Friday 29th of March 2024
Home / উদ্যোক্তা কথন / সাংবাদিক থেকে কৃষি উদ্যোক্তা একজন শাহজাহান শাহীম

সাংবাদিক থেকে কৃষি উদ্যোক্তা একজন শাহজাহান শাহীম

Published at সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২০

শাহজাহান শাহীম

আব্দুল্লাহ আল মাহাদী : বাংলাদেশের অর্গানিক কৃষি উদ্যোক্তাদের মধ্যে শাহজাহান শাহীম এক অনন্য ও সুপরিচিত নাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে কৃতিত্বের সাথে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে কৃষির মত অবহেলিত পণ্য নিয়ে কারবার করা অনেক সাহসের ব্যাপার বটে। শিক্ষিত ছেলে চাকরি না করে ব্যবসা করবে- এটাই যখন মেনে নেয়া কঠিন, তখন কৃষি পণ্য নিয়ে ব্যবসা করা তো মহা কঠিন ব্যাপার! এই কঠিন ব্যাপারটাকে জয় করতে পেরেছেন বলেই আজ চারিদিকে তার সুনাম-সুখ্যাতি! সম্মাননা পদক আর প্রশংসা কুড়িয়েছেন অনেক, অসংখ্য মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জন করেছেন অল্পদিনেই। তবে হঠাৎ করেই এই ভালোবাসা অর্জিত হয়নি, অন্য দশজন উদ্যোক্তার মতই তিনিও শুরুতে নানারকম লাঞ্ছনা, অবহেলা ও অসহযোগিতার শিকার হয়েছেন, অনেকের হাসির পাত্রও হয়েছেন। তবে প্রবল ধৈর্য ও ইচ্ছা শক্তি সেসব পরিস্থিতি মোকাবেলা করে তাকে সফলতা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে সম্মানজনক চাকরি করতেন, পেশায় ছিলেন একজন সাংবাদিক। দেশের নামকরা এক টিভি চ্যানেলের প্রখ্যাত সাংবাদিক ছিলেন, সেখানেও অত্যন্ত সুনাম ও সফলতা অর্জন করেছিলেন। কিন্তু সাংবাদিকতা করতে গিয়ে অনেক কিছুর নীরব স্বাক্ষী হতে হয়েছে তাকে, অনেক কিছু খুব কাছ থেকেই দেখতে পেরেছেন তিনি- মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক চাহিদা ‘খাদ্য’র মধ্যেই বিষ প্রয়োগ হচ্ছে। খাদ্যের নামে মানুষ কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে প্রতিনিয়ত বিষ কিনে খাচ্ছে। ফলে দেশে অসুস্থতার হার বাড়ছে, আয়ুষ্কাল কমছে মানুষের, বিকলাঙ্গ ও প্রতিবন্ধী শিশু জন্মাচ্ছে ঘরে ঘরে। রাতভর শাহীমের চোখের সামনে এই দৃশ্যগুলো ভেসে বেড়াতো, বিবেকের তাড়নায় নির্ঘুম কাটতো অনেক রাত! কিছু একটা করা দরকার, বিষের ছোবল থেকে জীবনগুলো বাঁচানো দরকার! কিন্তু এতোবড় কাজ কীভাবে সম্ভব? ‘অসম্ভব’ ভেবে বসে থাকার মত মানুষ শাহীম নন। যেই ভাবা সেই কাজ- উন্নত জাতের কিছু বীজ সংগ্রহ করে গ্রামে  ‘মনা মিয়া’ নামে এক কৃষকের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। এদিকে মাত্র ১০ কেজি হাতে ভাজা সারমুক্ত মুড়ি সংগ্রহ করে বিপণনের কাজ শুরু করলেন। সেই থেকে শুরু। মাত্র ৪০০ টাকা মূলধন হতে আজ প্রায় ৪০ লাখ টাকার ব্যবসা তার। রাজধানীর মৌচাকে ‘চিত্রা অর্গানিক কৃষিবাজার’ নামে সুপরিচিত প্রতিষ্ঠানটির একমাত্র মালিক তিনি। বিভিন্ন জায়গায় এর আরো ৪ টি বিপনন শাখাও রয়েছে। নিজ গ্রাম ছাড়িয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অসংখ্য ক্ষেত-খামার গড়ে তুলেছেন, দেশি মাছ চাষে বিশাল আকৃতির ঘের-পুকুরও রয়েছে তার। প্রশিক্ষিত ও বিশ্বস্থ কৃষক দিয়ে সেখানে শতভাগ অর্গানিক কৃষি উৎপাদন করছেন তিনি। সেসব পণ্য অন্য উদ্যোক্তাদেরকেও সরবরাহ করছেন, নিজের প্রতিষ্ঠানেও বিক্রয় করছেন।

