Saturday 27th of April 2024
Home / অর্থ-শিল্প-বাণিজ্য / নিরাপদ খাদ্য অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের

নিরাপদ খাদ্য অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের

Published at ডিসেম্বর ২১, ২০১৭

নিজস্ব প্রতিবেদক : সকলের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে কার্যকর ভ্যালু চেইন গড়ে তুলতে সরকারী সহায়তা বৃদ্ধির দাবী জানিয়ে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য নেটওয়ার্ক (বিএফএসএন) এর দিনব্যাপী নিরাপদ খাদ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রায় ২০০ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রতিনিধিদের নিয়ে বৃহস্পতিবার (২১ ডিসেম্বর) রাজধানীর কৃষিবিদ মিলনায়তনে সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়েছে।

নেটওয়ার্কের সভাপতি মহিদুল হক খান এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই খাদ্য সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আব্দুল ওয়াদুদ দারা, এমপি। সম্মেলনে বিশেষে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাহফুজুল হক, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব আনোয়ার ফারুক এবং জাতীয় সংসদের সর্বদলীয় সংসদীয় গ্রুপ (এপিপিজি‘স) এর সেক্রেটারী জেনারেল শিশির শীল।

সম্মেলনে আব্দুল ওয়াদুদ দারা, এমপি বলেন, কৃসংষ্কার আমাদের রন্দ্রে রন্দ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। সবার আগে আমাদের মন মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। নৈতিক ভিত্তি উন্নত হলে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা অসম্ভব নয়।

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাহফুজুল হক বলেন, মানুষের আয় যখন বাড়ে তখন নিরাপদ খাদ্যের প্রত্যাশাও বাড়ে। দেশের মানুষের আয় বাড়ার সাথে সাথে এ প্রত্যাশা আরো বাড়বে। সরকার বিষয়টিকে অনুধাবন করে আমাদেরকে লোকবল নিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে। তবে সবার সহযোগিতা ছাড়া আমাদের একার পক্ষে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব নয়।

তিনি আরো বলেন, অনিরাপদ খাদ্যের সবচেয়ে বড় কারণ আমাদের কাঁচাবাজার। বিশ্বের অন্য কোথাও এত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সবজি, মাছ ও মাংস বিক্রি হয় কী না আমার জানা নেই। তাই সবার আগে আমাদের কাঁচাবাজারগুলোতে উন্নত ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। আমরা এ জায়গাটিতে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি। এছাড়াও অনুমান নির্ভর কারণে বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ফলে মানুষের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়ে যা দেশের ব্যবসায়ীদের অনেক ক্ষতির কারণ হয়। এ ব্যাপারে আমাদের সচেতন থাকতে হবে যাতে অহেতুক আতংক ছড়িয়ে না পড়ে।

সম্মেলনে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, খাদ্য নিয়ে আমাদের বিতর্ক মূলত দুটি। একটি হচ্ছে ‘খাদ্য বনাম অখাদ্য’ এবং অপরটি হচ্ছে ‘খাদ্য বনাম ক্ষুধা’। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার আগে সবার জন্য খাদ্য যোগান নিশ্চিত করতে হবে। কারণ একটি অপরটির পরিপূরক।

তিনি বলেন, আমাদের দুর্ভাগ্য হলো খাদ্যের সংজ্ঞাতেই যেখানে অনিরাপদ শব্দটি আসা উচিত নয়, সেখানে এটিকে নিরাপদ রাখতে আমাদের আইন পর্যন্ত করতে হয়। এজন্য শুধু কৃষক, উদ্যোক্তা কিংবা ব্যবসায়ীদের দায়ী করলে চলবেনা। কারণ মাঠ পর্যায়ে যদি নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করাও হয়; সঠিক জ্ঞান, সংরক্ষণ কৌশল, বাজারজাতকরণ ও পরিবেশজনিত কারণে সেগুলো শেষ পর্যন্ত নিরাপদ থাকছেনা। তাই সরকারকে এসব বিষয়ে অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিকে জোর দিতে হবে। বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা আরো বাড়াতে হবে এবং নিরাপদ খাদ্য আইনের ব্যবহারিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

জনাব ফারুক আরো বলেন, আশার দিক হলো আমাদের বহু কৃষক বর্তমানে উত্তম কৃষি চর্চার দিকে ঝুঁকছেন। সারাদেশের কৃষকদের মাঝে এটিকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য মাঠ ও ফসলে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, ফসল উত্তোলনের পর অপচয় রোধ সম্পর্কে প্রশিক্ষিত করতে হবে।

