Tuesday 19th of March 2024
Home / ফসল / মরিচের উচ্চফলনশীল জাত ‘বিনামরিচ-২’-এর বৈশিষ্ট্য ও চাষ পদ্ধতি

মরিচের উচ্চফলনশীল জাত ‘বিনামরিচ-২’-এর বৈশিষ্ট্য ও চাষ পদ্ধতি

Published at জানুয়ারি ২৭, ২০২২

বিনামরিচ-২

উদ্ভাবনের ইতিহাস

অগ্রবর্তী লাইন IndoCF-25-1 ২০১৭ সালে ইন্দেনেশিয়ার একটি স্থানীয় জাত থেকে কৌলিক সারি হিসেবে সংগ্রহ করা হয়। সন্তোষজনক ফলন, রোগ-বালাই ও পোকামাকড়ের প্রতি সহনশীলতা, সংরক্ষণক্ষমতা এবং পরিমিত ঝাল হওয়ায় IndoCF-25-1 লাইনটিকে ২০২০ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক “বিনামেরিচ-২” নামে সারাদেশে চাষাবাদের জন্য অনুমোদিত হয়।

বিনামরিচ-২ এর বৈশিষ্ট্যাবলী

  • উচ্চ ফলনশীল, প্রচলিত জাতের তুলনায় ফলন প্রায় ১.৫ গুণ বেশী।
  • গাছ লম্বা, ঝোঁপালো এবং প্রচুর শাখা প্রশাখা বিশিষ্ট হয়।
  • ফল কাঁচা অবস্থায় গাঢ় সবুজ এবং পাকা অবস্থায় আকর্ষনীয় লাল রংয়ের হয়ে থাকে।
  • কাঁচা মরিচের ঝাল বেশি, ফল সুগন্ধিযুক্ত এবং ত্বক পুরু।
  • প্রতি গাছে মরিচের সংখ্যা ১৫০-২০০ টি, ফলের দৈর্ঘ্য ১০-১৫ সে.মি. এবং প্রস্থ ৩-৪.৫ সে.মি.।
  • কাঁচা মরিচ সংগ্রহের ৮-১০ দিন পযন্ত স্বাভাবিক অবস্থায় ব্যবহার উপযোগী।
  • প্রথম মরিচ সংগ্রহের পর ফলের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
  • জীবনকাল ১৮০-২১০ দিন, ফলন ২৯-৩২ টন/হে.।

উৎপাদন কলাকৌশল

মাটি ও আবহাওয়া

মরিচ উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় ভালো জন্মে। সাধারণত ২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থেকে ২৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা মরিচ চাষের জন্য উপযোগী। পানি নিষ্কাশনের সুবিধাযুক্ত বেলে-দো-আঁশ থেকে এঁটেল-দো-আঁশ মাটিতে মরিচ চাষ করা যায়। বিনামরিচ-২ জাতটি চাষের জন্য জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ বেলে দো-আঁশ বা পলি দো-আঁশ মাটি চাষের জন্য উপযোগী।

উৎপাদন মৌসুম

বিনামরিচ-২ সারা বছর চাষ করা যায় তবে রবি মৌসুমে ফলন ভালো হয়। আশ্বিন মাসের শেষ সপ্তাহ হতে কার্তিক মাসের মাসের মাঝামাঝি (মধ্য অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ) পযন্ত বীজতলায় বীজ বপন করতে হবে। কার্তিক মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ হতে শেষ সপ্তাহ (অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে মধ্য নভেম্বর) পর্যন্ত একমাস বয়সী চারা লাগানোর উপযুক্ত সময়।

জমি তৈরি

তিন থেকে চারটি গভীর চাষ ও জমিতে শেষ চাষের আগে মই দিয়ে আগাছা পরিস্কার করে জমি তৈরী করতে হবে। মাটির ঢেলা ভেঙে মাটি ঝুরঝুর ও সমতল করে নিতে হবে। জমি তৈরিতে শেষ চাষের আগে জৈব এবং রাসায়নিক সার (ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি এবং জিপসাম) প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়া পানি নিষ্কাশনের জন্য পাশাপাশি দুটো বেডের মাঝখানে ৫০ সেমি. প্রশস্ত এবং ১০ সেমি. গভীরতা বিশিষ্ট নালা রেখে ১ মিটার চওড়া এবং ১০-১৫ সেমি. উঁচু বেড তৈরি করতে হবে।

