Thursday 2nd of May 2024
Home / পোলট্রি / পোলট্রি শিল্পে নারীদের সম্পৃক্তায়ণ ও উন্নয়ন

পোলট্রি শিল্পে নারীদের সম্পৃক্তায়ণ ও উন্নয়ন

Published at অক্টোবর ১৭, ২০১৮

মো. খোরশেদ আলম জুয়েল

প্রতীকী ছবি

দৃশ্যপট-১
ঢাকার কেরাণীগঞ্জ উপজেলার আকছাইল গ্রামের আয়েশা খাতুন। দু’সন্তানের জননী। বিয়ের তিন বছরের মাথায় স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে চলে যান। সংসারে তার নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। ছোট ছোট দুটো ছেলে মেয়ে নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তায় পড়ে যান তিনি। ছোটবেলায় পিতা হারিয়েছেন, ভাইয়েরা যে যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত। সংসার খরচ মেটানো এবং সন্তানদের ভবিষ্যৎ চিন্তায় এক ধরনের অনিশ্চয়তা ঘিরে ধরে আয়েশা খাতুনকে। কী করবেন কীভাবে চলবেন এমন দুঃশ্চিন্তায় যখন তিনি অস্থির তখন টেলিভিশনে কৃষিবিষয়ক এক অনুষ্ঠানে দেখতে পান পোলট্রি ফার্ম করে স্বাবলম্বী হওয়ার প্রামাণ্য চিত্র। আয়েশা সিদ্ধান্ত নেন পৈতৃক সম্পত্তি থেকে পাওয়া পরিত্যক্ত কিছু জায়গায় ছোট আকারে পোলট্রি ফার্ম করবেন। প্রাথমিক অবস্থায় দু’শো লেয়ার মুরগী দিয়ে খামার শুরু করেন। সৌভাগ্যবশত প্রথম ব্যাচেই কিছু লাভের মুখ দেখেন। এরপর আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে খামারের আয়তন ও মুরগির সংখ্যা। এখন তাঁর খামারে রয়েছে প্রায় দু’হাজার লেয়ার মুরগী। ছেলে আরিয়ান এবং মেয়ে স্থানীয় এক কিন্ডারগার্টেনে এখন ক্লাশ ওয়ানে পড়ে। আয়েশা টিনের ঘরকে পাকা করেছেন, ঘরে রয়েছে টিভি, ফ্রিজসহ প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র। সন্তানদের লেখাপড়া, সংসার খরচ চালানোর পরও তিনি বাড়তি কিছু টাকা ব্যাংকে ডিপিএস করেন।

দৃশ্যপট -২
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার বিনোদপুর টিপাপাড়া এলাকার আদিবাসী শিল্পীরানী। এসএসসি পাস করেছেন। মেধাবী হলেও অভাবের সংসার তাই লেখাপড়া বেশিদূর এগোতে পারেনি। চাকুরির জন্য ঘুরেছেন দ্বারে দ্বারে। ভালো চাকুরির জন্য উচ্চশিক্ষা এবং খুঁটির জোর কোনটিই নেই তার। এক সময় হতাশ হয়ে পড়েন। সে সময় স্থানীয় এক বান্ধবী যিনি যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে চাকুরি করেন তার মাধ্যমে জানতে পারেন, পোলট্রি ফার্ম এবং এ ব্যাপারে যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রয়োজনীয় কারিগরী ট্রেনিং সম্পর্কে। সিদ্ধান্ত নেন চাকুরি নামক সোনার হরিনের পেছনে ছুটবেননা আর; নিজেই কিছু করবেন এবার। ছাত্র জীবনে মাটির ব্যাংকে জমানো কিছু টাকা দিয়ে যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ট্রেনিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় খরচ চালাতে থাকেন। প্রশিক্ষণ শেষে পরিচিতজন এবং এনজিও’র কাছ থেকে কিছু ঋণ নিয়ে শুরু করেন তিনশ’ বাচ্চা দিয়ে ব্রয়লার খামার। খামার সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কারিগরী জ্ঞান থাকায় শিল্পীরানীকে তেমন একটা সমস্যায় পড়তে হয়নি। এখন তার খামারে দুটো শেড। একটিতে দু’হাজার ব্রয়লার এবং অন্যটিতে পাঁচশো’র মতো লেয়ার মুরগী রয়েছে। বছর দুয়েক আগে বিয়ে হয়েছে শিল্পীর। স্বামী সুইডিশ স্থানীয় বাজারে দোকানদারীর পাশাপাশি শিল্পীর খামারের জন্য বাচ্চা, ফিড, ওষুধ কেনা থেকে শুরু করে ডিম ও মুরগি বিক্রিতে সহায়তা করেন।

