Thursday 25th of April 2024
Home / অর্থ-শিল্প-বাণিজ্য / ফলের সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা

ফলের সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা

Published at জুলাই ১৭, ২০১৮

কৃষিবিদ ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম : ফলের বালাই নিয়ন্ত্রণে ফলচাষিরা সাধারণত ক্ষতিকর রাসায়নিক বালাইনাশকের ওপরই বেশি নির্ভর করেন। অন্যান্য ফসলে বালাইনাশকের ব্যবহারে যতটা না জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়, ফলে বালাইনাশক ব্যবহারে ক্ষতি হয় তার চেয়ে অনেক বেশি। কেননা, ফল আমরা সরাসরি গাছ থেকে পেড়ে কাচা ও পাকা খাই, কোনো রান্না বা প্রক্রিয়াজাত করার প্রয়োজন হয় না। তাই রাসায়নিক বালাইনাশক সরাসরি আমাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে। এজন্য অন্য ফসলের আগে ফলের সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা করা বেশি দরকার। কিন্তু ফলের সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা যেমন জটিল তেমনি গবেষণা উদ্ভাবিত তথ্যের অভাব রয়েছে। ফলের আছে শত রকমের বালাই। ফলের সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার বিষয়টিও সেজন্য খুব সহজ নয়। বিভিন্ন ফলের বালাই সুনির্দিষ্ট, কিছু নির্দিষ্ট বালাই আবার একাধিক ফলে আক্রমণ করে। সেজন্য ফলের সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার কিছু সাধারণ নীতি অনুসরণ করলে বালাইমুক্ত ফল উৎপাদন করা খুব কঠিন নয়। তবুও এগিয়ে যেতে হবে।

সমন্বি বালাই ব্যবস্থাপনার ম্যাধমে আমরা সুস্থ সবল উৎপাদন; ফসলের উৎপাদন খরচ কমানো; পরিবেশ দুষণমুক্ত ফসল উৎপাদন; বালাইনাশকের ব্যবহার বন্ধ বা কমানো; জমিতে বন্ধুজীবের সংখ্যা বাড়ানো; বালাই ব্যবস্থাপনার খরচ তথা ফলের উৎপাদন খরচ কমানো; বালাই ব্যবস্থাপনায় কৃষকের দক্ষতা বাড়ানো; কৃষকের স্বাস্থ্য ভালো রাখা; কৃষকের অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে লাভবান হতে পারি। বাংলাদেশে প্রচলিত ও বহুল ব্যবহৃত আইপিএম এর প্রধান ৫টি উপাদান বা কৌশল হলো-

১. বালাই সহনশীল জাতের ফল চাষ
এটি সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার একটি উপাদান কিন্তু ফলের ক্ষেত্রে এ উপাদানের কার্যকারিতা কম। কেননা, এ দেশে ফলের যতো জাত উদ্ভাবিত হয়েছে সেসব জাতের বালাই সহনশীলতা বা প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পর্কিত তথ্য খুব বেশি নেই। তবু যা আছে তার ভিত্তিতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যায়। বিশেষ করে কোনো এলাকায় যদি কোনো নির্দিষ্ট বালাইয়ের আক্রমণ নিয়মিতভাবে প্রতি বা মৌসুমে ঘটতে থাকে তাহলে নতুন বাগান করার ক্ষেত্রে সে বালাই প্রতিরোধী জাতের চারা বা কলম সংগ্রহ করে তা লাগাতে হবে। যেমন- অ্যানথ্রাকনোজ রোগ প্রতিরোধী জাতের পেয়ারা চাষ করে বাউ পেয়ারা ১, বাউ পেয়ারা ২, বাউ পেয়ারা ৩, মুকুন্দপুরী ও কাঞ্চননগর জাতে এ রোগের আক্রমণ কম হয়। অন্য দিকে স্বরূপকাঠি ও কাজী পেয়ারাতে এ রোগ বেশি হয়।

