Thursday 25th of April 2024
Home / প্রাণিসম্পদ / গো-খাদ্য খরচ কমাতে ও নিরাপদ দুধ-মাংস উৎপাদনে ‘টিএমআর‘ অনন্য এক প্রযুক্তি – ড. এ.বি.এম.খালেদুজ্জামান

গো-খাদ্য খরচ কমাতে ও নিরাপদ দুধ-মাংস উৎপাদনে ‘টিএমআর‘ অনন্য এক প্রযুক্তি – ড. এ.বি.এম.খালেদুজ্জামান

Published at জানুয়ারি ২০, ২০২৩

ড. এ.বি.এম.খালেদুজ্জামান

মো. খোরশেদ আলম (জুয়েল) : আমাদের প্রাণিসম্পদের উন্নয়নে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ টোটাল মিক্সড রেশন বা টিএমআর। বাংলাদেশে এই প্রথম দানাদার খাদ্যের সাথে রাফেজ বা আঁশ জাতীয় খাদ্য মিশিয়ে টোটাল একটা মিশ্রণে একটা যুগান্তকারী পদক্ষেপের শুভ সূচনা শুরু হলো। এতে করে আমাদের দানাদার খাদ্যের যে ক্রমবর্ধমান দামের ঊর্ধ্বগতি সেটা কিছুটা হলেও হ্রাস পাবে। টিএমআর প্রযুক্তিতে উৎপাদিত গো খাদ্যে কেজিপ্রতি খরচ কমবে প্রায় ৩ থেকে সাড়ে ৩ টাকা। পাশাপাশি এই দানাদারের সাথে খড় মিশানোর ফলে আমাদের খড়ের পরিপাচ্চ্যতা ১০-১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে এবং সর্বোপরি বিপাকীয় শক্তি এবং আমিষের মান উন্নয়নের ফলে পুষ্টি সংযুক্ত একটা টোটাল মিশ্রণ এই ফিড মিল থেকে বের হবে।

বৃহস্পতিবার (১৯ জানুয়ারি) সাভারে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কর্তৃক নতুন স্থাপিত টোটাল মিক্সড রেশন (টিএমআর) কারখানার উদ্বোধনী দিনে একান্ত আলাপচারিতায় এগ্রিনিউজ২৪.কম কে এসব কথা বলেন ঢাকার সাভারে অবস্থিত কেন্দ্রীয় গো প্রজনন ও দুগ্ধ খামার -এর পরিচালক ড. এ.বি.এম.খালেদুজ্জামান। ওইদিন প্রধান অতিথি হিসেবে কারখানাটির উদ্বোধন করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, এমপি।

ড. এ.বি.এম.খালেদুজ্জামান বলেন, টিএমআর প্রযুক্তিটি দেশের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ইতিহাসে একটি মাইলস্টোন হিসেবে লেখা থাকবে। কারণ, এই প্রযুক্তি শুধু সরকারি খামারে নয়, বেসরকারি পর্যায়ের খামারি প্রশিক্ষণ উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব হবে। যাতে করে গবাদি পশুর সংকট থেকে আমরা উত্তরণ পেতে পারি। এই গো-খাদ্য সারা বাংলাদেশে প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সরবরাহের মাধ্যমে শুধু খাদ্য খরচই কমবে না; এতে করে মাংস ও দুধের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে এবং যা নিরাপদ প্রাণিজ আমিষ সরবরাহে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে গৃহীত হবে। গো-খাদ্য খরচ কমাতে ও নিরাপদ দুধ-মাংস উৎপাদনে ‘টিএমআর‘ অনন্য এক প্রযুক্তি হিসেবে বিবেচিত হবে।

