Thursday 25th of April 2024
Home / পোলট্রি / বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্পের জন্য কর অব্যাহতি সুবিধা যৌক্তিকতা কোথায়

বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্পের জন্য কর অব্যাহতি সুবিধা যৌক্তিকতা কোথায়

Published at জুন ৯, ২০১৮

মো. সাজ্জাদ হোসেন : মানুষের খাদ্যের মূল উপাদানসমূহের মধ্যে আমিষ অন্যতম, তারমধ্যেও প্রাণিজ আমিষ বিশেষ ভ‚মিকার দাবিদার এবং এই প্রাণিজ আমিষের প্রধানতম উৎস পোল্ট্রি ডিম ও মাংস এবং এটি সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী। বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের লক্ষ্যে ঘোষিত এসডিজি এর ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে ‘লক্ষ্য-২’ সরাসরি এবং সর্বমোট প্রায় ১৪টি লক্ষ্যের সাথে কোনো না কোনোভাবে পোল্ট্রি সেক্টরের সম্পৃক্ততা রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও পোল্ট্রিখাত উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে। বর্তমানে জিডিপি’তে পোল্ট্রি শিল্পের অবদান ২ শতাংশের ওপরে। এ খাতে ৩০ হাজার কোটি টাকারও অধিক বিনিয়োগ হয়েছে। বার্ষিক টার্নওভার ৩৫-৪০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ২৫ লাখ এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৬০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে- যার প্রায় ৪০ শতাংশই নারী। পোল্ট্রি’র মাধ্যমে গ্রামীণ পর্যায়ে শিক্ষিত ও বেকার যুবক এবং নারীদের কাজের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার কারণে গ্রাম থেকে শহরমুখী মানুষের স্রোত কিছুটা হলেও কমেছে।

বিগত কয়েক বছর থেকেই পোল্ট্রি খামারি, উদ্যোক্তা এবং বিভিন্ন অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দ পোল্ট্রি শিল্প সংশ্লিষ্ট সবগুলো খাতের ওপর থেকে সব ধরনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর তুলে নেয়ার আরজি জানিয়ে আসছেন। খুব স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন হতে পারে তাদের এ দাবির যৌক্তিকতা আসলেই কতোখানি।

এ প্রসঙ্গে বলতে গেলে নানান প্রসঙ্গ আলোচনায় এসে পড়ে। পোল্ট্রি বিশেষজ্ঞ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, পুষ্টিবিদ অনেকেই এ প্রসঙ্গে অনেক জোরালো যুক্তি ইতোমধ্যেই উপস্থাপন করেছেন। তাঁদের সাথে আমি আরও দু’একটি বিষয় যোগ করতে চাচ্ছি। পোল্ট্রি শিল্পের বর্তমান প্রধান দু’টি লক্ষের আলোকে আমি আমার বক্তব্য উপস্থাপন করার চেষ্টা করবো।

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্প প্রধান যে দু’টি লক্ষ্যকে সামনে রেখে অগ্রসর হচ্ছে তা হলো-

১. ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য নিরাপদ ও সাশ্রয়ী মূল্যে ডিম ও মুরগির মাংসের পর্যাপ্ত যোগান নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে জাতীয় লক্ষ্য এবং জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এস.ডি.জি) অর্জনে সরকারকে সহায়তা করা; এবং

২. রপ্তানীমুখী শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন

উপরোল্লিখিত লক্ষ্যসমূহে যে বিষয়গুলোর প্রতি অত্যধিক গুরুত্বারোপ হয়েছে তা হলো-
● নিরাপদ পোল্ট্রি পণ্য উৎপাদন করা
● পোল্ট্রি পণ্যের দাম ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা
● সরকার কর্তৃক নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করা
● অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে সরকারকে সহায়তা করা, এবং
● জাতিসংঘ ঘোষিত ‘এস.ডি.জি ’র লক্ষ্য অর্জনে সরকারকে সহায়তা করা।

