নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা এবং কৃষকের ন্যায্য অধিকার—এই দুটি বিষয়কে একসূত্রে বাঁধতে হলে প্রয়োজন একটি দীর্ঘমেয়াদি, টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক কৃষিনীতি। এসিআই এগ্রিবিজনেস প্রেসিডেন্ট ড. এফ. এইচ. আনসারী তাঁর এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ বিষয়টিকে বিশেষভাবে তুলে ধরেছেন।
বণিক বার্তার আয়োজনে আজ (০৫ মে) সকালে রাজধানীর এক অভিজাত হোটেলে ‘কৃষি, খাদ্যনিরাপত্তা ও কৃষকের ন্যায্যতা সম্মেলন ২০২৫’ এর প্রথম অধিবেশনে “Food Security & Farmers’ Equity” শিরোনামের এ বিশ্লেষণভিত্তিক প্রতিবেদনে ড. আনসারী দেখিয়েছেন, কীভাবে কৃষকের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত না করে খাদ্য নিরাপত্তার প্রকৃত অর্জন সম্ভব নয়।
ড. আনসারী বলেন, “বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে নিঃসন্দেহে। তবে সেই উৎপাদনের আর্থিক ও সামাজিক সুফল কৃষকের ঘরে পৌঁছাচ্ছে না। খাদ্য নিরাপত্তার মূল ভিত্তি হওয়া উচিত যারা খাদ্য উৎপাদন করেন—অর্থাৎ কৃষক। অথচ আজও তারা চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে জীবনযাপন করছেন।”
প্রতিবেদনে বলা হয়, কৃষকদের অধিকাংশই ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক শ্রেণির। তাঁরা উপযুক্ত বীজ, সার, সেচ ও যন্ত্রপাতি সংগ্রহে জটিলতা ও অতিরিক্ত ব্যয়ের মুখোমুখি হন। কৃষিঋণ পাওয়া দুরূহ, আর মিললেও তা অনেক সময় উচ্চ সুদের কারণে বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। ফলস্বরূপ, কৃষক মৌসুমি চাষাবাদের মাধ্যমে উৎপাদন করলেও বছরের বড় সময়জুড়ে আর্থিক অনিশ্চয়তায় ভোগেন।
ড. আনসারীর মতে, ফসল উৎপাদনের চেয়ে বেশি সমস্যা দেখা যায় ফসল বিক্রির ক্ষেত্রে। দেশের বাজারব্যবস্থা এখনও কৃষকের অনুকূলে নয়। মধ্যস্বত্বভোগীরা অধিকাংশ লাভ নিয়ে নেয়, কৃষক পান ন্যায্য মূল্য থেকে অনেক কম। সরকারি উদ্যোগে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ফসল কেনার যে ব্যবস্থা রয়েছে, তা অনেক সময় কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়।
প্রতিবেদনে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে কৃষিতে নারীর অবদানের উপর। নারীরা কৃষিকাজে পুরুষের সমানভাবে যুক্ত থাকলেও তাদের শ্রমের স্বীকৃতি, সম্পদের ওপর অধিকার এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ অত্যন্ত সীমিত। ড. আনসারী এই অবহেলাকে ‘অদৃশ্য অসমতা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং নারীবান্ধব কৃষিনীতি গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন।
এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, অতিবৃষ্টি, খরার ঝুঁকি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে কৃষকের ক্ষতির পরিমাণ ক্রমেই বাড়ছে। অথচ প্রণোদনা, কৃষি বীমা বা ঝুঁকিহ্রাস ব্যবস্থা কার্যকর নয় বলেই কৃষক প্রতিবারই ক্ষতিগ্রস্ত হন। তিনি বলেন, “জলবায়ু সহনশীল প্রযুক্তি ও কৌশল কৃষি ব্যবস্থায় দ্রুত অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।”
প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশও করা হয়েছে:
- কৃষকদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দামের নিশ্চয়তা
- সরাসরি বিক্রির জন্য ডিজিটাল ও স্থানীয় বাজার ব্যবস্থার উন্নয়ন
- কৃষি ভর্তুকির প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও লক্ষ্যভিত্তিক বণ্টন
- আধুনিক গুদাম ও পরিবহন অবকাঠামোর উন্নয়ন
- নারী কৃষকদের জন্য বিশেষ সহায়তা ও প্রশিক্ষণ
- প্রান্তিক কৃষকের জন্য সহজ শর্তে কৃষিঋণ প্রদান
- জলবায়ু সহনশীল চাষাবাদে গবেষণা ও বিনিয়োগ
ড. আনসারী মনে করেন, “কৃষকদের উন্নয়ন ছাড়া দেশের খাদ্য নিরাপত্তা একটি তাত্ত্বিক শব্দ হয়েই থাকবে। আমরা যদি কৃষকের ঘরে খাদ্য নিশ্চিত করতে না পারি, তবে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা পূর্ণতা পাবে না।”