হাতে ভাজা মুড়ি, লাল আটা, ঘানি ভাঙ্গা সরিষার তেল, তিলের তেল, খাঁটি ঘি, সুন্দরবনের মধু, আউশ ধানের চাল, কাউন চাল, লাল বিন্নি চাল, কুমড়ো বড়ি, মাশরুম, সারমুক্ত সবজি, আখের গুড়, লাল চিনি, গরুর খাঁটি দুধ, মওসুমি ফল-ফলাদি, যবের ছাতু, হাতে ভাজা সেমাইসহ প্রায় ১২০ ধরনের বিষমুক্ত খাঁটি পণ্য বিক্রয় হয় শাহীমের চিত্রা অর্গানিক কৃষি বাজারে। শহরে বসবাস করেও গ্রামবাংলার খাঁটি পণ্য পেতে অনেকেই তার গ্রাহক তালিকায় নাম লিখিয়েছে এই ১৬ বছরে। রাজধানীতে অন্তত ৫-৬ হাজার নিয়মিত গ্রাহক তৈরি হয়েছে তার, যারা একটু বেশি দাম দিয়ে হলেও খাঁটি পণ্য খেয়ে সুস্থ্য জীবন যাপন করতে চায়, অর্গানিক পণ্যের অপেক্ষায় থাকে।

শাহীম বলেন, ব্যবসায়ের মূলধন হলো সততা ও ধৈর্য্য, দুটোই সমান গুরুত্বপূর্ণ। অধিকাংশ উদ্যোক্তার মধ্যে সততা থাকলেও ধৈর্য্য না থাকার ফলে তারা অল্পদিনে হতাশ হয়ে পড়ে, হাল ছেড়ে পালায়।

শাহীমের সফলতার রহস্য খুঁজতে গিয়ে কয়েকটা বিষয় মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করেছি, যা যেকোন উদ্যোক্তাকে সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছতে সহযোগিতা করবে। শাহীম অত্যন্ত পরিশ্রমী একজন মানুষ। যতক্ষণ পারেন নিজের কাজ নিজেই করেন, তার প্রতিষ্ঠানে মালিক আর কর্মচারীর পার্থক্য বুঝা যায় না। উচ্চশিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও কখনো কোন কাজকে ছোট মনে করেন না তিনি। একজন গ্রাহক কী চাচ্ছেন তা দিয়ে বিদায় করতে পারলেই দায়িত্ব শেষ নয়; বরং ঐ গ্রাহক যেন পরের দিন আবার তার কাছে আসেন  সেই দিকেই বেশি গুরুত্ব দেন তিনি। গ্রাহকের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন, প্রয়োজনে পণ্য হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা করেন। এই করোণাকালে তার অনেক গ্রাহক রয়েছে যারা নিয়মিত  হোম ডেলিভারি সেবা নিচ্ছেন।