টিএমআর প্রযুক্তিতে উৎপাদিত গো-খাদ্য কেন নিরাপদ খাদ্য বলে আপনি মনে করছেন -এমন এক প্রশ্নের জবাবে এগ্রিনিউজ২৪.কম কে ড. এ.বি.এম. খালেদুজ্জামান বলেন, এতে ব্যবহৃত প্রযুক্তি বা মেশিনটি সম্পূর্ণ অটোমেটিক প্রোগ্রামেবল লজিক কন্ট্রোলের মাধ্যমে পরিচালিত, তাই এখানে বয়লার থেকে যে স্টিম আসে সেটি তাপ এবং চাপের মাধ্যমে আমাদের খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত বিভিন্ন উপাদানে থাকা সমস্ত মাইক্রো অর্গানিজম ধ্বংস করে  দেয়। এতে করে খাদ্যটা সম্পূর্ণ নিরাপদ খাদ্য হিসেবে তৈরি হয়। প্রথমত ফিনিশড প্রোডাক্ট প্লাস এবং অতঃপর প্রসেসিং এর মাধ্যমে পিলেট আকারে ফিনিশড প্রোডাক্ট তৈরি হয় বলে, এখানে কোনো প্রকার মাইক্রো অর্গানিজম বা বিষক্রিয়া থাকার সম্ভাবনা নেই।

আমাদের দেশের গরুর খামারিদের কাছে আপনাদের উৎপাদিত টিএমআর প্রযুক্তিতে উৎপাদিত এই ফিড পাবেন ড. খালেদুজ্জামান এই প্রতিবেদককে আরো বলেন, বর্তমানে  সরকারি পর্যায়ে আমাদের এটা শুরু হয়েছে। আমাদের একটা উদ্যোগ আছে, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়য়ের পলিসি এডোপশনের মাধ্যমে আমরা খামারিদের এবং যারা উদ্যোক্তা হিসেবে আসবেন তাদেরকে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং তাদের সাথে এই প্রযুক্তিটাকে কিভাবে সম্প্রসারণ করা যায় সেজন্য আমরা কাজ করবো।

দেশের গবাদিপশু খাতে টিএমআর প্রযুক্তির আইডিয়া কীভাবে এবং কেন বেঁছে নিলেন এমন প্রশ্নের উত্তরে ড. এ.বি.এম. খালেদুজ্জামান এগ্রিনিউজ২৪.কম কে বলেন, কোভিডকালীন এবং বৈশ্বিক বিভিন্ন কারণে বিগত ২ বছরে আমাদের দানাদার খাদ্যের দামের যে ঊর্ধ্বগতি তৈরি হয়েছে এই বিষয়টিকে মাথায় নিয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম সম্প্রসারণ ভ্রুণ স্থানান্তর প্রযুক্তি বাস্তবায়ন প্রকল্প (৩য় পর্যায়)” নামক প্রকল্পের যে উদ্যোগ নিয়েছে, এটা সত্যি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। কারণ, আমাদের বাংলাদেশে এনিমেল ফিড ম্যানুফ্যাকচারিং যেসব কোম্পানি রয়েছে, তারা সাধারণত দানাদার খাদ্যকে প্রক্রিয়াজাত করে পিলেট আকারে বাজারজাত করছেন। এতে করে খাদ্যের দাম যেমন বেড়ে যায়, তেমনি শুধু দানাদার খাদ্যের ওপর নির্ভর করে গবাদিপশু পালনটা সত্যি অত্যন্ত দূরহ ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। সেই চিন্তার প্রেক্ষাপটেই আমরা চিন্তা করলাম আমাদের দেশে প্রচলিত খাদ্য উৎপাদের এখনও গ্রামে খড়ই অত্যন্ত জনপ্রিয়  এবং একমাত্র সহজলভ্য শস্যের উপজাত। আমরা তখন চিন্তা করলাম,কিভাবে এই খড়কে প্রক্রিয়াজাত করে দানাদার খাদ্যের সাথে মিশিয়ে একটা টোটাল মিক্সশেসন করা যায়, যাতে করে আমাদের গবাদি পশু বিপাকীয় শক্তি ও আমিষের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। তথাপি আমরা চিন্তা করলাম, নিরাপদ মাংস ও দুধ উৎপাদনে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় কীভাবে কার্যকরি ভূমিকা রাখতে পারে।