প্রেক্ষাপট
উল্লেখিত দুটো দৃশ্যপট হাজারো দৃশ্যপটের খুব সামান্য একটি অংশ। সৃষ্টির আদিপেশা কৃষি। প্রচলিত আছে কৃষি পেশার প্রথম বীজটি বপন শুরু হয়েছিল নারীর হাতে। সময় পাল্টায় সে সাথে পাল্টায় মানুষের জীবনযাপন প্রণালী, পেশাগত বৈচিত্র্য থেকে শুরু করে অনেক কিছুই। এক সময় মানুষ কৃষি বলতে শুধু শস্যজাতীয় ফসলকেই বুঝতো। এখন ধারণা পাল্টেছে। শস্যজাতীয় ফসলের পাশাপাশি হাঁস, মুরগি, মাছ, কোয়েল, গরু, মহিষ প্রভৃতি কৃষির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। নারীরা কেবল পুরুষের আয়ের ওপর চলবে এমন ধারণাও পাল্টাচ্ছে। পড়াশোনা করে চাকুরিই করতে হবে এমন ধারণাটাও আগের মতো নেই। দেশের শীষ১স্থানীয় কয়েকটি পোলট্রি কোম্পানির সহযোগি নেতৃত্বেও রয়েছেন নারী। ফিড ফমু১লেশনের মতো গুরুত্বপূণ জায়গাতেও আছেন তাঁরা। এমনকি স্বতন্ত্র ভেটেরিনারি ক্লিনিক পয১ল্প গড়েছেন এদেশের নারী। পরিবারের ভরণ-পোষণের পাশাপাশি অর্থনৈতিক শক্তিকে চাঙ্গা করছে এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেও নারীরা অনবদ্য ভূমিকা রাখছেন। গ্রামে-গঞ্জে যত পোলট্রি ফাম১ দেখবেন বেশিরভাগের পেছইেন খুটেৎ পাবেন কোন না কোন নারীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পরিশ্রম ও সহযোগিতা। কিন্তু সমস্যার বিষয়টি হলো পেছনের গল্পকে আমরা কেন জানি পেছইেন রাখতে ভালোবাসি, স্বীকৃতির বিষয়টিতে এ সমাজ কেন জানি কৃপন।

অতীত পর্যালোচনায় দেখা যায়, আশি এবং নব্বই দশকের শুরুতে পোলট্রি ছিল আমদানিনির্ভর। প্রাথমিকভাবে সরকার, বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠী এবং এনজিও যেমন- ব্র্যাক, আশা, গ্রামীণ ব্যাংক ইত্যাদি বিভিন্ন পাইলট প্রজেক্টের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র্য নিরসন বিশেষ করে ভূমিহীন এবং অসহায় দুঃস্থ নারীদের স্বাবলম্বী করে তোলার তাগিদে পোলট্রি পাইলট প্রজেক্ট হাতে নেয়। প্রায় পঁচিশ হাজার কোটি টাকার পোলট্রি শিল্পের বর্তমানের বিনিয়োগের শুরুটাই হয়েছিল আশির দশকে নারীকেন্দ্রীক উন্নয়ন বিষয়টিকে মাথায় রেখে। তারও আগে ১৯৬৪ সনে ৩০ একর জমির উপর গাজীপুরে প্রতিষ্ঠিত ‘এগ অ্যান্ড হেনস’ কোম্পানির সহযোগী উদ্যোক্তা ছিলেন তৌহিদা বেগম নামক একজন নারী।

