নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের জীব-বৈচিত্রের জন্য ক্রমশ হুমকি হয়ে দাড়িয়েছে বিদেশি আগ্রাসী প্রজাতির উদ্ভিদ, মাছ, পাখি, কীটপতঙ্গসহ অন্যান্য প্রাণী। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে এ পর্যন্ত ৬৯টি বিদেশি আগ্রাসী প্রজাতি শনাক্ত হয়েছে; যার মধ্যে রয়েছে ৪৬টি উদ্ভিদ, ১৬টি মাছ, ৫টি কীটপতঙ্গ এবং শামুক ও পাখিসহ অন্যান্য প্রাণী। আগ্রাসী এসব প্রজাতির অধিকাংশই দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলো থেকে এসেছে। বিজ্ঞানীদের মতে, ব্যবসায়ীক উদ্দেশ্যে, ইচ্ছাকৃত, অনিচ্ছাকৃত অথবা দুর্ঘটনাবশত এসব আগ্রাসী প্রজাতিগুলো দেশে ঢুকেছে, যা এখন স্থানীয় প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য বড় হুমকিতে পরিণত হয়েছে।
আজ মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) সকালে রাজধানীর বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) অডিটোরিয়ামে কেয়ার বাংলাদেশ (কেবি) আয়োজিত ‘জার্নালিস্ট ওরিয়েন্টেশন ওয়ার্কশপ অন পেস্টিসাইড রিস্ক রিডাকশন’ -কর্মশালায় উপস্থাপিত তথ্য থেকে এসব চিত্র উঠে আসে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) মহাপরিচালক মো. ছাইফুল আলম। সভাপতিত্ব করেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) সাবেক মহাপরিচালক আব্দুল মুঈদ। কর্মশালায় বক্তব্য দেন – কেবির এশিয়া অঞ্চলের ডেভেলপমেন্ট কমিউনিকেশন ম্যানেজার আজমত আব্বাস, বাংলাদেশ কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ ড. সালেহ আহমেদ ও প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর ড. দিলরুবা শারমিন। উপস্থিত ছিলেন ডিএই–এর সরেজমিন উইংয়ের পরিচালক মো. ওবায়দুর রহমান মণ্ডলসহ অনেকে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদেশি আগ্রাসী আগাছা পার্থেনিয়াম (Parthenium hysterophorus) বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যের জন্য নতুন হুমকি হয়ে উঠেছে। মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার এ আগাছা দ্রুত বংশবিস্তার করে মাঠ, রাস্তার ধারে ও পতিত জমিতে ছড়িয়ে পড়ছে। অন্যদিকে, বিদেশি আগ্রাসী প্রজাতির মাছ স্থানীয় প্রজাতির মাছের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাড়িয়েছে এবং প্রাকৃতিক মাছের উৎপাদন হ্রাসে এরা মারাত্মক ভূমিকা রাখছে।
গবেষকরা বলছেন, পার্থেনিয়াম কৃষিজমির উর্বরতা কমিয়ে দেয় এবং ধান, গম, ভুট্টা, সবজি ও ডালশস্যসহ বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন হ্রাস ঘটায়। এতে কৃষকরা মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন। শুধু তাই নয়, এ আগাছা মাটির ভৌত ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য বদলে দিয়ে স্থানীয় ঘাস ও গাছপালা জন্মাতে বাধা দেয়। ফলে দেশীয় উদ্ভিদ প্রজাতি ধীরে ধীরে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।
মানুষ ও পশুপাখির জন্যও পার্থেনিয়াম সমান ক্ষতিকর। এটি থেকে নির্গত রাসায়নিক উপাদান ত্বক ও শ্বাসতন্ত্রে অ্যালার্জি, হাঁপানি, চুলকানি এবং চোখে প্রদাহের মতো রোগ সৃষ্টি করে। গবাদিপশু যদি এ আগাছা খায় তবে দুধের মান নষ্ট হয় এবং উৎপাদন কমে যায়।
বিদেশি আগ্রাসী প্রজাতির মাছের মধ্যে ১৯৮০-এর দশকে মাছ চাষের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে আনা হয় আফ্রিকান ক্যাটফিশ (Clarias gariepinus)। কিন্তু এই রাক্ষুসে মাছ দেশীয় ছোট মাছ ব্যাপক হারে কমিয়ে দেয়। ২০১৪ সাল থেকে এর চাষ ও বিক্রি নিষিদ্ধ হলেও এখনও অবৈধভাবে বাজারে পাওয়া যায়। আরও ভয়াবহ হলো, এটি দেশীয় হাঁটুয়া মাছের সঙ্গে সংকরায়িত হয়ে ভবিষ্যতে জিনগত বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞগণ।
একইভাবে পিরানহা, যা বাংলাদেশে নিষিদ্ধ, দেশীয় মাছের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠেছিল। সাকারমাউথ ক্যাটফিশ (Hypostomus plecostomus) যা স্থানীয়ভাবে সাকার ফিশ, রোহিঙ্গা মাছ নামে পরিচিত। এটি মূলত অ্যাকুয়ারিয়ামের মাছ হলেও এখন নদী-নালায় ছড়িয়ে পড়েছে। এটি দূষিত পানিতেও বেঁচে থাকে, খাবারের জন্য দেশীয় মাছের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে এবং নদীর তলদেশে গর্ত করে পাড় ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
এছাড়া বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য আনা বিদেশি কার্প মাছ, যেমন বিগহেড, সিলভার ও কমন কার্প, এখন প্রাকৃতিক জলাশয়ে স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিয়েছে। এগুলো দেশীয় প্রজাতির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকার সুযোগ কেড়ে নিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, এসব বিদেশি আগ্রাসী প্রজাতির উদ্ভিদ, মাছ ও অন্যান্য প্রাণী দেশে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া না হলে বাংলাদেশের দেশীয় মাছ ও সামগ্রিক জীববৈচিত্র্য মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে।