Thursday 25th of April 2024
Home / ফসল / বেলের নতুন জাত ও চাষ পদ্ধতি নিয়ে দুটি কথা

বেলের নতুন জাত ও চাষ পদ্ধতি নিয়ে দুটি কথা

Published at নভেম্বর ২৭, ২০২২

কৃষিবিদ মো. আব্দুল্লাহ-হিল-কাফি: ফল মানুষের প্রাচীন খাদ্য। আদিম যুগে যখন চাষাবাদের প্রচলন ছিল না তখন মানুষ বনে জঙ্গলে ফল সংগ্রহ করে খেয়ে দিন যাপন করতো। ফল খাওয়ার পর বাসস্থানের আশেপাশে বীজগুলি ফেলতো এবং সেখান থেকে গাছ হয়ে ফল ধরা শুরু হলে তাদের বীজ লাগানোর অর্থাৎ বাগান সৃজনের অনুভূতি জাগে এবং এভাবেই চাষাবাদ শুরু হয়। জীবনের শুরু থেকে ফল জীবন ধারনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ কারণে আমাদের দেশের বিজ্ঞানীরা নিরলস প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন যাতে করে সারা বছরই ফলের সুষম প্রাপ্তি থাকে।

বেল একটি উপকারী ও গুরত্বপূর্ণ ফল। পাকা বেলে ভিটামিন ‘সি’ এবং ‘এ’ প্রচুর পরিমাণে থাকে। ভিটামিন ‘সি’ দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে যেমন শক্তিশালী করে তেমনি ছোঁয়াচে রোগগুলোর বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তৈরি করে শরীরে। এটি বিটাকেরোটিনের ভালো উৎস, ফলে দৃষ্টিশক্তি ভালো থাকে। ডায়রিয়া ও আমাশয় প্রতিরোধে বেলের জুড়ি নেই। বেল নিয়মিত খেলে দীর্ঘদিনের কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়। এই ফলে আশেঁর পরিমাণও তুলনামুলকভাবে বেশি। আশঁযুক্ত শাকসবজি বা ফল হজমশক্তি বাড়ায়। এটি শক্তি বর্ধক হিসেবে কাজ করে ও শারীরিক সক্ষমতা বাড়ায়। বেলের থায়ামিন ও রিবোফ্লাভিন হৃৎপিন্ড এবং লিভার ভালো রাখতে সাহায্য করে। বেল বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা হয়। কাঁচা বেলের মোরব্বা ও জেলী অতি সুস্বাদু। এছাড়া বেলের আচার তৈরি করে সেরাকে ডুবিয়ে রেখেও খাওয়া যায়। পাকা বেল ফল হিসেবে বেশ পুষ্টিকর।

১০০ গ্রাম বেলে প্রায় ১.২ গ্রাম রাইবোফ্লাবিন বা ভিটামিন বি-২, ১৫-২০ মিঃ গ্রাম ভিটামিন সি ও কিছু নিয়মিন আছে যা অন্য ফলে বিশেষ পাওয়া যায় না। পেটের পীড়ায়, আমাশা কোষ্টবন্ধতায় বেলের ব্যবহার প্রসিদ্ধ। এতে সেলুলোজ, হেমিসেলুলোজ ও পেকটিন জাতীয় শর্করা বেশি থাকার জন্য জ্যাম ও জেলি হওয়ার  সম্ভাবনা আছে।

বর্তমানে ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, পাকিস্থান, থাইল্যান্ড ও নেপালে বেলের চাষ হয়। আর্দ্র ও শুষ্ক যে কোন আবহাওয়াতেই বেল গাছ হয় ও ভালো ফলন দেয়। কোন বিশেষ ধরণের মাটি বেল গাছের জন্য দরকার হয় না। নিচু মানের মাটিতে এবং অম্ল ও ক্ষার যে কোন রাসায়নিক বিক্রিয়াতেই বেল গাছ হয়। খরা ও অতি আর্দ্রতা সহ্য করতে পারে এমনকি পানি দাড়ানো অবস্থায় বেল গাছ মরে না।

বারি বেল-এর বৈশিষ্ট্য এবং বেলের অন্যান্য জাত
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বারি বেল-১ নামে একটি জাত উদ্ভাবন করেছে । এছাড়া বেলের কোন নিদিষ্ট জাত নেই। বারি বেল-১ জাতটি প্রতি বছর ফলন দিয়ে থাকে। ফলের ওজন ৭৫০ গ্রাম হতে ১১০০ গ্রাম পর্যন্ত হতে পারে। গড় ওজন ৯০০ গ্রাম। বেলের খোসা অত্যান্ত পাতলা এবং পুরুত্ব ২ মিলিমিটার। মিউসিলেজ কম এবং বেলে প্রকৃতির। আঁশ তুলনামুলক কম। মোট খাদ্যাংশ ৭৮ ভাগ এবং টিএসএস ৩৫.০%। প্রতি বছরের মে মাসে গাছে ফুল আসে এবং ফলের সংগ্রহকাল মার্চ মাসের ২০ তারিখ হতে এপ্রিলের ২০ তারিখ পর্যন্ত। ফলের সংরক্ষণকাল প্রায় দুই সপ্তাহ।