সম্মেলনে ‘নিরাপদ খাদ্য প্রসারে গণমাধ্যম: আরও কি করা যায়’ শীর্ষক বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানের উপস্থাপক অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকী রানা। তিনি বলেন, খাদ্যের সংজ্ঞায় অনিরাপদ শব্দটিইতো আসা উচিত ছিলনা। কারণ যেগুলো অনিরাপদ সেগুলো খাদ্য নয় বরং অখাদ্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাস্তবতার প্রেক্ষিতে আমাদের এসব নিয়ে আলোচনার আয়োজন পর্যন্ত করতে হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, গণমাধ্যম সমাজের দর্পন হিসেবে কাজ করে। নিরাপদ খাদ্য নিয়ে গণমাধ্যম কর্মীদের অনেক কিছু করার আছে। যারা নিরাপদ খাদ্য নিয়ে আন্দোলন করছেন তাদেরকে গণমাধ্যম কর্মীদের কৃষির নব নব প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা এবং সময়মতো সঠিক তথ্য প্রদান করতে হবে।

সম্মেলনে ‘নিরাপদ খাদ্যে অর্থায়ন’ বিষয়ে বক্তব্যে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সিনিয়র ন্যাশনাল এডভাইজার ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন বলেন, দেশে প্রতি বছর প্রায় ৩ মিলিয়ন লোক হাসপাতালে ভর্তি হয়। দুই’শ রকমের রোগ হয় শুধুমাত্র অনিরাপদ খাদ্য গ্রহণের ফলে। আমাদের খাদ্য অনিরাপদ হয় যতটা না উৎপাদন পর্যায়ে তারচেয়ে বেশি পরিবহন, বাজারজাতকরণ এবং কাঁচা বাজার দূষনের কারণে। সঠিক জ্ঞানের অভাবে এসব হচ্ছে। এছাড়াও কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার অনিরাপদ করে ফেলছে আমাদের খাদ্যকে।

সম্মেলনে বিএফএসএন এর কার্যক্রম তুলে ধরেন ক্যাব কর্মকর্তা আহমেদ একরামুল্লাহ, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে সামাজিক সচেতনতা শীর্ষক বক্তব্য রাখেন উবিনীগ এর পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম জনি, নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও বিপণনে কমিউনিটি এন্টারপ্রাইজ বিষয়ে বক্তব্য রাখেন শিসউক এর নির্বাহী পরিচালক শাকিউল মিল্লাত মোর্শেদ, এবং নিরাপদ খাদ্য ভ্যালু চেইন যেখানে নজর দিতে হবে শীর্ষক মূল বক্তব্য তুলে ধরেন আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান এর সাবেক পরিচালক কৃষি বিজ্ঞানী ড. জয়নুল আবেদীন।

দিনব্যাপী এই নিরাপদ খাদ্য সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে “নিরাপদ খাাদ্য আন্দোলনে তৃণমূল সংলাপ” পর্বে সারাদেশ থেকে আগত নিরাপদ খাদ্য আন্দোলনের সংগঠকবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। এই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন ক্যাব সভাপতি ও সাবেক দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন হাঙ্গার ফ্রি ওয়াল্ড এর কান্ট্রি ডিরেক্টর আতাউর রহমান মিটন।

বক্তারা বলেন, নিরাপদ খাদ্য সবার অধিকার। এই অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। সম্মেলনে নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির নানাদিক, বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষ করে ‘নিরাপদ খাদ্যে অর্থায়ন’ বিষয়ে সম্মেলনে বেশি আলোচনা হয়েছে। সম্মেলনে বক্তারা বলেন, দেশের ১৬ কোটি মানুষের নিরাপদ খাদ্য অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে আগামী বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের কাছে জনগণের যে বিরাট প্রত্যাশা সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে হলে কর্তৃপক্ষের জনবল কাঠামো বৃদ্ধির পাশাপাশি অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে।

সম্মেলনে শেষে গৃহীত ঘোষণায় দাবী জানিয়ে বলা হয়, নিরাপদ খাদ্য চক্র নিশ্চিত করতে হলে সরকারের সর্বক্ষেত্রে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। নিরাপদ খাদ্য গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই নিরাপদ খাদ্য বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। ‘খাদ্যমান মনিটরিং’ ব্যবস্থাপনা জোরদার করতে হবে। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে ‘কমিউনিটি এন্টারপ্রাইজ’ গড়ে তুলতে হবে। নিরাপদ খাদ্যে অর্থায়ন বৃদ্ধির জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে এগিয়ে আসার জন্য সম্মেলনের পক্ষ থেকে আহবান জানানো হয়। সম্মেলনে বলা হয়, বাংলাদেশের খাবারকে এমন একটা মানে নিয়ে যেতে হবে যাতে করে উন্নত দেশে রপÍারী ক্ষেত্রে কোন বাধা না থাকে।

This post has already been read 2851 times!