নিরাপদ পোল্ট্রি পণ্য উৎপাদন: ক্ষতিকারক উপকরণ ও এ্যান্টিবায়োটিক মুক্ত পোল্ট্রি ফিড, ডিম ও মুরগির মাংস উৎপাদনে দেশীয় পোল্ট্রি শিল্প ইতোমধ্যেই বেশ খানিকটা সফলতা অর্জন করেছে। দেশে এখন নিরাপদ ফিড উৎপাদিত হচ্ছে- কারণ বিগত কয়েক বছর ধরে সরকার পোল্ট্রি ফিডে এ্যান্টিবায়োটিক গ্রোথ প্রমোটারের (এজিপি) ব্যবহার নিষিদ্ধ করে রেখেছেন। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও ভ্রাম্যমান আদালতের সহযোগিতায় অবৈধ এবং নিম্নমানের পোল্ট্রি ও ফিস ফিড উৎপাদনকারি বেশকিছু কারখানার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হয়েছে। সরকারের নজরদারি, সংশ্লিষ্ট অ্যাসোসিয়েশনগুলোর কার্যকরি উদ্যোগ, ভোক্তা সাধারণের সচেতনতা এবং মান-সম্মত পোল্ট্রি পণ্য উৎপাদনে উদ্যোক্তাদের আন্তরিকতার কারণে পোল্ট্রিতে হেভি মেটালের সমস্যা প্রায় শূণ্যের কোঠায় নেমে এসেছে। তবে পোল্ট্রিকে পুরোপুরি নিরাপদ করতে হলে আরও বেশ কিছু বিষয়ে নজর দিতে হবে যেমন- পোল্ট্রি মুরগির মাংস ও ডিমে এ্যান্টিবায়োটিকের মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে।

লক্ষ্যণীয় বিষয়টি হচ্ছে- বিশ্বের সর্বাধিক পোল্ট্রি উৎপাদনকারি দেশ ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনে Critically Important Antibiotics for Human এর ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে মানুষের জন্য ব্যবহৃত হয়না অথচ পোল্ট্রিতে উপকারি এমন এ.জি.পি ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়েছে। ফলে ঐ দেশগুলোতে থেরাপিউটিক লেবেলে এন্টিবায়োটিকের রেসিডিউ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভবপর হয়েছে। কাজেই বাংলাদেশ সরকারকেও বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। কারণ আমাদের আবহাওয়া ও জলবায়ু, জনসংখ্যার ঘনত্ব, জমির স্বল্পতা প্রভৃতি বিষয়গুলো বিবেচনা করলে গড়পড়তাভাবে সব ধরনের এ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা কোন সমাধান আনতে পারবে না বলেই মনে হয়। কারণ এর ফলে একদিকে যেমন গোপনে নিম্নমানের ও ক্ষতিকারক এ.জি.পি ব্যবহারের প্রবণতা বাড়বে অন্যদিকে তেমনি উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যাবে।

একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে- আমাদের দেশে পোল্ট্রি ফিডে এজিপি’র ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও ওয়াটার সলিউবল এজিপি’র ব্যবহারে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। ফলে পানিতে এজিপি’র ব্যবহার বেড়েছে। শুধু তাই নয় অনেক নিম্নমানের এ.জি.পিও ব্যবহৃত হচ্ছে। আর এ ধরনের অকার্যকর এ.জি.পি ব্যবহারে কাঙ্খিত ফল না আসায় অনেক খামারিই মানুষের জন্য প্রেসক্রাইবড এ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ আছে। তাই ঢালাওভাবে এ.জি.পি নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি না করে বরং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফ.এ.ও) কর্তৃক অনুমোদিত উপকারি এ.জি.পি ব্যবহারের প্রদান করা জরুরী বলেই মনে হয়। একই সাথে Critically Important Antibiotics for Human এর ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বন্ধের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও গ্রহণ করতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের কারণে পোল্ট্রিতে হাইলি প্যাথজেনিক এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের ভ্যাকসিন ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়েছে কিন্তু লো-প্যাথজেনিক এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের (LPAI) ভ্যাকসিন ব্যবহারের অনুমতি নেই। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে লো-প্যাথজেনিক ভাইরাসে খামারিরা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছেন। তাই সময়ক্ষেপন না করে খচঅও ভ্যাকসিন আমদানির অনুমতি দেয়াটাও জরুরি। একই সাথে দেশীয়ভাবে এই ভ্যাকসিন উৎপাদনের অনুমতি প্রদান করতে হবে। আর এজন্য মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে Directorate General of Drug Administration বরাবরে একটি চিঠি দিতে হবে যেন তারা বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনায় প্রয়োজনীয় ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