আশির দশকে ব্র্যাক ((BRAC) ) এবং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর (DLS) যৌথভাবে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ৩২টি থানার ৫৪টি এলাকা নিয়ে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (FAO) সহায়তায় পোলট্রি পাইলট প্রজেক্ট দাঁড় করায়। উদ্দেশ্য গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা এবং অসহায় ভূমিহীন দরিদ্র নারীদের স্বাবলম্বী করে তোলা। সৌভাগ্যের বিষয় হলো সম্প্রসারিত পাইলট প্রজেক্টগুলো দারুণভাবে সফলও হয় তখন। পরবর্তীতে এসব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকার এবং দাতা সংস্থা (DANIDA, IFAD, ADB) -এর সহায়তায় বিগত পাইলট প্রজেক্টগুলোর মধ্যে তিনটিকে আরো পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত করে ১৯৯২-২০০৩ সন পর্যন্ত সময়ে বৃহৎ আকারে রূপ দান করা হয়। এর ফলে বেসরকারি উদ্যোক্তারা ব্যাপকভাবে এ শিল্পের দিকে ঝুঁকতে থাকেন যার ফলে বর্তমানে একটি বিশাল বিনিয়োগের একটি শিল্পে পরিণত হয়েছে।

পোলট্রি শিল্পে নারীর অংশগ্রহণ
সময়ের আবর্তে বাজারে ক্রমাগত চাহিদার কারণে বর্তমানে পোলট্রি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ শিল্প। অল্প জমি, অল্প মুলধন, চাহিদা বৃদ্ধি এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার কারণে পোলট্রি পালন দেশের অবহেলিত বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র ও দুঃস্থ নারীদের জন্য সম্ভাবনার এক দ্বার খুলে দিয়েছে। বাংলাদেশ পোলট্রি শিল্প সমন্বয় কমিটির তথ্যমতে, এ শিল্পে বর্তমানে ৬০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছে, যার প্রায় ৪০ শতাংশই নারী। গ্রামে-গঞ্জে প্রত্যন্ত অঞ্চলে গড়ে উঠেছে নারী উদ্যোক্তা। পারিবারিক এবং সামাজিকভাবে অবহেলিত নারীদের বৃহৎ একটি অংশ এখন এ শিল্পের সাথে জড়িত। শুধু প্রান্তিক পর্যায়েই নয়, বিশাল পুঁজির নারী উদ্যোক্তারাও এ শিল্পের সাথে এখন ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি বৃহৎ পোলট্রি কোম্পানির খামার ব্যবস্থাপনা, ফিড ফর্মুলেশন, ল্যাব গবেষণা থেকে শুরু করে ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে রয়েছে নারীদের সফল অংশগ্রহণ। পোলট্রি শিল্পে নারীদের সম্পৃক্তায়নের বিষয়ে জানতে চাইলে দেশের পোলট্রি সেক্টরের বৃহৎ কোম্পানি প্যারাগন গ্রæপের পরিচালক ইয়াসমিন রহমান বলেন, অন্যান্য সেক্টরের মতো পোলট্রি সেক্টরেও নারীরা এগিয়ে আসছেন এবং তারা এখানে ভালো করছেন। সৎ চিন্তা ও সাহসী মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসলে পোলট্রি সেক্টরে নারীদের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে এদেশে। পোলট্রি ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে কাজের স্বচ্ছতার ক্ষেত্রেও নারীরা ভালো করছেন। তবে এক্ষেত্রে পরিবারের পুরুষ সদস্যদের আরো বেশি সহযোগিতামূলক মনোভাব দরকার। কারণ আমার স্বামীর সহযোগিতা ছাড়া একার পক্ষে আমার এ পর্যায়ে আসা সম্ভব ছিলনা। এছাড়াও তিনি নিজের কোম্পানিতে আরো বেশি নারী সহকর্মী নিয়োগ এবং শুধুমাত্র নারীদের ব্যবস্থাপনায় পৃথক পোলট্রি ফার্ম গড়ে তোলার স্বপ্নের কথা জানান।

