
নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশের পোলট্রি শিল্প বর্তমানে এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি—যেখানে টিকে থাকার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশুদ্ধ পানির সংকট। ৭ম আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে এমনটাই জানিয়েছেন বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) সভাপতি শামসুল আরেফীন খালেদ। শনিবার (১০ মে) রাজধানীর বিএআরসি ভবনে “জলবায়ু সহনশীল খাদ্য নিরাপত্তা ও নিরাপদ খাদ্য” শীর্ষক উক্ত সম্মেলনের আয়োজন করে বাংলাদেশ সোসাইটি ফর সেইফ ফুড (বিএসএসএফ)।
তিনি বলেন, প্রতিটি মুরগির দৈনিক গড়ে ৩ থেকে ৪ লিটার বিশুদ্ধ পানির প্রয়োজন হয়। অথচ ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে, যার ফলে দেশের অনেক অঞ্চলে খামার পর্যায়ে নিরাপদ পানি সরবরাহ এখন দুরূহ হয়ে পড়েছে। শুধু পানির স্বল্পতা নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অনেক জায়গায় পানি দূষিতও হয়ে পড়ছে, যা খামারের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বাড়তি ঝুঁকি তৈরি করছে। এর ফলশ্রুতিতে রোগবালাই বৃদ্ধি পাচ্ছে, বাড়ছে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার, উৎপাদন ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে এবং খামারিরা অর্থনৈতিকভাবে বিপাকে পড়ছেন।
শামসুল আরেফীন বলেন, “বিশুদ্ধ পানির অভাব পোলট্রি খাতের উৎপাদনশীলতা ও নিরাপদ খাদ্য সরবরাহে সরাসরি হুমকি তৈরি করছে। এটি এখন আর শুধু খামারিদের সমস্যা নয়—এটি জনস্বাস্থ্য ও জাতীয় পুষ্টি নিরাপত্তার প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।” তিনি জানান, খামারগুলোতে বিশুদ্ধ পানির ঘাটতির কারণে ব্রয়লার মুরগির বৃদ্ধির হার কমে যাচ্ছে। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, তাপমাত্রা প্রতি ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে মুরগির ওজন গড়ে ৫ শতাংশ হ্রাস পায় এবং ডিম উৎপাদনেও মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
তিনি আরও বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বৃষ্টিপাতের অনিয়মিত ধারা, খরা ও লবণাক্ততার কারণে পোলট্রি ও গবাদিপশু খাত মারাত্মক চাপে পড়েছে। পানির পাশাপাশি ঘাস ও চারণভূমির উৎপাদনও হ্রাস পাচ্ছে। ফলে প্রাণিসম্পদ খাতে টেকসইতা বজায় রাখা দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে।
এই পরিস্থিতিতে তিনি স্মার্ট ফার্মিং ও পানি ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর জোর দেন। বিশেষ করে রেইনওয়াটার হারভেস্টিং, পানি পুনঃব্যবহার, ড্রিপ সিস্টেম ইত্যাদি প্রযুক্তি ব্যবহার করে জল সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে বলে মত দেন তিনি। একই সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধ করে বায়োসিকিউরিটি নিশ্চিত করতে এবং প্রতিটি খামারকে “রোগ নজরদারি নেটওয়ার্ক”-এর আওতায় আনতে হবে বলেও মন্তব্য করেন শামসুল আরেফীন খালেদ।
পোলট্রি খাত বাংলাদেশের প্রোটিন নিরাপত্তায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে উল্লেখ করে তিনি জানান, দেশের দুধ, ডিম ও মাংসের সরবরাহের একটি বড় অংশ এই খাত থেকেই আসে। কিন্তু দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ খামারি ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের, যাদের অর্থায়ন, প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা এখনও সীমিত। ফলে বিশুদ্ধ পানির সংকট বা জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা তারা সামলাতে পারছে না।
সম্মেলনে শামসুল আরেফীন খালেদ সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাত ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর প্রতি আহ্বান জানান, যাতে এই খাতকে রক্ষা করতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায়। তিনি বলেন, “জলবায়ু সহনশীল পোলট্রি ব্যবস্থার জন্য আমাদের এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। খামার ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ, নিরাপদ পানি এবং নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।”
বক্তব্যের শেষে তিনি বলেন, “পোলট্রি শিল্প শুধু খাদ্য নয়, এটি অর্থনীতি, কর্মসংস্থান ও নারীর ক্ষমতায়নের একটি ভিত্তি। জলবায়ু পরিবর্তনের এই যুগে বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিতে অবহেলা করলে শুধু একটি খাত নয়, গোটা জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এখনই সময় বিজ্ঞানভিত্তিক ও টেকসই পদক্ষেপ নেওয়ার।”