২. জৈবিক পদ্ধতিতে ফলের বালাই নিয়ন্ত্রণ
এটা হলো সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মূল ভিত্তি। প্রকৃতিতেই বালাই নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রয়েছে। শুধু সেসব ব্যবস্থাকে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগানো হলো আমাদের কাজ। এসব প্রাকৃতিক শক্রর কেউ পরভোজী, কেউ পরজীবী আবার কেউবা বালাইয়ের দেহে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু। ফলবাগানে কোনো রাসায়নিক বালাইনাশক প্রয়োগ না করলে এসব উপকারী প্রাকৃতিক শক্রদের সংখ্যা বাড়ে ও প্রকৃতির নিয়মে তারাই বিভিন্নভাবে বালাই নিয়ন্ত্রণ করে। এতে পরিবেশের মধ্যে শক্র মিত্রের ভারসাম্য বজায় থাকে। এজন্য বালাই চাষির কোনো ক্ষতি করতে পারে না। তাই ফলবাগানে এসব বন্ধুজীবদের বাঁচিয়ে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। ফলবাগানে প্রধানত যেসব বন্ধু পোকামাকড় দেখা যায় সেগুলো হলো লেডিবার্ড বিটল, ইয়ার উইগ, প্রিডাসিয়াস মিজ, সিরফিড মাছি, অ্যানথ্রোকোরিড বাগ, মুলিয়েন বাগ, বোলতা, কোটেশিয়া বোলতা, পরভোজী মাকড় ইত্যাদি।

৩. আধুনিক প্রযুক্তিতে ফল চাষ
ফল চাষের যতো ভালো উন্নত প্রযুক্তি আছে সব মেনে ফল চাষ করাই হলো আধুনিক নিয়মে ফল চাষ। এতে সুস্থ সবল গাছ হয়, গাছের বৃদ্ধি ও তেজ ভালো থাকে। এসব গাছ প্রাকৃতিকভাবে অনেক বালাই প্রতিরোধ করতে পারে। এজন্য ফলগাছের উন্নত চাষাবাদ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে যা করা দরকার তা হলো- এলাকার উপযোগী উন্নত জাতের ফলগাছ লাগানো; সঠিকভাবে, সঠিক সময়ে ও সঠিক মাত্রায় সার দেয়া। অতিরিক্ত ইউরিয়া সার ফলগাছে না দেয়া; আগাছা ও পানি ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করা; নিয়মিত গাছ ছাঁটাই করা; আক্রান্ত ফল ও গাছের আক্রান্ত অংশ সংগ্রহ করে ধ্বংস করা।

৪. যান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা
ফলের বালাই নিয়ন্ত্রণে হাত বা যে কোনো যন্ত্রের ব্যবহারই হলো যান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা। এর মাধ্যমে বালাইসমূহ বিতাড়িত হয়, মরে যায় অথচ উপকারী জীবের কোনো ক্ষতি হয় না। যান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে যেসব বিষয়াদি বিবেচনা করতে হবে তাহলো- ফলের মাছি পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য সেক্স ফেরোমোন ফাঁদ বা বিষটোপ ফাঁদ ব্যবহার; কাইরোমোন ফাঁদ ব্যবহার করা; গাছ যখন দুর্বল বা আঘাতপ্রাপ্ত হয় তখন তা থেকে কাইরোমোন নি:সৃত হয় যা অনেক পোকাকে আকৃষ্ট করে। কৃত্রিমভাবে এরূপ কাইরোমোন ব্যবহার করে ফাঁদ তৈরি করে পোকাদের আকৃষ্ট ও ফাঁদে আটকে মারা যায়; আলোক ফাঁদ ব্যবহার করা; বর্ণফাঁদ ব্যবহার করা; ইঁদুরের কল বা ফাঁদ ব্যবহার করা; গাছের তলার মাটি চষে দেয়া; পাখি ও বাদুড় তাড়ানোর জন্য আওয়াজ সৃষ্টিকারী টিন/যন্ত্রের ব্যবস্থা করা; বিভিন্ন ব্যাগ দিয়ে ফল ঢেকে দেয়া; মালচিং করা; করাত বা দা দিয়ে কেটে আক্রান্ত অংশ সরিয়ে ফেলা।