পোলট্রি সেক্টরে দেশের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি কাজী ফার্মস লিমিটেডের দুটো ফার্ম রয়েছে যা সম্পূর্ণ নারীকেন্দ্রীক ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত। পঞ্চগড় জেলার ‘আত্রি পোলট্রি’ এবং রংপুর জেলার তারাগঞ্জ উপজেলার গনিরামপুরে ‘টিএইচএল’ নামক ফার্মে রয়েছে চারটি চারটি করে সর্বমোট ৮টি শেড। প্রায় লাখ খানেক ব্রæড গ্রো লে বা লেয়ার প্যারেন্ট স্টক মুরগী সম্বলিত ফার্ম দুটির সম্পূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন কেবলমাত্র নারী সদস্য। প্রাথমিক অবস্থায় একটি ফার্মের সার্বিক বিষয়ে আশাব্যঞ্জক সফলতার কারণে পরবর্তীতে ধারণাটিকে তারা আরো সম্প্রসারিত করেন। কোম্পানির অন্যান্য ফার্মের তুলনায় উল্লেখিত দুটো ফার্মের উৎপাদন হার তুলনামূলকভাবে বেশি বলে জানা যায়।

শুধু উদ্যোক্তা এবং ব্যবস্থাপনা পর্যায়েই নয়; পোলট্রি সংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষণা পর্যায়েও রয়েছেন তাঁরা। প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ থেকে পোলট্রি সায়েন্সের প্রচুর নারী গ্রাজুয়েট বের হচ্ছেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দেশের পোলট্রি শিল্প উন্নয়নে তারা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন।

পোলট্রি শিল্পে নারীদের সুযোগ ও সম্ভাবনা
লেবার ফোর্স সার্ভে LBS ২০১৬-১৭ অর্থবছরের রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা যায় সামগ্রিকভাবে বিভিন্ন পেশায় নারীদেও অংশগ্রহণ বাড়ছে। এর মধ্যে কৃষিকাজে তাদের অংশগ্রহণ দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর করার উক্ত রিপোর্টে দেখা যায় উল্লেখিত বছরে পুরুষ শ্রমশক্তি যেখানে বেড়েছে ১%, সেখানে নারী শ্রমশক্তি বেড়েছে ৪.৬%। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৫-১৬ অর্থবছরের ত্রৈমাসিক রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা যায় বাংলাদেশ নারী শ্রমশক্তির সর্বাধিক অংশগ্রহণ কৃষিখাতে। উক্ত রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশ কৃষি, বনায়ন ও মৎস্য খাতে ৬৩.১% নারীদের অংশগ্রহণ এবং পুরুষের ৩৪%। রিপোর্টে (২০১৫-১৬ অর্থবছর) আরো উল্লেখ করা হয়, সামগ্রিক এক দশকে নারী শ্রম শক্তির পরিমাণ যেখানে ১০২% বেড়েছে পুরুষের কমেছে সেখানে ২%। অর্থাৎ এটি স্পষ্ট যে, কৃষিতে মোট শ্রমশক্তিতে পুরুষের হার যেখানে কমছে সেখানে নারীদের হার বাড়ছে। তবে এক্ষেত্রে শস্যজাতীয় ফসলের চেয়ে পশু এবং পোলট্রি পালনের প্রতি তাঁদের আগ্রহ বাড়ছে। কৃষি বিশ^বিদ্যালয়গুলোতেও পোলট্রি ও ভেটেনারিসায়েন্স বিভাগে নারীদের সম্পৃক্তা বাড়ছে। দেশের বড় বড় পোলট্রি প্রতিষ্ঠানগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ টেকনিক্যাল পদেও তাঁরা যোগ্যতার প্রমাণ রাখছেন।

