Tuesday 23rd of April 2024
Home / মতামত / ফিডে পাটের ব্যাগ ব্যবহার বাধ্যতামূলক : পোল্ট্রি, মৎস্য ও ফিড শিল্পের ভবিষ্যত কোথায়?

ফিডে পাটের ব্যাগ ব্যবহার বাধ্যতামূলক : পোল্ট্রি, মৎস্য ও ফিড শিল্পের ভবিষ্যত কোথায়?

Published at ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২২

কৃষিবিদ মো. আক্তারুজ্জামান : এক সময় প্রচলিত কথা ছিল “দুধে মাছে বাঙ্গালী”-কথাটি আজও প্রচলিত, তবে এর সাথে যোগ হয়েছে মাংস ও ডিম। তাইতো আমরা আজ দুধ, মাছ, মাংস ও ডিমে বাঙ্গালী। খাদ্যের ৬টি উপাদানের মধ্যে প্রোটিনের যোগানদাতা উপাদান হচ্ছে এই দুধ, মাছ, মাংস ও ডিম। এর মধ্যে পোল্ট্রি মিট/মাংস ও ডিমের যোগান দিচ্ছে সারাদেশে বিস্তৃত ব্রয়লার ও লেয়ার ফার্ম। দেশে বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার লেয়ার ফার্ম এবং প্রায় ৬০ হাজার ব্রয়লার ও সোনালী ফার্ম রয়েছে। এই ৬০ হাজার ফার্ম ব্রয়লার ও সোনালী মুরগি পালনের মাধমে পোল্ট্রি মাংসের যোগান দিচ্ছে। কোভিড-১৯ পূর্ববর্তী সময়ে পোল্ট্রি ফার্মের এ সংখ্যা আরো বেশি ছিল।

করোনার প্রভাবে সুষ্ঠু বিপণন ব্যবস্থার অভাব, খাদ্য তৈরির উপাদানসমূহের উচ্চমূল্য, রেডিফিডের দাম বৃদ্ধি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিদের পুঁজি স্বল্পতা এই শিল্পের উন্নয়নে বিশেষ বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৭০-এর দশকের যে শিল্পের গোড়া পত্তন হয়েছিল এবং ৮০-এর দশকে যে শিল্পের ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি এবং ৯০-এর দশকে শিল্পের সফলতা দেশকে পর্যাপ্ত পরিমাণে সহজলভ্য প্রাণিজ আমিষের যোগানের পাশাপাশি জিডিপিতে অবদান রাখছে ১.৪৫ ভাগ (২০২০-২০২১ অর্থবছর)।

গ্রামীণ অর্থনীতিতে, জিডিপিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি বিশেষ করে নারীর কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা সৃষ্টিতে যে শিল্পের এত অবদান সেই শিল্পের উন্নয়নে ও প্রসারে প্রতিটি স্টেক হোল্ডার অত্যন্ত সতর্ক ও মনোযোগী। বাচ্চার গুণগত মান, নতুন নতুন জাত উন্নয়ন (দেশীয় স্বাদে কাছাকাছি মুরগি) ফুড সেফটি, খাদ্যের গুণগত মান, খাদ্য উৎপাদন কারখানায় ল্যাব বাধ্যতামূলক, পুষ্টিবিদের দ্বারা খাদ্যের (ফিড) ফর্মূলেশন, প্রাণি চিকিৎসকের দ্বারা অযাচিত এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ, ফার্মগুলোর প্রতিনিয়ত আধুনিকরণ ও এসোসিয়েশন এবং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর দ্বারা খামারের নিবন্ধনকরণ এই শিল্পকে নতুন উন্নয়নের দিক নির্দেশনা দিচ্ছে।

বিশেষ করে খাদ্য তৈরিতে মানসম্পন্ন উপাদানে ব্যবহার এবং পুষ্টিমান প্রোটিন, শক্তি, ময়েশ্চার, খনিজ ভিটামিন ইত্যাদির সঠিক মান/পার্সেন্টেজ নিশ্চিতকরণ এখন সেইফ ফুড ও রপ্তানি বাজারে সবার জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে এদেশে প্রাণিজাত খাদ্যের (ফিডের) জলীয় অংশ/ময়েশ্চার নিয়ন্ত্রণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ। চলমান খাদ্যের ফর্মূলায় “মোল্ড ইনহিবিটর”যোগকরণ বাধ্যতামূলক হয়, কেননা খাদ্যে ময়েশ্চার/জলীয় অংশ ১২% এর অধিক হলে খাদ্যে ফাংগাস/মোল্ড তৈরি শুরু হয়। এই ফাংগাস থেকে বেশ কয়েকটি টক্সিন/বিষ তৈরি হয়। এই খাদ্যের মান সঠিক রাখার খাদ্যে “টক্সিন বাইন্ডার” ডোজ বাড়াতে হয়। এরপরেও এন্টি অক্সিডেন্ট খাদ্যে মিশাতে হয়, যাতে করে খাদ্যের ময়েশ্চর/জলীয় অংশ দ্বারা খাদ্য যেন দ্রুত পচন না হয়। এত কিছুর পরও খাদ্যের পিপি ওভেন ব্যাগের ভেতরটা লেমিনেটেড করা হয় এবং ভিতরে একটি পলিথিন ব্যাগের ভিতর খাদ্য রাখা হয় যাতে ফিড আদ্রতাপূর্ণ না হয়ে উঠে।