পোল্ট্রি পণ্যের দাম ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার চ্যালেঞ্জ: উৎপাদন খরচ বাড়লে পণ্যের দাম বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। তাই সবার আগে উৎপাদন খরচ কমাতে হবে। কিন্তু কিভাবে? পোল্ট্রি’তে ব্যবহৃত কাঁচামালের সিংহভাগ এখনও আমদানি-নির্ভর। এখানে বিশেষভাবে ভূট্টা এবং সয়াবিন মিলের প্রসঙ্গ উল্লেখ করছি এ কারণে যে পোল্ট্রি ফিডের প্রায় ৫৫-৬০ ভাগই হচ্ছে ভূট্টা এবং ২০-২৫ শতাংশ সয়াবিন মিল। দেশে ভূট্টা উৎপাদিত হয় চাহিদার মাত্র ৪৫ শতাংশ, সয়াবিন উৎপাদিত হয়না বললেই চলে। ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে ভূট্টাসহ পোল্ট্রি ফিডে ব্যবহৃত বেশকিছু অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ আমদানিতে ৫ শতাংশ হারে অগ্রিম আয়কর ধার্য্য করা হয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সয়াবিন মিল আমদানির ওপর রেগুলেটরি ডিউটি শূণ্য থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা ১০ শতাংশ করা হয়েছে। ভেজিটেবল প্রোটিন হিসেবে ব্যবহৃত DDGS আমদানিতে ১৫ শতাংশ হারে মূল্য সংযোজন কর আরোপ করা হয়েছে।

এছাড়াও Limestone, Lysine, Fish Oil, Di-Calcium Phosphate, Methionine, Ronozyme, Full Fat Soya, Mono-Calcium Phosphate, Choline Chloride, Poultry Vaccine, L-Threonine, Enzyme, Sodium Bi-carbonate, Soya Protein Concentrate প্রভৃতি কাঁচামাল আমদানিতে ৫ শতাংশ হারে এআইটি আরোপ করা হয়েছে।

এইচ.এস কোড জটিলতা: এইচ.এস কোড জটিলতার কারণে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ প্রায়শই শুল্কমুক্ত পণ্যের উপরেও উচ্চহারে শুল্ক, ভ্যাট, এআইটি, এটিভিসহ অন্যান্য কর আদায় করছেন।

আয়কর বেড়েছে: ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে কর অব্যাহতি প্রাপ্ত এই খাতে ৩ শতাংশ হারে এবং ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সর্বোচ্চ আয়কর ১৫ শতাংশ ধার্য্য করা হয়েছে।

বাড়তি পরিবহন খরচ: পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণেও উৎপাদন খরচের ওপরও চাপ বাড়ছে। একটি লরিতে ১২ টনের ওপরে পণ্য পরিবহনে সরকারি বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে অথচ তার ধারণ ক্ষমতা ২০ টন। কাজেই দেখা যাচ্ছে প্রতি ১০০ টন পণ্য পরিবহনে প্রায় ৪টি গাড়ির বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছে।