ধর্মীয় বিধিনিষেধ, সামাজিক প্রেক্ষাপট, পরিবারের অভিভাবকদের মনমানসিকতা, কৃষ্টি কালচার ইত্যাদি নানা কারণে এদেশে পুরুষের তুলনায় নারীদের ঘরের বাইরে কাজের সুযোগ সীমিত। সেক্ষেত্রে পারিবারিক পর্যায়ে হলেও পোলট্রি ফার্মিং দেশের নারীদের জন্য বিশাল সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে পুষ্টি চাহিদা বৃদ্ধি, স্বল্প পুঁজি, ঘরের অন্যান্য কাজের পাশাপাশি এটি করা অপেক্ষাকৃত সহজ। অপেক্ষাকৃত দরিদ্র এবং অবহেলিত নারীরা অল্প পুঁজি বিনিয়োগে বাড়িতে বাঁশের খাঁচা বানিয়ে ৫০ থেকে দু’শটি মুরগি দিয়ে ব্যবসাটি শুরু করতে পারেন। এর ফলে পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বাড়তি কিছু আয় করা সম্ভব। সৃষ্টিগত এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগত কারণেও নারীরা পুরুষের তুলনায় লালন পালনের কাজটি সূচারুভাবে করতে পারেন। বিশেষ করে মুরগিকে খাওয়ানো, ভ্যাকসিনেশন, ডিম সংগ্রহের মতো কাজগুলোর প্রতি তারা অনেক বেশি যতœশীল। ফার্ম ব্যবস্থাপনাজনিত ব্যয়ের ক্ষেত্রেও মেয়েরা অপচয় কম করেন যে কারণে সামগ্রিক উৎপাদন খরচ সাশ্রয় হয়। তাছাড়া অফিস ফ্যাক্টরি চাকুরি কিংবা দৈনিক মজুরিভিত্তিক কাজে যেখানে দিনের দীর্ঘসময় ঘরের বাইরে থাকতে হয় সেখানে পোলট্রি ফার্মিং বাসস্থানের সাংসারিক কাজে অনেক বেশি সময় পাওয়া যায়।

নারীর ক্ষমতায়নে পোলট্রি একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হতে পারে। কারণ ক্ষমতায়ন এমন একটি প্রক্রিয়া যা একজনের সামর্থ্যকে উন্নত করে এবং এ উন্নতিটা সামাজিক আর্থিক এবং রাজনৈতিক জীবনকে স্বচ্ছল এবং মজবুত করে। ক্ষুদ্র আকারে হলেও পোলট্রি ফার্মিং এক্ষেত্রে একজন নারীকে আর্থিকভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত করতে পারে। তারা এখান থেকে উপার্জিত টাকা পরিবারের বিভিন্ন প্রয়োজনে যেমন- সন্তানদের লেখাপড়া, খাবার, চিকিৎসা, জামাকাপড়, আসবাবপত্র ক্রয় ইত্যাদি কাজে ব্যয় করতে পারেন। শুধু তাই নয়, সংসারের নানা বিপদ আপদ এমনকি স্বামীর প্রয়োজনের সময়ও তিনি তাকে সহযোগিতা করতে পারেন। বাস্তবিক একজন নারী যখন পরিবারের অর্থনৈতিক সহযোগী হয়ে উঠেন তখন সেখানে তার মতামত দেয়ার গুরুত্বও বেড়ে যায়। কারণ ক্ষমতায়নের পূর্বশর্তই হলো আর্থিক স্বচ্ছলতা। তাই পোলট্রি পালন একজন নারীকে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল করার পাশাপাশি তার ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