খাদ্যের গুণগত মান নিশ্চিতকরণ ও খাদ্যের পচন রোধ করার মাধ্যমে আজ খাদ্য রপ্তানি হচ্ছে। পিপি ওভেন ব্যাগে খাদ্যের পুষ্টিমান প্রিন্টকরণ ও খাদ্য মিলের ল্যাবে পুষ্টিমান পরীক্ষাকরণ সেইফ ফুড ও পোল্ট্রি উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। জানা যায় অভ্যন্তরীণ বাজারে পাট পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধির লক্ষ্যে পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০, পাট খাতে সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে পাট আইন-২০১৭ এবং জাতীয় পাটনীতি-২০১৮ প্রণয়ন করে সরকার। প্লাস্টিক যেহেতু পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, তাই পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়টিও প্রজ্ঞাপন জারির সময় বিবেচনায় আনা হয়। আর পরিবেশের দিক বিবেচনা করে পোল্ট্রি ও ফিস ফিডের মোড়কে পাটের ব্যাগের ব্যবহার বাধ্যতামূলক এবং প্লাস্টিকের বস্তার ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। সর্বমোট ১৯টি পণ্যের ক্ষেত্রে এই বাধ্য-বাধকতা দেয়া হয়। প্রথমে ১৭টি পণ্যের জন্য নির্দেশনা ছিল, সর্বশেষ ২টি পণ্য পোল্ট্রি ও ফিস ফিড সহ মোট ১৯টি পণ্যের জন্য নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের এসআরও মারফত পণ্যে পাটজাত মোড়কে বাধ্যতামূলক ব্যবহার বিধিমালা-২০১৩ এর তফসিলে পোল্ট্রি ও ফিস ফিড অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ২৪ আগস্ট ২০১৬ তারিখে একটি স্মারক লিপিতে পোল্ট্রি ফিডের গুণগত মান সঠিক রাখার শর্তে পাটের ব্যাগের পরিবর্তে পলিব্যাগে মোড়কীকরণ যুক্তিযুক্ত বলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে জানান। ঠিক তেমনিভাবে মৎস্য অধিদপ্তরের ৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটিও তাদের মতামতে পাটের ব্যাগের পরিবর্তে বায়ুবিরোধী পলিব্যাগে খাদ্যের গুণগত মান রক্ষার স্বার্থে যুক্তিযুক্ত বলে একমত পোষণ করেন।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এমনিতেই খাদ্যে জলীয় অংশ একটি নির্দিষ্ট মানে রাখতে হয়। তার জন্য ৩টি উপাদান খাদ্যে যোগ করতে হয় (মোল্ড ইনহিবিটর, টক্সিন বাইন্ডার ও এন্টি অক্সিডেন্ট)। এছাড়াও প্রতিপিস পাটের ব্যাগের দাম

যদি ১৩০ টাকা হয়, সেক্ষেত্রে ৫০ কেজির ফিডের বস্তাতে কেজিপ্রতি মোড়কীকরণ খরচ পড়বে ২.৬০ টাকা।  যেখানে বর্তমানে ব্যবহ্নত প্লাস্টিক ব্যাগে খরচ হয় প্রতি কেজিতে ০.৬০ টাকা। অর্থাৎ শুধুমাত্র পাটের ব্যাগে মোড়কীকরণের জন্য প্রতি কেজি ফিডে খরচ বাড়বে অতিরিক্ত ২ টাকা। যা ক্ষুদ্র ও মাঝারী খামারীদের ফার্ম পরিচালনায় নিরুৎসাহিত করবে। কেননা ব্রয়লার ও ডিম উৎপাদন খরচ বাড়তে এমনিতেই বর্তমানে তারা হিমশিম খাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী কাঁচা মালের সরবরাহ লাইনে সংকটের ফলে খাদ্য উৎপাদন ব্যয় একবার বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন যদি আরো ২ টাকা কেজিপ্রতি খাদ্যের ব্যয় বেড়ে যায় তবে শিল্পের উন্নয়ন তথা বৃদ্ধির হার ব্যাহত হবে।

সরকার এই সেক্টরের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতির টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনে বাঁধাগ্রস্ত হবে। আরো জানা গেছে যে, প্রতিমাসে যে পরিমাণ খাদ্য (ফিড) তৈরি হয় তার জন্য ৯৫ লাখ থেকে ১ কোটি ব্যাগ দরকার হয়, যা যৌক্তিত মূল্যে সরবরাহ করা কঠিন হবে। যদি সেটি সম্ভবও হয়, এরপরও ফিডের মাণ ঠিক রাখার জন্য ভেতরে পলিথিন ব্যবহার করতেই হবে। কেননা ভিতরে পলিথিনের ইনার লাইনার ময়েশ্চার/জলীয় অংশ নিয়ন্ত্রণে অবশ্যই দরকার হবে।

জানা গেছে, অতি সম্প্রতি ৭টি পণ্যের জন্য মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হবে। এই ৭টি পণ্যের মধ্যে ২টি পণ্য হচ্ছে পোল্ট্রি ও ফিস ফিড। এই বিষয়ে আরো ভাবনা দরকার, যেখানে পুষ্টি বিজ্ঞানী, ফিড মিল এসোসিয়েশন, পোল্টি ফার্ম এসোসিয়েশন এবং এই শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও মাঠ পর্যায়ের প্রভাব ও সবার জন্য ভালো একটি মতামত থাকবে। সবার জন্য ভালো এমন বিজ্ঞ মতামত ও সুপারিশের অপেক্ষায় এবং বিষয়টি পুনঃবিবেচনা করার জন্য আমাদের মতামত থাকবে।

লেখক: পোল্ট্রি কনসালটেন্ট, এসোসিয়েট ফর ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস লি.

This post has already been read 4220 times!