আমদানি খরচ অত্যাধিক: আমদানি পর্যায়েও একই অবস্থা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- বাংলাদেশের বন্দরে যেখানে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ২,৫০০ টন শষ্য আনলোড করা যায়, সেখানে ভিয়েতনামে করা যায় ৮,০০০ টন। অর্থাৎ ৫২ হাজার টনের একটি কনসাইনমেন্ট অনলোড করতে ভিয়েতনামে যেখানে মাত্র ৭ দিন লাগে, সেখানে বাংলাদেশে লাগে ২১ দিন- অতিরিক্ত সময় লাগে প্রায় ১৪দিন। এজন্য রফতানিকারকগণ ভিয়েতনামে যে দামে ভ‚ট্টা বিক্রি করেন, বাংলাদেশে বিক্রি করেন তার চেয়েও অনেক বেশি দামে। ফলে প্রতি টন ভ‚ট্টা আমদানি করতে আমাদেরকে ২০-২৫ ডলার অর্থাৎ ৫২ হাজার টনের একটি কনসাইমেন্টের ক্ষেত্রে ১০ থেকে ১৩ লক্ষ ডলার বা প্রায় ১০ কোটি ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত খরচ গুনতে হচ্ছে। খুব স্বাভাবিক কারণেই এতে ফিডের উৎপাদন খরচ বাড়ছে, একই সাথে বাড়ছে মুরগির মাংস ও ডিমের উৎপাদন খরচ।

সরকার এবং জাতিসংঘ নির্দেশিত লক্ষ্য অর্জন: লাগসই উন্নয়ন অর্জনের স্বার্থে সরকার এবং জাতিসংঘ বেশকিছু লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- ক্ষুধা, দারিদ্র ও বেকারত্ব নিরসন, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি। বলাবাহুল্য এ লক্ষ্য অর্জনে পোল্ট্রি শিল্পের বড় ভ‚মিকা রয়েছে। এস.ডি.জি’র মোট ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে ১৪টির সাথেই পোল্ট্রি শিল্পের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। জিডিপি’তে পোল্ট্রি শিল্পের অবদান প্রায় ২ শতাংশের ওপরে। এখাতে ৩০ হাজার কোটি টাকারও অধিক বিনিয়োগ হয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে কৃষির পর পোল্ট্রি’র অবদানই সবচেয়ে বেশি। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৬০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে এখাতে- যার প্রায় ৪০ ভাগই নারী। পোল্ট্রি শিল্পের অগ্রগতির কারণেই গ্রাম থেকে শহরমুখী মানুষের মাইগ্রেশন কমেছে। যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে এবং আবাদি জমি কমছে তাতে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে, প্রয়োজন হবে ভার্টিক্যাল ইন্টিগ্রেশন- যা কেবলমাত্র পোল্ট্রিতেই সম্ভব। বিগত বছরগুলোতে পুষ্টি ঘাটতি পূরণে পোল্ট্রি’র চাহিদা এবং এর ওপর নির্ভরশীলতা ক্রমেই বেড়েছে। হাউসহোল্ড ইনকাম এন্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভের রিপোর্ট অনুযায়ী- পূর্বের বছরের তুলনায় ২০১৬ সালে বাংলাদেশে দৈনিক মাথাপিছু ফুড কনজাম্পশন কমলেও বেড়েছে মুরগির মাংস ও ডিমের কনজাম্পশন। পূর্বে যেখানে দৈনিক মাথাপিছু ফুড কনজাম্পশন ছিল ১০০৫ গ্রাম, ২০১৬ সালে তা কমে হয়েছে ৯৭৪ গ্রাম। অন্যদিকে মুরগির মাংসের দৈনিক মাথাপিছু কনজাম্পশন ১১.২২ গ্রাম থেকে বেড়ে হয়েছে ১৭.৩৩ গ্রাম। ডিমের কনজাম্পশন ৭.২ গ্রাম থেকে বেড়ে হয়েছে ১৩.৫৮ গ্রাম। প্রাণিজ আমিষের অপরাপর উৎসগুলোর চেয়েও পোল্ট্রি’র কনজাম্পশনে প্রবৃদ্ধি চোখে পড়ার মত। যেখানে গরুর গোশতের কনজাম্পশন ১০% এবং মাছের ২৬% বেড়েছে, সেখানে পোল্ট্রি’র মাংস ও ডিমের কনজাম্পশন বেড়েছে যথাক্রমে ৫৪% এবং ৮৮%। আগামীতে সন্দেহাতীতভাবেই এ পরিমাণ আরও বাড়বে।