আমাদের গবাদিপশু পালন ও উৎপাদনের ৬৫-৭০ ভাগ খাদ্য খরচ। কাজেই এই খাদ্যের মূল্য কিভাবে কমানো যায় এবং আমাদের গবাদিপশুকে কিভাবে বিপাকীয় শক্তি ও আমিষের একটা ব্যালেন্স রেশন তৈরি করা যায়; তারই সফল বাস্তবায়ন টোটাল মিক্সড রেশন বা টিএমআর। উচ্চ প্রযুক্তির এই টিএমআর পশু খাদ্য প্ল্যান্ট উদ্বোধনের মাধ্যমে দেশের প্রাণীসম্পদ উন্নয়নে আরেকটি নতুন পালক সংযুক্ত হলো। প্রতি কেজি টিএমআর খাদ্যে যেকোনো খাদ্য মিশ্রণ থেকে ১০০-১৫০ কিলোক্যালরি বিপাকীয় শক্তি বৃদ্ধি করা সম্ভব। আমরা ইতিমধ্যেই এই টিএমআর প্ল্যান্টে দুই ধরণের ফরমুলেশন ব্যবহারের মাধ্যমে ফিনিশড প্রোডাক্ট উৎপাদন করতে সমর্থ হয়েছি। একটি ব্যাচে শতকরা ২০ কেজি হারে এবং অন্য আরেকটাতে শতকরা ৩০কেজি হারে খড় আমরা দিয়েছিলাম। দুটো ভিন্ন ফর্মুলেশনে আমাদের খাদ্য উৎপাদন খরচ এসেছে যথাক্রমে ৩৬-৩৭ টাকা। একটিতে প্রাণিজ আমিষ পেয়েছি ১৮% ও আরেকটিতে পেয়েছি ১৯%; যা ডেইরি এবং ক্যাটল হৃষ্টপুষ্টকরণে একটা ব্যালেন্স রেশন হিসেবে বিবেচিত হয়। তো কাজেই এই কথা আমরা অত্যন্ত সামর্থ্য ও কনফিডেন্টলি বলতে পারি যে, ‘দিস টিএমআর প্ল্যান্ট স্যুড বি অ্যা নিউ ডাইমেনশন্স ফর এনিমেল ফিড ম্যানুফ্যাকচারিং ইন দ্যা কান্ট্রি’ -যোগ করেন  ড. এ.বি.এম. খালেদুজ্জামান।

টিএমআর প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে জার্মানির আবিলাকে (Awila) কেন আপনারা বেঁছে নিলেন, এমন প্রশ্ন করা হলে ড. খালেদুজ্জামান বলেন, একচুয়ালি আমাদের এই প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় যখন প্রকল্প স্পেসিফিকেশন করে, তখন আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা ছিলো আমরা যেন ইউরোপিয়ান প্রযুক্তি বাঁছাই করি; যেটা স্ট্র শেডিং, খড়কে পাউডার না করে সেটি ব্লেন্ডিং করে কিভাবে পেলেট প্রসেসে আনা যায়। আবিলা যেহেতু জার্মানী বা ইউরোপিয়ান প্রযুক্তির বিশ্বের স্বনামধন্য একটি কোম্পানি এবং আমাদের স্পেশিফিকেশনের সাথে সবকিছু মিলে যায় তাই আমরা আবিলাকে বেঁছে নিয়েছি।

তিনি আরো বলেন, কেন্দ্রীয় গো প্রজনন ও দুগ্ধ খামার প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে বাংলাদেশে গবাদিপশুর জাত উন্নয়ন, ও উন্নত প্রযুক্তির গো খাদ্যের সম্প্রসারণে কাজ করে যাচ্ছে। আমি গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি মহান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, যিনি এই খামারটি ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭৩ সালে অস্ট্রেলিয়া থেকে ১২৫টি হলিস্টিন ও  জার্সি উন্নত জাতের বকনা ও ষাঁড় আনয়নের মাধ্যমে এই যুগান্তকারী কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে আজকে আমরা মাংসে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। আমি মনে করি, আমাদের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাদেরকে যে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে উৎসাহ যুগিয়েছেন, নির্দেশনা দিচ্ছেন; স্মার্ট লাইভস্টক প্রতিষ্ঠাতে এই টিএমআর প্রযুক্তিটি ইতিহাসে এক অনন্য নজির হয়ে থাকবে।

This post has already been read 2449 times!