৫. রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা
রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা হলো রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে বালাই নিয়ন্ত্রণ। বর্তমানে বিভিন্ন জৈব ও জৈব রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হচ্ছে। রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে যেসব বিষয়াদি বিবেচনা করা যায় তাহলো- মরিচের গুঁড়া, আদা ও রসুনের রস এসব। জৈব পদার্থসমূহ স্প্রে করে বিভিন্ন পোকাকে বিতাড়িত করা যায়; এসিটিক এসিড, লবঙ্গের তেল, ফ্যাটি এসিড প্রভৃতি স্প্রে করা; সালফার ও চুন প্রয়োগ করা; বোর্দো মিশ্রণ প্রয়োগ করা; ট্রাইকোডার্মা বা ট্রাইকো কম্পোস্ট ব্যবহার করা।

সর্বশেষ ব্যবস্থা হিসেবে বুদ্ধিমত্তার সাথে বালাইনাশক ব্যবহার করা। যে কোনো বালাইনাশক ব্যবহারে আগে তার ব্যবহারের নির্দেশনা পড়ে নিতে হবে। বালাইনাশক সাধারণত কারখানায় তৈরি করা কৃত্রিম রাসায়নিক দ্রব্য। এছাড়া প্রাকৃতিক বা জৈবিক বালাইনাশক ও আছে। জৈবিক বা প্রাকৃতিক বালাইনাশক ব্যবহারে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কিছু বালাইনাশকের কার্যকারিতা ব্যাপক, একই বালাইনাশক বহু রকমের বালাইকে মেরে ফেলতে পারে। কিছু বালাইনাশকের কার্যকারিতা পোষক বা বালাই সুনির্দিষ্ট। নির্দিষ্ট বালাইকে তারা মারতে পারে। এরূপ বালাইনাশক ব্যবহারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কিছু বালাইনাশকের অবশেষ ক্রিয়া দ্রুত শেষ হয়ে যায় (যেমন বিটি)। কিছু বালাইনাশকের (ডিডিটি) অবশেষ ক্রিয়া থাকে অনেকদিন। স্বল্প অবশেষ ক্রিয়া সম্পন্ন বালাইনাশক ব্যবহার করতে হবে। ফলে কোনো তীব্র বিষাক্ত বালাইনাশক ব্যবহার করা যাবে না। রাসায়নিকের চেয়ে জৈব বালাইনাশক ব্যবহারে অধিক আগ্রহী হতে হবে। তবে বালাইনাশক ব্যবহার করতে হলে অবশ্যই সঠিক বালাইনাশক, সঠিক সময়ে, সঠিক প্রদ্ধতিতে, সঠিক মাত্রায় প্রযোগ করতে হবে। তা না হলে ফল ভালো আসবেনা।

আমাদের ফলভান্ডারে একশত ৩০টি বেশি ফল আছে। এর মধ্যে ৭০টি বেশ প্রচলিত। আর ১০/১২টি খুব বেশি প্রচলিত। ১২ মাসের সব সময় সামনভাবে ফল আসে না। মোট ফলের মধ্যে জানুয়ারিতে ৫%, ফেব্রুয়ারিতে ৫%, মার্চ ৭%, এপ্রিলে ৭% এ ৪ মাসে ২৪%, মে ১৩%, জুন ১৪% জুলাই ১৫% আগস্ট ১২% এর ৪ মাসে ৫৪%, সেপ্টেম্বর ৫% অক্টোবর ৫% নভেম্বর ৬% ডিসেম্বর ৬% এ ৪ মাস মিলে ২২% ফল পাওয়া যায়। সুতরাং ফলের বালাই ব্যবস্থাপনাও এ তথ্যভিত্তিক হলে এবং এভাবেই হিসেব করে বাস্তবায়ন করতে হবে। তবেই কাজের কাজ হবে। ফল সমৃদ্ধ আয়েশি ভা-ার থেকে আমরা আমাদের চাহিদা অনুযায়ী ফল খাবো, বাড়তি ফল বিদেশে রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশকে কৃষিতে সমৃদ্ধ করবো।

লেখক: উপপরিচালক (গণযোগাযোগ), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫

This post has already been read 3847 times!