যে কোন প্রকারের মাটিতে বেল জন্মাতে ও ফলন দিতে পারে। পাকা বেল সাধারণ তাপমাত্রায় প্রায় দুই সপ্তাহ সংরক্ষণ করা যায়। খুব সহজেই অঙ্গজ বংশ বিস্তার করা যায় ফলে জাতের বিশুদ্ধতা ধরে রাখা সম্ভব। বছরের যে সময়ে দেশি ফলের সরবরাহ সবচেয়ে কম থাকে তখন এই ফলটি সংগ্রহ করা হয়। সাত বছর বয়সী গাছ প্রতি গড় ফলের সংখ্যা ৩৮টি। বাংলাদেশের সকল জেলাতেই এই জাতটি চাষাবাদ করা যাবে। অতীতে বীজের চারা থেকে ফলন পেতে ৮-১২ বছর পর্যন্ত সময় লাগতো। এর ফল আসতে সময় লাগবে মাত্র ৫ (পাঁচ) বছর। এজন্য অন্যান্য ফলের মতো বেলও চাষিরা বাণিজ্যিকভাবে চাষ করতে পারবে। তবে ১০ সেরি বেল বলে জাত পাওয়া যায়। এ ছাড়াও হাজারী বেলের কথা শুনা যায়। বীজ থেকে গাছের চারা তৈরি করা যায়, তবে জাতের ঠিক থাকে না।

বীজ হতে চারা তৈরী এবং বংশ বিস্তারের অন্যান্য পদ্ধতি
বীজ থেকে চারা তৈরি করতে হলে, পাকা ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করে বার বার ঘষে উপরের পদার্থটি তুলে ফেলতে হবে। বীজ ছায়ায় শুকিয়ে অল্প দিনের মধ্যেই অর্থাৎ বর্ষার প্রথমদিকে বীজতলায় ২৫সেমি. অন্তর সারিতে ১০-১৫ সেঃমিঃ দুরে দুরে মাটির ২-৩ সেমি. নিচে বীজগুলি লাগাতে হবে। বীজ লাগানোর আগে ২-১ দিন পরিস্কার পানিতে ভিজিয়ে রাখলে ভালো চারা বের হয়। এছাড়া গুটি কলম, কুঁড়ি সংযোজন বা মুল কলম পদ্ধতিতে বংশ বিস্তার করা যায়। কুঁড়ি সংযোজন ও মুল কলমের চরাই উত্তম।

মাটি তৈরি চারা রোপন
চারা বা কলম লাগানোর জন্য লাইন থেকে লাইন এবং গাছ থেকে গাছের দূরুত্ব ৫.০ মিটার। বর্ষার আগে মাটি তৈরী করতে প্রথমে ১ ফুট চওড়া ১ ফুট গভীর গর্ত করতে হবে তারপর ওপরের ৬ ইঞ্চি  মাটি তুলে পৃথক ভাবে রাখতে হবে । এরপর ১ ফুট গভীর গর্তের নিচের ৬ ইঞ্চি  মাটি অন্য স্থানে রেখে তার সাথে গোবর ১ কেজি, ইউরিয়া ২ গ্রাম, পটাশ ১.৫ গ্রাম, জিপসাম ২ গ্রাম,  টিএসপি ৩ গ্রাম, রুটোন ০.২০ গ্রাম, ব্যাভিষ্টিন ০.২ গ্রাম মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে মাটির ওপরের দিকে দিতে হবে। উই, পিপড়ার আক্রমনের জন্য ০.৩ গ্রাম রিজেন্ট বা ফুরাডান দিন। মাটিতে রস না থাকলে হালকা সেচ দিতে হবে। তবে সেক্ষেত্রে প্রথম পাঁচ বছর বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি, ডাল জাতীয় ফসল, তৈলবীজ জাতীয় ফসলের চাষ অনায়াসে করা যায়। জুন-জুলাই মাসে কলমের চারাটি নির্দিষ্ট গর্তে রোপণ করতে হবে।

সার সেচ প্রয়োগ
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সূত্র মতে নিন্মলিখিত ছক মোতাবেক বারি বেল-১ চাষে সার দিতে হবে।

প্রতি গাছে রোপনের ১-বছর পর রোপনের ৩-বছর পর প্রতি বছর বৃদ্ধি করতে হবে ২০ বছরের বেশি
গোবর  কেজি) ১৫ ২০ ১০০
ইউরিয়া (গ্রাম) ১৫০ ২৫০ ১০০ ২১০০
টিএসপি (গ্রাম) ১০০ ১৫০ ৭৫ ১৩৫০
এমওপি (গ্রাম) ৭৫ ১২৫ ৫০ ১০০০
জিপসাম (গ্রাম) ৫০ ৭৫ ২৫ ৫০০
জিংক সালফেট (গ্রাম) ২০ ২৫ ১০০
বোরন সার (গ্রাম) ১৫ ২০ ১০০

