Friday 29th of March 2024
Home / অর্থ-শিল্প-বাণিজ্য / চালের দাম নির্ধারণে কাজ করছে তৃতীয় শক্তি

চালের দাম নির্ধারণে কাজ করছে তৃতীয় শক্তি

Published at জানুয়ারি ৮, ২০২২

নিজস্ব প্রতিবেদক: “দেশের চালের মূল্য নির্ধারণে প্রচলিত বাজারে সরবরাহ ও চাহিদা শক্তির পরিবর্তে অন্য কোন তৃতীয় শক্তি কাজ করছে অথবা অন্য কোন বাজার সেক্টরের নিকট বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রয়েছে” বলে মতামত দিয়েছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)। এছাড়াও বিআইডিএস সূত্র উল্লেখ করে ব্রি বলছে, একটি গবেষণায় দেখা যায় বাংলাদেশে শীর্ষ ৫ ধান ও চাল ব্যবসায়ীদের কাছে মোট উৎপাদনের প্রায় ২০ ভাগ ধান ও চাল মজুদ থাকে। এছাড়াও ২০২০ সালে ব্রির বিজ্ঞানীদের এক গবেষণায় পাওয়া যায় চালের বাজারের শতকরা ৩৩ ভাগ মিলারদের নিয়ন্ত্রণে (Rahman et al., 2020)। ব্রি বলছে- এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বাজার নিয়ন্ত্রণে বড় ব্যবসায়ীদের হস্তক্ষেপ রয়েছে।

“চাল আমদানিতে দ্বিতীয় বাংলাদেশ, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দাবি কতটা যৌক্তিক?” শীর্ষক সংবাদের বিষয়ে ব্রি’র মতামতে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এছাড়াও চালের মূল্য বিস্তার (price spread) বিশ্লেষণ থেকেও বাজারের মধ্যস্বত্বভোগী বিশেষ করে মিলার, আড়ৎদার এবং পাইকাররা অতি মুনাফা অর্জন করার বিষয়টিও উঠে এসেছে উক্ত মতামতে।

ব্রি বলছে- সাধারণত সরবরাহ বাড়লে দাম কমে যায়, ঘাটতি থাকলে দাম বেড়ে যায়। কিন্তু যখন সরবরাহের এই সাধারণ নীতিটি কাজ করে না তখন বুঝতে হবে বাজারকে কেউ manipulate করছে। আমরা একটি দীর্ঘমেয়াদি বার্ষিক Marketable surplus এবং Market price এর মধ্যে সামগ্রিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে দেখেছি যে, ১৯৯১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত চালের উদ্বৃত্ত এবং দামের মধ্যে বিপরীতমুখী সম্পর্ক রয়েছে। অর্থাৎ চালের সরবরাহ বাড়লে দাম কমে যায়। কিস্তু ২০০৯ থেকে ২০২০ পর্যন্ত এই সম্পর্ক সমমুখী ছিল, অর্থাৎ চালের সরবরাহ বাড়লেও দাম কমে নাই, বরং ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং, বার্ষিক চালের উদ্বৃত্ত এবং দামের মধ্যে সামগ্রিক সম্পর্ক থেকে দেখা যায় যে, চালের মূল্য নির্ধারণে প্রচলিত বাজারে সরবরাহ ও চাহিদা শক্তির পরিবর্তে অন্য কোন তৃতীয় শক্তি কাজ করছে অথবা অন্য কোন বাজার সেক্টরের নিকট বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে- সাম্প্রতিককালে বাজারে চালের মূল্য অপ্রত্যাশিতভাবে বাড়তে থাকায় কৃষক, ভোক্তা, সরকার এবং নীতিনির্ধারকদের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তাই ব্রি, বাংলাদেশে চালের মূল্য বৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধানের জন্য মাঠ পর্যায়ে একটি জরিপ সম্পন্ন করে যা আন্তর্জাতিক একটি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে (Rahman et al., 2021)। প্রকাশিত গবেষণা পত্রে চালের মূল্য বৃদ্ধির নিম্নোক্ত কারণগুলো উঠে এসেছে যেমন: (১) ব্যবসায়ী ও মিল মালিকরা করোনা পরিস্থিতিতে খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা করে ধান ও চালের মজুদ ধরে রেখেছিলো, ফলে বাজারে সরবরাহ কমে গিয়েছিল; (২) বড় মিল মালিক ও ব্যবসায়ীদের আধিপত্য এবং অসম প্রতিযোগিতা; (৩) প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ধানের জমি ও উৎপাদন তথ্যের অসামঞ্জস্যতা। এটিকে পুঁজি করে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বাজারে ধান-চালের ঘাটতির অপপ্রচার করে। তাদের ধারণা সরকার যে তথ্য প্রকাশ করে, তার প্রায় ৩০ ভাগ over-estimation করা হয়; (৪) করোনা কালীন ভোক্তা পর্যায়ে চালের মজুদ বাড়ানো (panic buying); ৫) প্রায় সকল কৃষকই ধান কর্তনের প্রথম মাসের মধ্যে বাজারজাতযোগ্য উদ্বৃত্তের একটা বড় অংশ বিক্রি করে দেয়। কিন্তু গত বোরো ও আমন মৌসুমে করোনা পরিস্থিতিতে ধান বিক্রির ধরনটি পরিবর্তিত হয়েছে। কৃষকরা তাদের ধান মজুদ থেকে ধীরে ধীরে বিক্রি করেছে, এতে সরবরাহ চেইন কিছুটা সংকুচিত হয়েছিল; (৬) সরকার কর্তৃক কম চাল সংগ্রহ ও আমদানি বিলম্বিত হওয়া এবং বাজারে প্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপের অভাব; (৭) ধান চাষের ব্যয় ও প্রক্রিয়াজাতকরণের খরচ বৃদ্ধি; এবং (৮) মৌসুমী ব্যবসায়ীর সংখ্যা বৃদ্ধি।

দেশের খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ এবং সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বলা যায় যে, এছাড়াও চাল আমদানি করে বাজার নিয়ন্ত্রণের চিন্তাটি অকার্যকর, মনে করছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। প্রতিষ্ঠানটি মনে করছে, চাল আমদানির পরিমাণ নির্ধারণ করে দিতে হবে যেন কেউ অধিক পরিমাণ আমদানি করতে না পারে। চাল আমদানিকে নিরুৎসাহিত করার লক্ষ্যে শুল্ক আইন প্রয়োগ ও শুল্কের পরিমাণ বৃদ্ধিকরণ এবং ক্ষণস্থায়ী খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা দূরীকরণে সরকারি পর্যায়ে বাফার স্টক হিসেবে খাদ্য মজুদ সক্ষমতা জরুরি বিবেচনায় বাড়াতে হবে। সরকারি পর্যায়ে সময়মতো ও সঠিক তথ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। তথ্য বিভ্রাট ও ভোক্তার স্বার্থ রক্ষার্থে যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন ও যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি, সরকারকে একজন গুরুত্বপূর্ণ এক্টর হিসেবে বাজারে বিশেষ ভূমিকা পালন করার কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে, তাহলেই কৃষক, ব্যবসায়ী ও ভোক্তার স্বার্থ অক্ষুন্ন থাকবে।

This post has already been read 5649 times!