাকরী করবে, মানুষের মতো মানুষ হবে এটাই এখন তার একমাত্র স্বপ্ন। “নুরন্নবী তার পথচলার একজন যোদ্ধা” বলেই জানালেন হাসান ঢালী। ছেলে  ও পরিবার থেকে অনেক সাহায্য ও প্রেরণা পেয়েছেন তিনি, যার দরুন সে আজ, সাফল্যের এ অবধি পৌছতে পেরেছে।

পৈত্রিক ২০ শতাংশ জমিতে চাষাবাদ শুরু করে হাসান। গোটা বছরই কোনো না কোনো সবজি চাষে, ভরপুর থাকে তার জমি। তবে এক্ষেত্রে শীম চাষ ই মুখ্য চাষ হিসেবে বিবেচিত। আষাঢ়-শ্রাবনের শুরুর দিক থেকেই বীজতলাসহ সবকিছু প্রস্তুতি নিয়ে বীজ রোপন করা লাগে। প্রায় ৮ মাস সময় লাগে তার সিম পাওয়ার জন্য। কার্তিক মাসের প্রথমদিকে ফুল আসতে শুরু করে এবং শেষদিকে আংশিক সিম তুলে বিক্রিও করা যায় বলে জানান তিনি। সম্পূর্ণ জমিতে তার প্রায় ১৫ টির মতো ঝারের ব্যবস্থা আছে।

স্থানীয়ভাবে যে নামে পরিচিত-পুইট্টা শিম ও নল্ডক (লম্বা) জাতের দু’ধরনের শীম চাষের কথা জানালেন হাসান ঢালী। তিনি জানান, জমি তৈরি, সার, কীটনাশক, ইত্যাদি উৎপাদন খরচ বাবদ তার জমিতে খরচ হয় ১০-১৫ হাজার টাকা এবং এ হিসেবে শিম বিক্রয় হয় ১০০-১৫০ টাকা দরে এবং গড়ে তার জমিতে ৩৫-৪০ হাজার টাকা নীট লাভ হয়।

গত বছরও তিনি এই দুই জাতের শিম আবাদ করেছিলেন এবং খুব ভালো দামই পেয়েছিলেন তিনি। খুব আনন্দ ও উৎসাহ সহকারে জানান, পুঁটি জাতীয় শিম গতবছর ২০০ টাকা পাইকারী দরেই বিক্রি করেছেন। পুঁটি জাতের শিমের ফলন কম হয় তবে রোগবালাই বেশি হয় বলে পরিচর্যা বেশি করা লাগে। নল্ডক (লম্বা) শিম আকারে বড় এবং সবুজ রঙের এবং পুটি শিম সাদা রঙের ও আকারে ছোট। নল্ডক (লম্বা) শিমের ফলন কম হলেও গ্রাহক চাহিদা এবং দাম বেশি বলে তিনি জানান।

কিভাবে কোথায় শিম বিক্রি করেন? এর জবাবে তিনি বলেন (আঞ্চলিক ভাষায়), “পাইকাররা আমার লগে আইসা দেহা করে, আর নাইলে ক্ষেতে আইসা দর-দাম মুলাইয়া কিন্না নিয়া যায়”। “আর মাঝে মাাঝে আমরা বাপ-পোলায় হাটেও নিয়া যাই”।

তিনি খুব উৎসাহিত হয়ে জানান (আঞ্চলিক ভাষায়), মিছা কতা কইয়া লাভ নাই, আল্লাহ অনেক ভালা রাখছে । কৃষিই আমগোরে বাঁচায়ে রাখছে । আগেরত্তন এহন অনেক ভালা আছি। আগে আমাগো এলাকার মাইনষ্যে অন্য এলাকায় কাম করতে যাইতো । এহন সবাই নিজের জমিতে চাষবাস করে। বিদেশ না যাইয়াও, দেশের মাটিতে অনেক কিছু করন যায়, আমি দেখাইয়া দিছি।

তিনি খুব গর্বের সাথে জানান, শীম ক্ষেতি কইরা ২ টা গরু কিনছি, ঘাস আনতে আরেক্ষানো যাওন লাগে না, নিজের জমির ঘাস দিয়াই গরু পালি । এহন অনেকগুলা গরু আমার, সাথে হাস-মুরগিও পালতাছি। অনেক ভালা আছি আল্লাহর রহমতে।

আসলে লেখাপড়া না জানা মানুষের এই সমাজে ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য কোনো চাকুরি নাই। ছোট-খাটো ব্যবসা আর শ্রম বিক্রি বা দিন মজুরি ছাড়া উপায় থাকে না। কিন্তু হাসান ঢালী এসব পথে না যেয়ে আমাদের মাটিকে আপন করে কৃষির মাঝেই বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজেছেন এবং তিনি সফল হয়েছেন। অন্যের জমিতে কাজে না গিয়ে নিজের জমিতে চাষাবাদ করে তিনি আজ স্বাবলম্বী ।

হাসান ঢালী পৌছে গেছে সাফল্যের গন্তব্যে। মাটি আর কৃষি তাকে স্বাবলম্বী করেছে। অভাব দূর হয়েছে, ফুটেছে নতুন আলো। ছোট্ট সংসারের ছোট ছোট আশা পূরণের স্বপ্ন বীজ বুনেছেন মনে, ছেলে-মেয়েকে অনেক লেখাপড়া করাবেন যতদূর সম্ভব।

অদম্য ইচ্ছা, মনোবল, কর্মস্পৃহা আর পরিশ্রম একজন মানুষকে অনেক বড় কিছু করতে না পারলেও ভালোভাবে বেঁচে থাকার, সমাজের মর্যাদা নিয়ে থাকার রসদ ঠিকই জোগায়। এক সময়ের নিরূপায় হাসান ঢালী এ সমাজের জন্য একজন দৃশ্যমান দৃষ্টান্ত। হাসান ঢালী’রা শুধু নিজেরা একাই এগিয়ে যাবে না; আমি, আপনি, সমাজ ও দেশও তার সাথে এগিয়ে যাবে, এগিয়ে যাক স্বপ্নপূরণের দিকে। মাটি আর মানুষের এই গভীর সম্পর্ক টিকে থাকুক যুগ-যুগ।

This post has already been read 3869 times!