সমস্ত সার ২ কিস্তিতে প্রয়োগ করা ভালো। প্রথম অর্ধেক বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে এবং বাকি অর্ধেক আশ্বিন মাসে প্রয়োগ করতে হবে। মাটিতে রসের অভাব থাকলে সার দেওয়ার সাথে সাথে পানি সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। বসন্তকালে নতুন পাতা ও ফুল আসার পর ২-১টি সেচ দিলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। এতে ফল বড় হয়, ঝরে পড়ে না।

অন্যান্য পরিচর্যা
বিশেষ পরিচর্যা না থাকলেও ছোট অবস্থায় গাছের নিচের দিকের ডাল ছেটে দেওয়া উচিৎ। এতে বাগানে আলো বাতাস চলাচলের সুবিধা হয়। যেকোন ফসলের আগাছা ক্ষতিকর। বেলের বেলাতেও তাই। কারণ আগাছা অনেক রোগ ও পোকার আশ্রয় স্থল হিসেবে কাজ করে। তাছাড়া গাছের ব্যবহার করা খাবারে আগাছা ভাগ বসায়। গাছের খাবার কেড়ে খায়। গাছের বাড়-বাড়তি কমিয়ে দেয়। এর ফলে গাছ দুর্বল হয়ে যায়। গাছ খুব সহজেই রোগ ও পোকায় আক্রান্ত হয়। এপ্রিল/মে মাসে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। এছাড়া বর্ষাকালে বাগান আগাছায় ভরে যাবে এবং পরবর্তীতে আগাছা দমন কষ্টসাধ্য হবে ফলে কোন কোন ক্ষেত্রে ফলন বিপর্যয় হতে পারে। তবে বেল বাগানে ধৈঞ্চা চাষ করলে আগাছার উপদ্রব কম হয় এবং মাটিতে জৈব পদার্থসহ পুষ্টি উপাদান যোগ হয়।

ফল সংগ্রহ ফলন
বারিবেল-১ সাধারণত চারা লাগানোর ৫ বছর পর থেকেই ফল ধরতে শুরু করে। তবে অন্য জাতের গাছের বয়স ৯-১০ বছর না হলে ঠিকমত ফলন পাওয়া যায় না। ফল পাড়ার সময় মাটিতে না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বেলের ফল পুষ্ট হয়ে পাকতে ১ বছর সময় লাগে। বসন্তকালে পাতা ঝড়ে যায় ও ফুল আসে, পাকা ফল সংগ্রহ করা হয়। গাছে ফল পাকলেও পাখিতে নষ্ট করার ভয় থাকে না, কেননা বেলের খোসা অত্যন্ত শক্ত। তাই কথায় বলে “বেল পাকলে তাতে কাকের কি?”

রোগ পোকা
বেল গাছে রোগ ও পোকার আক্রমণ প্রায়ই দেখা যায় না। তবে এ্যানথ্রোনোঞ্জ নামক এক ধরণের জীবাণুর আক্রমণে মরচে পড়া রোগ দেখা যায়। এছাড়া মাইট এর আক্রমণ হলে পাতার উপর চকচকে দাগ দেখা যায়। বর্দ্রোমিকচার প্রয়োগ করে রোগের আক্রমণ কমানো যায় এবং মাইট এর জন্য ওমাইট, টর্ক, থিওভিট বা রনোভিট স্প্রে করে ভালো ফল পাওয়া যায়। তবে আর একটি পোকা দেখা যায় সেটি হলো ফল খননকারী কাঁচা বেলের ভিতরে প্রবেশ করে এবং এর শাঁস নষ্ট করে ফেলে। সাধারনত মে-জুন মাসে বেশি ক্ষতি করে। এটি দমনের জন্য ডাইমেক্রন ছিটিয়ে প্রতিরোধ করা যায়।

পরিশেষ
আমাদের দেশে ফল আমদানির জন্য প্রতি বছর প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হয়। এই বেলের এই জাতটি বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ করলে দেশের মানুষ নিয়মিত পুষ্টি পেতে পারে। যার ফলে বিদেশ থেকে ফল আমদানি কমিয়ে দেশি ফলের সরবরাহ বাড়বে। বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। দেশব্যাপি ফলগাছ রোপনে কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিভিন্ন সংস্থা সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অধীন দেশব্যাপী ৭২টি হর্টিকালচার সেন্টার এবং বিএডি সি‘র ১৩টি এগ্রোসার্ভিস সেন্টার এবং ৯টি হর্টিকালচার সেন্টারে বিভিন্ন ফলের উন্নত জাতের চারা নামমাত্র মূল্যে বিক্রয়ের জন্য মজুদ আছে। প্রতিটি নগরী, জেলা বা পার্শ্ববর্তী এলাকায় এ রকম একাধিক সেন্টার অবস্থিত। এ সকল স্থান থেকে ফলের চারা /কলম সংগ্রহ করে চারা রোপন করতে পারেন। এছাড়া ফলের চারা/কলম রোপনে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে কারিগরি সহযোগিতা আপনি নিতে পারেন।

লেখক: আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, আঞ্চলিক কার্যালয়, রাজশাহী।

This post has already been read 2044 times!