পরিবেশবান্ধব পোল্ট্রি শিল্প: পৃথিবীর সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব শিল্প হচ্ছে পোল্ট্রি। সবচেয়ে কম জমির ব্যবহার, সবচেয়ে কম দূষণ, সবচেয়ে কম পানির খরচ, সব ধরনের বর্জ্যই রিসাইকেল হয়। পোল্ট্রি’র বিষ্টা থেকে উৎপাদিত হচ্ছে বায়োগ্যাস, জৈবসার, বিদ্যুৎ। চিকেন ফেদার মিল থেকে উৎপাদিত হচ্ছে বায়োডিজেল, কাগজ, প্লাস্টিক, ফাইবারসহ আরও অনেক পণ্য। বাংলাদেশে বর্তমানে বছরে যে পরিমাণ বিষ্টা উৎপাদিত হচ্ছে তা যদি সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করা যায় তবে তা রিসাইকেল করে প্রচুর পরিমাণ জৈব সার এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব।

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক খামারি: এফ.এ.ও এর একটি গবেষণা প্রতিবেদন মতে- বাংলাদেশের প্রায় ৬৭ শতাংশ খামারই ছোট আকারের। তাই একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে- ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক খামারিরা বাঁচলে বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্প বাঁচবে, গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা সচল থাকবে। সাধারণ খামারিদের জ্ঞান, তথ্য ও অভিজ্ঞতার অভাবকে পুঁজি করে একশ্রেণীর মধ্যস্বত্ত¡ভোগী ব্যবসায়ী ফায়দা লুটছে। ভুল পরামর্শ দিয়ে, অপ্রয়োজনীয় ঔষধ ও ভ্যাকসিন ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে তাদের আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে এমন অভিযোগও বেশ পুরোনো। তাই খামারিদের জন্য দক্ষতাবৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। একটি বিষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে- এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা কিংবা নতুন ধরনের জীবানু’তে আক্রান্ত হলেও ছোট খামারিরা তা রিপোর্ট করছেন না, ফলে জীবানু আশপাশের খামার ও এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। এহেন পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে হলে ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। বিনামূল্যে কিংবা স্বল্পমূল্যে জীবানুনাশক, পানি বিশুদ্ধিকরণ ঔষধ ও ভ্যাকসিন এবং Waste Disposal Technology সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।

ছোট খামারকেও নিবন্ধনের আওতায় আনতে হবে: সরকারি নিয়মে পাঁচশ’র কম মুরগির খামারকে নিবন্ধনের আওতায় আনা হচ্ছেনা। এতে ডিম ও মাংসের উৎপাদন, একদিন বয়সী বাচ্চা ও ফিডের চাহিদা নিরূপন, সর্বোপরি নিরাপদ পোল্ট্রি উৎপাদনের উদ্যোগ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। তাই ৫শ’র কম মুরগির খামারের জন্যও নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করার জরুরি। তাছাড়া ছোট-বড় সব খামারিকেই বায়োসিকিউরিটি কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে এবং ছোট খামারগুলোকে পর্যায়ক্রমে দুই থেকে পাঁচ হাজার মুরগির মাঝারি খামারে রূপান্তরিত করার উদ্যোগ নিতে হবে।