শাহীম জানান, কখনো কোন বৃদ্ধ বা অসুস্থ লোক ওজনে ভারি কিছু ক্রয় করতে আসলে তিনি জানার চেষ্টা করেন যে, পরিবারে অন্যকেউ বাজার করার মত আছে কিনা। যদি সেরকম কেউ না থাকে তাহলে তিনি কর্মচারী দিয়ে তাদের ঘরে বাজার পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থাও করেন। শাহীম বলেন, এই শহরে এমন অনেক পরিবার রয়েছে, যেখানে হয়তো কেবল একজন বৃদ্ধ ও বৃদ্ধার বসবাস, ছেলেমেয়ে থাকে বিদেশে, কাড়িকাড়ি টাকাও আছে হয়তো, কিন্তু তাদের যতœ নেয়ার লোক নেই। শাহীম সেইসব মুরব্বীদেরকে বলেন, ‘আপনি কষ্ট করে আর এখানে আসবেন না, কী লাগবে শুধু ফোনে জানাবেন, আমার কর্মচারী যদি নাও পারে আমি নিজে আপনার বাসায় বাজার পৌঁছে দেবো’।

শাহীম কেবল একজন সফল ব্যবসায়ী নন; বরং একজন সমাজসেবী ব্যক্তিত্ব। বহু সমাজসেবামূলক সংগঠনের সাথে তার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। এই করোণাকালে তিনি অভূক্ত প্রাণীদেরকে খাবার খাওয়ানোর একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। ইয়াংস্টার কমিউনিটি বাংলাদেশ নামে তার একটি সংগঠন দেশের বিভিন্ন জায়গায় রাস্তা-ঘাটে অবহেলার শিকার অসংখ্য কুকুর-বিড়ালকে খাবার সরবরাহ করছে এবং করবে। ছন্নছাড়া পথশিশু ও মানসিক ভারসাম্যহীন পাগল লোকদেরকেও  খাবার সরবরাহ করছে তার সংগঠনটি।

শাহীমের একটি প্রিয় উক্তি আছে- ‘এক হলে পারি, একা হলে হারি’। তিনি বলেন, সারা দেশে বিষমুক্ত খাবার নিশ্চিত করা যেমন একার পক্ষে সম্ভব নয়; তেমন এই অভূক্ত প্রাণীদেরকেও খাবার সরবরাহ করা একার পক্ষে সম্ভব নয়। এটি কেবল একটি আন্দোলনের সূচনা, আমাদেরকে দেখে অন্যরাও যখন কাজটি করা শুরু করবে তখনই আমাদের সফলতা আসবে।

শাহীমের চিত্রা অর্গানিক কৃষি বাজার কেবল একটি ব্যবসায়িক উদ্যোগ নয়; বরং এটি একটি দৃষ্টান্ত। শাহীম বলেন, যদি ব্যবসা হিসেবে কোন উদ্যোগ নেয়ার কথা ভাবতাম তাহলে বিকল্প আরো অনেক কিছু ছিলো, কিন্তু আমার উদ্যোগটা হলো সমাজকে বিষের ছোবল থেকে বাঁচানো। তাই আমার কোন ব্যবসায়ী প্রতিদ্বন্দীও নাই, বরং আমার এই আন্দোলনটা ছড়িয়ে পড়–ক সারা দেশে, আরো অসংখ্য শিক্ষিত তরুন উদ্যোক্তা তৈরি হোক- সেটাই আমার মূল চেষ্টা।

নিরাপদ খাদ্য চাই-নিখাচা’র অন্যতম একজন উপদেষ্টা শাহজাহান শাহীম। এ ছাড়াও আরো অনেক আন্দোলন এবং সংগঠনে সরব রয়েছেন এই কৃষি উদ্যোক্তা। সফল এই উদ্যোক্তার জন্ম খুলনা জেলার তেরখাদা উপজেলায়। তার পিতা মরহুম আবুল কালাম মোল্যা ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। প্রাথমিক শিক্ষা জীবন কেটেছে নিজ গ্রাম নাচুনিয়ায়। এরপর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক লেখাপড়া শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন হতে ঢাকা শহরে বসবাস। শেষ জীবনে তিনি নিজ গ্রামে ফিরে গিয়ে মানুষের সেবা করতে চান, গ্রামের নির্মল স্নিগ্ধ বাতাসে মন ভরে নি:শ্বাস নিতে চান, কাঁদা-মাটির গন্ধে মন জুড়াতে চান, হারিয়ে যেতে চান পূর্ব-পুরুষদের ঠিকানায়।

This post has already been read 4899 times!