বীজের হার ও রোপণ পদ্ধতি

মরিচ সাধারণত দুই পদ্ধতিতে চাষ করা যায়। যথা: ১. সরাসরি ক্ষেতে বীজ বপন ২. বীজ হতে চারা তৈরি করে । রবি ও খরিফ উভয় মৌসুমে বীজতলায় চারা তৈরি করলে ১-১.৫ কেজি/হে. বীজের প্রয়োজন হয়। আবার সরাসরি ছিটিয়ে মরিচ চাষাবাদ করলে হেক্টরপ্রতি ৪-৫ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়। জমিতে বীজ বপনের আগে ১২ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রেখে, পানি থেকে উঠিয়ে হালকা ছায়াতে ২ গ্রাম/কেজি হারে প্রভেক্স (বীজ শোধনকারী ছত্রাকনাশক) মিশিয়ে শুকিয়ে ঝরঝরা করে মূল জমিতে ছিটিয়ে দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যাতে বীজ কোনো ক্রমেই ১-১.৫ সেমি. মাটির গভীরে যেন না যায়। বপনের সময় জমিতে পর্যপ্ত পরিমাণ আর্দ্রতা বজায় রাখতে হবে। প্রয়োজনে বীজ বপনের ২-৩ দিন পর হালকা করে সেচ দিতে হবে এতে বীজ তাড়াতাড়ি গজাবে। সরাসরি ছিটিয়ে বপন করলে ১৫-২০ সে.মি. পরপর গাছ রেখে পাতলা করতে হবে। চারা রোপনের ক্ষেত্রে ৩০-৩৫ দিন বয়সের সুস্থ চারা, সারি থেকে সারির দুরত্ব ৫০-৫৫ সে.মি. ও চারা থেকে চারার দুরত্ব ৪০-৪৫ সে.মি. হলে অধিক ফলন পাওয়া যায়। বীজ হতে চারা তৈরী করে রোপন করলে প্রতি হেক্টরে ৫০০-৬০০ গ্রাম বীজ এবং বিঘাপ্রতি ৫০০০টি চারার প্রয়োজন হয়

সার ব্যবস্থপনা ও প্রয়োগ পদ্ধতি

নিম্নোক্ত হারে জমিতে সার প্রয়োগ করতে হবে:

সারের নাম সারের পরিমাণ (কেজি)
হেক্টর প্রতি একর প্রতি বিঘাপ্রতি
গোবর/কম্পোস্ট ৮-১০ টন ৩-৪ টন ১-২ টন
ইউরিয়া ২২০ ৯০ ৩০
টিএসপি ৩০০ ১২৫ ৪০
এমওপি ২০০ ৮৫ ২৫
জিপসাম ১০০ ৪৫ ১৫
জিংক বা দস্তা ০.৪ ০.১৪
বোরন ১.৫ ০.৬ ০.২

শেষ চাষের সময় সম্পূর্ণ গোবর বা কম্পোস্ট, টিএসপি, জিপসাম, জিংক এবং বোরন সার জমিতে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। বাকি এমওপি এবং ইউরিয়া সার তিন  কিস্তিতে চারা রোপনের  ১৫, ৪০ এবং ৭৫ দিন পর জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। এমওপি সার সেচের পূর্বে গাছের গোড়া থেকে ১০-১৫ সে.মি. দূরে নিড়ানী দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া উত্তম। প্রতি কিস্তি সার জমিতে সেচ দেওয়ার পর পানি বের করে দিয়ে অর্থাৎ জমিতে সেচ দেওয়ার পর যখন কোনো পানি জমিতে জমে না থাকে সে সময় সার প্রয়োগ করতে হবে।

আন্তঃপরিচর্যা

জমিতে আগাছার পরিমাণের ওপর নির্ভর করে নিড়ানি দিতে হবে। জমিতে কোনক্রমেই আগাছা রাখা যাবে না। বোনা মরিচের ক্ষেত্রে চারা গজানোর ২৫-৩০ দিন পর ২-৩ ধাপে প্রতি মিটার এ ১২-১৫টি গাছ রেখে পাতলা করে দিতে হবে। মাটিতে অতিরিক্ত আর্দ্রতা মরিচ সহ্য করতে পারে না অন্যদিকে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানির অভাবে গাছের ফুল ঝড়ে যেতে পারে। জমির আর্দ্রতার ওপর নির্ভর করে ৩/৪টি সেচ দিতে হবে। ফুল আসার সময় এবং ফল বড় হওয়ার সময় জমিতে পরিমাণমতো আর্দ্রতা রাখতে হবে। সেচের পর মাটিতে চটা বাঁধলে নিড়ানি দিয়ে ভেঙে মাটি ঝুরঝুরে করে দিতে হবে তাতে শিকড় প্রয়োজনীয় বাতাস পায় এবং গাছের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়।

ফসল সংগ্রহ

চারা লাগানোর ৩৫-৪০ দিন পর গাছে ফুল আসতে শুরু করে, পরবর্তী ২৮-৩০ দিনের মধ্যে কাঁচা মরিচ সংগ্রহ করা যায় এবং ৭৫ থেকে ৮০ দিনের মধ্যে ফল পাকতে আরম্ভ করে। কাঁচা অথবা পাকা অবস্থায় মরিচ তোলা হয়। সাধারনত ৬-৮ বার ফসল সংগ্রহ করা যায়। মরিচ সাধারণত রৌদ্রজ্জ্বল দিনে উত্তোলন করলে মরিচের গুণগতমান ভালো থাকে তাতে বাজার মূল্য বেশি পাওয়া যায়।

মরিচের বীজ/চারা পেতে এবং বিস্তারিত আরো জানতে : ড. মো. শামছুল আলম, ঊর্ধধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বিনা। মোবাইল: ০১৭১১১২৪৭২২

লেখক ও পরিচিতি:

ড. মো. রফিকুল ইসলাম, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং বিভাগীয় প্রধান, উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ, বিনা, বাকৃবি চত্বর, ময়মনসিংহ-২২০২

ড. মো. শামছুল আলম, ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ, বিনা, বাকৃবি চত্বর, ময়মনসিংহ-২২০২  

মো. নাজমুল হাসান মেহেদী, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ, বিনা, বাকৃবি চত্বর, ময়মনসিংহ-২২০২  

 

This post has already been read 6510 times!