পরিশেষ: বর্তমানের ১৬ কোটি এবং ২০৩০ সালের সাড়ে ১৮ কোটি মানুষের জন্য খাদ্যের সংস্থান করতে হবে। শুধু পেট ভরালেই হবে না। পুষ্টিকর, স্বাস্থ্যসম্মত এবং নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে। আবার পণ্যের দামও রাখতে হবে সামর্থ্যরে মধ্যে। ২০৩০ সালের লক্ষ্য পূরণ করতে হলে মুরগির মাংসের মাথাপিছু বার্ষিক কনজাম্পশন বর্তমানের ৬.৩ কেজি থেকে বাড়িয়ে ১৩ কেজি এবং ডিমের কনজাম্পশন ৯০ থেকে ১৫০/২০০টি তে উন্নীত করতে হবে। রপ্তানী শুরু করতে হবে এবং প্রতিযোগিতামূলক দামে পণ্য বিক্রি করতে হবে। বলাবাহুল্য, এজন্য অবকাঠামো ও প্রযুক্তিখাতে প্রচুর পরিমাণ বিনিয়োগ করতে হবে। উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে হবে। উৎপাদন খরচ কমাতে হবে। আর সে কারণেই যতক্ষণ পর্যন্ত শতভাগ সক্ষমতা অর্জন না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত পোল্ট্রি খাতের সবগুলো সেক্টরকে কর অব্যাহতি সুবিধা প্রদান করা খুবই যৌক্তিক বলে মনে হয়।

কিছু প্রস্তাবনা:
●নিরাপদ পোল্ট্রি ফিড উৎপাদন এবং এখাতে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার স্বার্থে অবৈধ ফিড মিল এবং টোল ম্যানুফ্যাকচারারদের বিরুদ্ধে জোরালো অভিযান এবং কঠোর আইনী ব্যবস্থা নিতে হবে।
● ছোট-বড় সব ধরনের খামার, হ্যাচারি এবং ফিড মিলকে নিবন্ধনের আওতায় আনতে হবে।
● খোলা বাজারে জীবন্ত মুরগি বিক্রি ক্রমান্বয়ে বন্ধ করতে হবে।
● ওয়েট মার্কেটগুলো নিয়মিতভাবে জীবানুনাশক দিয়ে পরিস্কার রাখতে হবে।
● ব্যাকওয়ার্ড পোল্ট্রি থেকে যেহেতু জীবানু ছড়িয়ে পড়ছে তাই ব্যাকওয়ার্ড পোল্ট্রিতেও ভ্যাকসিন দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
●এ.জি.পি’র ব্যবহার এবং পোল্ট্রি নীতিমালায় পরিবর্তন/আধুনিকায়ন আনতে হবে।
●লো-প্যাথজেনিক ভাইরাসের ভ্যাকসিন আমদানির অনুমতি এবং দেশীয় কোম্পানীগুলোকে ভ্যাকসিন উৎপাদনের অনুমতি দিতে হবে।
● বন্দর ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন এবং কাস্টমস জটিলতার অবসান ঘটাতে হবে।
● শষ্য জাতীয় পণ্য সংরক্ষণ বা সাইলো সুবিধাসহ সম্পূর্ণ আলাদা গ্রেইন টার্মিনাল স্থাপন করার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে।
● আমদানি জটিলতা এড়াতে পোল্ট্রি’র জন্য স্বতন্ত্র এইচ.এস কোড প্রদান করা দরকার।
● প্রতিটি ফিড মিলের সর্বোচ্চ উৎপাদন সক্ষমতা নিশ্চিত করতে হবে এবং কেউ যেন মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে অতিরিক্ত পণ্য আমদানি করে অবৈধভাবে মুনাফা লোটার সুযোগ না পায় সে পথগুলো বন্ধ করতে হবে।
● দেশীয়ভাবে ভ‚ট্টা ও সয়াবিন আবাদে কৃষকদের অনুপ্রাণিত করতে কৃষি মন্ত্রণালয়কে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের জন্য তদবির করতে হবে।
● কাঁচামালের আমদানি ও পরিবহন খরচ কমাতে উদ্যোগী হতে হবে।
● সুদের হার ৭-৯ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনতে হবে।
● দেশীয় উদ্যোক্তা ও বিদেশী বিনিয়োগকারিদের মাঝে ব্যাংক ঋণের সুদের হারে প্রায় ৮ থেকে ১০ শতাংশের বিশাল ব্যবধান আছে। ফলে প্রতি বছর ঝরে পড়ছে অসংখ্য দেশীয় খামারি ও উদ্যোক্তা। তাই লেবেল-প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে বিদেশী বিনিয়োগকারিদের ওপর নতুন কিছু কর আরোপ কিংবা দেশীয়দের জন্য বিশেষ কিছু ছাড় কিংবা প্রণোদনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
● সরকারি ল্যাবের সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং মান উন্নত করতে হবে। একই সাথে বেসরকারিভাবে কিউ.এ ল্যাব স্থাপনের অনুমতি দিতে হবে এবং ল্যাবে ব্যবহৃত সকল ঊষরংধশরঃ, যন্ত্রপাতি এবং কেমিক্যাল আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদান করতে হবে।
● বিদেশী কোম্পানীগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। কোন্ কোন্ খাতে তারা বিনিয়োগ করতে পারবে, সর্বোচ্চ কী পরিমাণ মার্কেট শেয়ার নিতে পারবে ইত্যাদি বিষয়ে সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকতে হবে।
● রপ্তানীমুখী শিল্পস্থাপনে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা এবং প্রণোদনা দিতে হবে।
● স্ট্যাম্পিং বা কালিং এর ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে।
● পোল্ট্রি ওয়েস্ট রিসাইক্লিং প্লান্ট স্থাপনকে উৎসাহ ও প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে হবে। এখাতে দাতাদের দেয়া ফান্ডকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে।
● ‘ফিড অ্যাক্ট’কে সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হবে। সময় ও চাহিদার সাথে পোল্ট্রি উৎপাদন বাড়াতে একটি ন্যাশনাল এ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করতে হবে।
● পোল্ট্রি প্রসেসিং ও ফারদার প্রসেসিং ইন্ডাষ্ট্রিকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করতে হবে।

