Thursday 25th of April 2024
Home / অর্থ-শিল্প-বাণিজ্য / মিনিকেট চালের নামে চলছে প্রতারণা: ঠকছে সাধারণ ক্রেতাগণ

মিনিকেট চালের নামে চলছে প্রতারণা: ঠকছে সাধারণ ক্রেতাগণ

Published at জুন ১৬, ২০২২

প্রতীকি ছবি।

ফকির শহিদুল ইসলাম (খুলনা প্রতিনিধি) : এখন বাজার সয়লাব মিনিকেট নামের চালে। গত দুই দশক ধরেই খাবার টেবিলে তা শোভা বাড়াচ্ছে। কারণ এ থেকে চিকন ও সাদা ভাত হয়। তবে এ ধান কোত্থেকে আসে, কীভাবে মিনিকেট চাল হয়ে যায় তা ভোক্তাদের অজানা। এদিকে, এই চাল নিয়ে এই অসাধু ও অস্বচ্ছ বাণিজ্যের ফলে একদিকে যেমন ভোক্তা প্রতারিত হচ্ছেন, অন্যদিকে অতিমাত্রায় ছাঁটাইয়ের ফলে চালের পুষ্টিমান কমে গিয়ে তা শরীরের জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।

খুলনার বাজারে মিনিকেট চাল সয়লাব হলেও কাগজ কলমে এর কোন অস্তিত্ব নেই । কোন জাতের ধান থেকে এ চাল উৎপাদন করা হচ্ছে তার সঠিক উত্তর খুলনার ব্যবসায়ীরা দিতে পারেনি। জানা গেছে, মোটা চাল মেশিনে কেটে চিকন করা হচ্ছে। ফলে চালের গুণগত মান কমে যাচ্ছে। ‘মিনিকেট’ চাল কিনে প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছে  সাধারন ক্রেতারা।

খুলনায় ধান ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, বিগত ২০ বছর আগে প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে জিরা নামে একটি ধানের বীজ আমাদের দেশে আসে। সে বীজ থেকে যে ধান উৎপাদন করে চাল তৈরি করা হতো সেটি মূলত মিনিকেট চাল নামে পরিচিত ছিল। বর্তমানে এ ধান আমাদের দেশে উৎপাদন হয় না। মূলত মোটা ইরি চালকে কেটে মিনিকেট হিসেবে বাজারে সরবরাহ করা হচ্ছে।

বড় বজারের চাল ব্যবসায়ী কুন্ডু এন্টারপ্রাইজের মালিক বাসুদেব কুন্ডু বলেন, দেশে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন জাতের ধান উদ্ভাবন হচ্ছে। কোন জাত থেকে মূলত মিনিকেট চালের উৎপাদন করা হচ্ছে তা তিনি বলতে পারেনি। তবে ইরি ৬৩ বা ইরি ৫১ জাতের ধান থেকে উৎপাদিত চালকে মিনিকেট চাল বলে বাজারে সরবরাহ করছেন মিল মালিকরা। একই বাজারে কথা হয় নাটোরের চাল ব্যবসায়ী মো: ইউনুছ আলী পিন্টুর সাথে। তিনি বলেন, মিনিকেট বলতে কোন চালের অস্তিত্ব দেশে নেই। চিকন ধান থেকে উৎপাদিত চালকে মূলত মিনিকেট চাল বলে ক্রেতাদের কাছে চাপিয়ে দেওয়া হয়। তিনি আরও বলেন, ২০ বছর আগে ভারত থেকে একটি ধানের বীজ আমাদের দেশে আসে। ওই ধান থেকে মিলমালিকরা মিনিকেট চাল উৎপাদন করত। তবে ধানের সে বীজ মিকচার হতে হতে এর গুণাগুন নষ্ট হয়ে গেছে। ওই বীজ এখন আর আসে না। চিকন ধান হলেই মিনিকেট বলে চালিয়ে দেয় ব্যবসায়ীরা। আর একটু খাট হলেই মোটা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়।

