Thursday 25th of April 2024
Home / পোলট্রি / প্রোটিন বিষয়ক সচেতনতা বাড়াতে ডাক্তারদের এগিয়ে আসতে হবে

প্রোটিন বিষয়ক সচেতনতা বাড়াতে ডাক্তারদের এগিয়ে আসতে হবে

Published at মে ২৬, ২০২৩

বাজিতপুর (কিশোরগঞ্জ): ডিম, দুধ, মাছ, মাংস খাওয়ার পরিমাণ আগের তুলনায় বাড়লেও কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন এখনও সম্ভব হয়নি। প্রোটিন বিষয়ে সাধারন মানুষের সচেতনতার অভাব, ভুল ধারণা ও অপপ্রচার এক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পেশাজীবি চিকিৎসকদের এগিয়ে আসতে হবে। কারণ, তাঁদের কথা মানুষ গুরুত্বের সাথে শোনে এবং তা মেনে চলার চেষ্টা করে।

আজ শুক্রবার (২৫ মে) কিশোরগঞ্জের ভাগলপুরে অবস্থিত জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। সবার জন্য প্রোটিনের অধিকার নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে খাদ্যের পাশাপাশি প্রোটিনকেও মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরেন তাঁরা।

সেমিনারের মূল প্রবন্ধে প্রফেসর ডা. মো. খালেকুল ইসলাম বলেন, ২০২২ সালের গ্লোবাল ফুড সিকিউরিটি ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান ৮০তম। কাজেই একদিকে যেমন খাদ্য নিরাপত্তার ওপর জোর দিতে হবে; তেমনি খাদ্যের মান উন্নত করার দিকেও নজর দিতে হবে। প্রোটিন গ্রহণের পরিমাণ আরো বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, উদ্ভিজ্জ্য ও প্রাণিজ আমিষের সম্মিলনে সুষম খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। রেডমিটে কিছু স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে; তবে হোয়াইট মিট তুলনামূলক নিরাপদ।

পেডিয়াট্রিক বিভাগের প্রধান প্রফেসর ডা. জহিরুল কবির খান বলেন, আমাদের দেশে  ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের খাবারে প্রোটিন ঘাটতি রয়েছে। সে কারণে এদের ৩৬ শতাংশই অপুষ্টিতে ভুগছে। তিনি বলেন, ভ্রুণ জন্মের পর থেকেই গর্ভবতী মায়ের পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। শিশু জন্মের পর মায়ের দুধ এবং ৬ মাস পর থেকে সাপ্লিমেন্টারি ফুড দিতে হবে। ডা. কবির বলেন, সঠিক জ্ঞানের অভাবে গ্রামের মানুষেরা বাচ্চাদের সাপ্লিমেন্টারি ফুড দিতে পারেনা। চিকিৎসকরা রোগীদের সাহায্য করলে গ্রামের মানুষেরাও প্রোটিন সম্পর্কে জানতে পারবে এবং সাপ্লিমেন্টারি ফুড কিভাবে, কতটুক বাচ্চাকে দিতে হবে তাও শিখতে পারবে।

আইসিডিডিআর’বি -এর সাম্প্রতিক এক সমীক্ষার উল্লেখ করে বারডেম হাসপাতালের প্রধান পুষ্টিবিদ শামসুন্নাহার নাহিদ মহুয়া বলেন, বিগত দুই দশকে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ পুষ্টি ঘাটতি লক্ষ্য করা গেছে। প্রি-স্কুল বাচ্চাদের এক তৃতীয়াংশ খর্বাকৃতির, এক পঞ্চমাংশের বেশি কম ওজনের এবং দশভাগের এক ভাগ ক্ষীণকায়। ৬ মাস থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুদের ৪৩ শতাংশই এনিমিয়া বা রক্ত স্বল্পতায় ভুগছে। বিবাহিত নারীদের এক তৃতীয়াংশের ওজন প্রত্যাশিত মাত্রার নিচে; ১৩ শতাংশ লম্বায় খাটো; যে কারণে শিশু জন্ম দেয়ার সময় তাঁরা নানাবিধ জটিলতায় ভোগে এবং কম ওজনের শিশুর জন্ম দেয়। পুষ্টি ঘাটতির কারণে বাংলাদেশ প্রতি বছরে প্রায় ১০৭২ হাজার কোটি টাকা সমমূল্যেও উৎপাদনশীলতা হারাচ্ছে। মহুয়া বলেন, স্কুলের পাঠ্যক্রমে প্রোটিন বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো অনুপস্থিত। ফলে শিশুদের মাঝে প্রোটিন/পুষ্টি বিষয়ে সচেতনতা তৈরি হচ্ছেনা।

তিনি বলেন, প্রোটিন ঘাটতির কারণে নানাবিধ রোগব্যাধিতে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল প্রজননক্ষম মানুষের মাঝে ইনফারলিটির সংখ্যা বাড়ছে। মহুয়া আরো বলেন, আমরা যদি বাংলাদেশের মানুষের আয়ুষ্কাল ৮৫ বছর এবং কর্মক্ষম বয়সসীমা ৭০ বছরে উন্নীত করতে চাই তবে অবশ্যই প্রোটিন গ্রহণের পরিমাণ আরো অনেক বাড়াতে হবে।

জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের এডিশনাল ডিরেক্টর জেনারেল এবং আফতাব বহুমুখী ফার্মসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু লুৎফে ফজলে রহিম খান (শাহরিয়ার) বলেন, একটা সময় ছিল যখন তিন বেলার খাবার কিভাবে জুটবে সে কথা ভাবতাম। সে চাহিদা পূরণ হওয়ার পর জোর দেয়া হলো সবার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ওপর। সাম্প্রতিক সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বললেন- শুধু ভাত খেলে হবে না, পুষ্টিও নিশ্চিত করতে হবে। পোল্ট্রি ইন্ডাষ্ট্রি থেকে আমরা বলছি সব মানুষের প্রোটিনের অধিকারও নিশ্চিত করতে হবে।

শাহরিয়ার বলেন, ইউএস সয়াবিন এক্সপোর্ট কাউন্সিলের প্রোটিন বিষয়ক এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে- বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ জানেনা প্রতিদিন কতটুকু প্রোটিন গ্রহণ করতে হবে। প্রায় ৬২ শতাংশ মানুষ ডাল বা ডাল জাতীয় খাদ্যকে এবং ৪৪ শতাংশ মানুষ শাক-সব্জিকে প্রোটিনের বড় উৎস বলে মনে করেন। ৪৪ শতাংশ মানুষ মনে করেন- প্রোটিনের চেয়ে ভিটামিন ও মিনারেল অনেক বেশি দরকারি। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে- প্রতি ৩ জনের ১ জন বাংলাদেশি মনে করে যে প্রোটিন ঘাটতিতে স্বাস্থ্যের তেমন কোন ক্ষতি হয়না। কাজেই এটি বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, প্রোটিন সচেতনতা বাড়াতে আমাদের কী পরিমাণ কাজ করতে হবে!

তিনি বলেন, মানুষ এখনো মনে করে- ডিম খেলে হার্টের সমস্যা হয়, প্রেসার হয়, শরীর মোটা হয়ে যায়, অপারেশনের রোগীকে ডিম দেয়া যাবেনা, বয়স্কদের ডিম-মাংস দেয়া যাবেনা। ব্রয়লার মুরগিকে হরমোন দেয়া হয়, কাজেই পোল্ট্রি মাংস খাওয়া যাবেনা অথচ এগুলো সবই ভুল ধারণা। প্রোটিন সচেতনতা বাড়াতে চিকিৎসকরা এগিয়ে এলে গ্রামের সাধারণ মানুষদের উপকার হবে, জনস্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটবে, জাতি আরো মেধাবি হবে, সরকার ও রাষ্ট্র আরও শক্তিশালী হবে। তিনি বলেন, নার্সিং কলেজগুলোতে সাধারণত দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরাই পড়তে আসে। জহুরুল ইসলাম নার্সিং কলেজে নিয়মিতভাবে ডিম ও মুরগির মাংস খেতে দেয়া হয়; সে কারণে জাতীয় পর্যায়ের মেধা তালিকায় ১ থেকে ৫/৭ স্থান দখলে থাকে এই কলেজের শিক্ষার্থীদের।

ইউএস সয়াবিন এক্সপোর্ট কাউন্সিলের বাংলাদেশ টীম লীড খবিবুর রহমান কাঞ্চন বলেন, প্রোটিনের অধিকার নিশ্চিত করতে তাঁর প্রতিষ্ঠান বিশ্বজুড়ে ক্যাম্পেইন করছে। ভবিষ্যত প্রজন্মের প্রোটিন চাহিদা পূরণ করতে হলে আমাদেরকে স্বল্প জায়গায়, পরিবেশের ক্ষতি না করে অধিক পরিমান মাছ, মাংস, ডিম উৎপাদনের কথা ভাবতে হবে। তিনি বলেন, সয়াবিন একদিকে যেমন উদ্ভিজ্জ্য প্রোটিনের চাহিদা মেটাচ্ছে; তেমনি প্রাণিজ প্রোটিন উৎপাদনেও বড় ভূমিকা রাখছে।

সেমিনারে অন্যান্যের মাঝে বক্তব্য রাখেন জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের পরিচালক প্রফেসর বাহার উদ্দীন ভূঁইঞা, প্রিন্সিপাল- প্রফেসর ডা. মো. সাঈদ হাসান, ডা. রাশেদ আলম চৌধুরী এবং বিপিআইসিসি’র সেক্রেটারি দেবাশিস নাগ। অন্যান্যে মাঝে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক মনোজ কান্তি রায়, প্রায় ১৫০ জন ইন্টার্ন ও পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী, প্রায় ১০০ জন মেডিকেল অফিসার, বিপিআইসিসি’র যোগাযোগ ও মিডিয়া বিষয়ক উপদেষ্টা মো. সাজ্জাদ হোসেন, প্রোগ্রাম অফিসার আবু বকর প্রমুখ। সেমিনারের শুরুতে সদ্য প্রয়াত প্রিন্সিপাল প্রফেসর সৈয়দ মাহমুদুল আজিজের রুহের মাগফেরাত কামনা করে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।

This post has already been read 1778 times!