পোলট্রি শিল্পে নারীদের স্বীকৃতি ও অধিকার
আশির দশক থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত নারীদের কার্যক্রমের ওপর বেশ কয়েকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পর্যালোচনা রিপোর্ট বিশ্লেষণে দেখা যায়, পারিবারিক খামার থেকে শুরু করে বৃহৎ উদ্যোক্তা পর্যায়ে পোলট্রি শিল্পে নারীদের অবদান বাংলাদেশে ব্যাপক ও বিস্তৃত। তবে এসব গবেষণায় আরো একটি বিষয় স্পষ্ট যে, আর্থসামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাদের এসব সম্পৃক্ততা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আড়ালে থেকে যায়। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ে কাজ করা এমন বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলে জানা যায়- পারিবারিক, ছোট এবং মাঝারি আকারের পোলট্রি ফার্ম দেখাশোনার সত্তর শতাংশ কাজই নারীরা করে থাকেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে সাফল্যের স্বীকৃতিতে পুরুষ অর্থাৎ কৃষকের নাম যতটা উচ্চারিত হয় নারী তথা কৃষানির নাম সেভাবে হয়না।

যে কোন পেশার পেশাগত উন্নয়নের জন্য স্বীকৃতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পেশাগত স্বীকৃতি মানুষকে সে পেশার প্রতি আগ্রহী করে তোলে; নয়তো আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। পোলট্রি শিল্প বর্তমানে কৃষির অন্যতম এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ। টেকসই এবং গতিশীল শিল্পের জন্য মানবসম্পদের সঠিক তথ্য উপাত্ত এবং স্বীকৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে এসব নারীদের স্বীকৃতি আনুস্ঠানিকভাবে দেয়া এখন সময়ের দাবী।

সমাপনী
বাস্তব প্রেক্ষাপট, শ্রম শাখার স্থানান্তর, নারীর ক্ষমতায়নে সরকার ও বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠীর আগ্রহ, দক্ষতা এবং সামগ্রিক চিত্র বিবেচনায় এটি স্পষ্ট যে, পোলট্রি শিল্পে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। এদেশে পোলট্রি শিল্পে গোড়াপত্তনেও ছিল তাদের সহযোগিতা ও সম্পৃক্ততা। এমনকি ২০০৭, ২০০৯ এবং ২০১১ সনে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা আক্রমণের ফলে পোলট্রি শিল্প যখন রুগ্ন অবস্থায় পর্যবসিত, শিল্পোদ্যাক্তারা যখন ভ্যাকসিন আমদানিতে অনুমতি পাচ্ছিলেন না তখন এ ব্যাপারে সবচেয়ে সহযোগিতামূলক ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসেন যিনি তিনিও একজন নারী। এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন আমদানিতে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর অবদান দেশের পোলট্রি শিল্পোদ্যোক্তাদের জন্য সবসময়ের জন্য একটি স্মরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজস্ব চিন্তার ফসল ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পটি কাজে লাগিয়ে পোলট্রি শিল্পের প্রতি নারীদের আরো বেশি আগ্রহী ও সম্পৃক্ত করে তোলা যায়। সরকারের এমন একটি মহৎ উদ্যোগকে কাগুজে ফাইল বন্দি করে না রেখে এটিকে সচল করা প্রয়োজন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক পোলট্রি শিল্পের জন্য আলাদাভাবে নারী উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে ঋণের প্যাকেজ নিয়ে আসতে পারে। দেশের পুষ্টি চাহিদার বিপরীতে পোলট্রি উৎপাদনকে আরো বেশি সম্প্রসারিত করার অনেক সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে নারীদের সম্পৃক্ততা এবং কাজের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য দরকার উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, ঋণ সুবিধা, প্রচার, স্বীকৃতি ও সম্মানের মাধ্যমে উৎসাহ প্রদান এবং অন্যান্য কাজে সহযোগিতা করা। সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোক্তা সংগঠনগুলো এক্ষেত্রে সমন্বিত সহযোগিতার মাধ্যমে এটিকে আরো বেশি সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

This post has already been read 6928 times!