অত্যন্ত সাধারণ একটি সেক্টর যখন অসামান্য অবদান রাখতে শুরু করে তখন তাকে সেভাবেই মূল্যায়ন করতে হয়। তা না হলে এ ব্যর্থতার দায়ভার পুরো জাতিকে বহন করতে হয়। পোল্ট্রি খাত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে, সাধারণ মানুষের ক্ষুধা নিবারন থেকে শুরু করে পুষ্টি ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা, মেধার বিকাশ, মাতৃমৃত্যুর হার কমানো, আয়ুস্কাল বাড়ানো ইত্যাদি ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখে চলেছে; কর্মসংস্থান- বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থানের নতুন এক দিগন্ত উন্মোচন করেছে; আগামীতে দেশীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রপ্তানীর সম্ভাবনাও ক্রমেই উজ্জ্বল হচ্ছে। তাই একথা বলা যেতেই পারে- পোল্ট্রিকে সহায়তা না দিলে আর কোন খাতে দিবেন?

এই লেখাটি যখন প্রকাশিত হচ্ছে তখন ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবনা উপস্থাপিত হয়েছে। মাননীয় অর্থমন্ত্রী পোল্ট্রিখাতের জন্য সরকারের দেয়া সকল সুবিধা বহাল রেখে পোল্ট্রি ফিডের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত সয়াবিন ওয়েল কেক ও ময়দা (ফ্লাওয়ার) এর কাস্টমস ডিউটি শূণ্য এবং রেগুলেটরি ডিউটি ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রস্তাব করেছেন। এটি নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। তবে শুধু এতোটুকুতেই হবেনা। সরকারকে আরও পজিটিভ হতে হবে।

This post has already been read 4658 times!

One comment

  1. আমি পল্টি ফার্ম করতে চাই তাহলে আমাকে কি কি করতে হবে আমাকে একটু বলবেন তাহলে উপকৃত হতাম