দিনাজপুর ভান্ডারের মালিক মোঃ ফারুখ হোসেন বলেন, এলসি থেকে যে চাল আসত, তার বস্তায় মিনিকিট লেখা থাকতো। মিনিকেট কি না তিনি সঠিক উত্তর দিতে পারেনি। মিনিকেট ধানের বীজ মূলত আমাদের দেশে হয় না। ভারতে উৎপাদন হয়।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো: হাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের দেশে মিনিকেট জাতের কোন ধান হয় না। চাল কল মেশিনের ম্যাধমে সেগুলো ছেটে চিকন করা হয়। আর চিকন চালগুলো মিনিকেট বলে চালানো হয়। এগুলো ব্যবসায়ীদের কারিসাজি। তবে তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের এ কারিসাজি ঠেকাতে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। যে জাতের ধানের চাল তার নাম বলে বিক্রি করা না হলে শাস্তির বিধানের ঘোষণা করা হয়েছে।

এর আগে গত বছর ২০ ডিসেম্বর সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার জানান, ‘অরিজিনালি মিনিকেট নামে কোনো ধান নেই। সরু মিনিকেটের ক্ষেত্রে জিরাশাইল, শম্পাকাটারি এই দুই রকমের ধানটাই বেশি। এমনকি নাজিরশাইল নামে কোনো ধান নেই।

অনুসন্ধানে জানা যায়, মিনিকেট শব্দটি এসেছে ইংরেজি শব্দ ‘মিনি’ ও ‘কিট’ থেকে। ভারত সরকার নতুন উদ্ভাবিত কোনো ধানের বীজ ছোট বা মিনি প্যাকেটে কৃষকদের দেয়, তা থেকে কথ্য ভাষায় এই নাম হয়। পরে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারত থেকে কিছু ধানের জাত বাংলাদেশে আসে। ভারত সীমান্তের কুষ্টিয়া জেলার ব্যবসায়ী আবদুর রশিদ ঢাকার বাজারে মিনিকেট চালের বাণিজ্যিক প্রচলন ঘটিয়েছেন বলে ব্যবসায়ী মহলে প্রচলিত রয়েছে। তিনি বলেন, ‘মিনিকেট ধান’ বাংলাদেশের ধান গবেষণা কেন্দ্র থেকে আসেনি। মিনিকেটের জাতের নামও নয়। এই ধানের প্রকৃত নাম যে কী তা এখনো জানি না। তবে পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের এই ধানের বীজ ও সারসহ একটি প্যাকেট বিতরণ করা হয়েছিল। তখন এটাকে মিনিকিট বা মিনিকেট নামেই ডাকতে শুরু করে কৃষকরা। ১৯৮৫ সাল থেকে ১৯৯০ সালের দিকে ভারত থেকে যশোরে এই ধানের বিস্তার হয়। পরে পাশের জেলাগুলোতেও ছড়ায়।

ড. কৃষ্ণপদ বলেন, মূলত মিনিকেট নামে প্রচলিত ধানের আবাদ বাংলাদেশে খুব বেশি একটা হয় না। ধান গবেষণা কেন্দ্র থেকে উদ্ভাবিত বিভিন্ন উচ্চফলনশীল ধান থেকে চাল তৈরি করে সেটাই মিনিকেট হিসেবে বিক্রি করছে মিল মালিকরা। এখন এমন আধুনিক যন্ত্রপাতি এসেছে যে যেকোনো ধানকে কেটে যেকোনো আকৃতি দেওয়া হয়। ফলে ধান যাই হোক, মিনিকেট চাল তৈরিতে মিলগুলোর কোনো সমস্যা হয় না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান আইনে ধানকে মিনিকেট করা ঠেকানোর কোনো সুযোগ না থাকায় ভোক্তাদের সচেতন হয়ে ওঠাই এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে।

This post has already been read 2379 times!