Thursday 25th of April 2024
Home / বিজ্ঞান ও গবেষণা / এসডিজি৭ অর্জনে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)

এসডিজি৭ অর্জনে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)

Published at জুলাই ১৮, ২০২০

মোহাম্মদ আফজাল হোসাইন : জাতিসংঘ, পরিবর্তনশীল বিশ্বের সমতা ও বৈষম্যহীন উন্নয়ন নিশ্চিত করতে Sustainable Development Goal (SDG) টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) শিরোনামে ১৭ টি লক্ষ্য (এসডিজি) নির্ধারণ করেছে। টেকসই উন্নয়ন একটি সামাজিক পরিভাষা। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ Sustainable Development। টেকসই উন্নয়ন হচ্ছে নিজে ভোগ করে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটু ভালো অবস্থায় রেখে যাওয়া। বলা যায় এ বিশ্ব বা দেশ পূর্ববর্তী প্রজন্মের কাছ থেকে ধার নিয়েছি আমরা। রেখে যেতে হবে আরও ভালো অবস্থায়। কবি সুকাšেতর কথায় বলি চলে যাব-তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ/ প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল/ এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি নব জাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার। এ অঙ্গীকার পূরণের জন্য্ই এ লক্ষ্যমাত্রা। টেকসই উন্নয়ন বলতে শুধু ভবিষ্যত প্রজন্মের চাহিদা পূরণের জন্য বর্তমান প্রজন্মের ভোগ সীমিতকরণকেই বোঝায় না, বরং এটি সংখ্যালঘিষ্ঠের অটেকসই ভোগের কারণে বর্তমান প্রজন্মের অবশিষ্ট জনগোষ্ঠির মোলিক চাহিদা পূরণের প্রক্রিয়া টেকসই উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত না হয় তাও নিশ্চিত করে। অন্য কথায়, টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থনৈতিক  উন্নয়ন এবং সামাজিক  ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে সমবণ্টন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রনালয় থেকে বলা হয়েছে টেকসই উন্নয়ন মূলত একটি প্রক্রিয়া, যা দ্বারা জনগণ তাদের চাহিদা মেটায়, তাদের বর্তমান জীবনযাত্রার মানের উন্নতি ঘটায় এবং সেই সাথে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে তাদের আপন চাহিদা পূরণ করতে পারে তাদের সেই সামর্থ্যকে সুরক্ষা করে। টেকসই উন্নয়নে পরিমাণগত দিক অবজ্ঞা করে কোয়ালিটি উন্নয়ন  নিশ্চিত করতে হবে।

সৌরশক্তি ব্যবহার করে শস্য ঝাড়াই করা হয়।

সারাবিশ্বের উন্নয়ন টেকসই করতে এতে রয়েছে ১৬৯ টি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য। লক্ষ্যমাত্রা৭ হলো: সবার জন্য সহজলভ্য, নির্ভরযোগ্য, টেকসই, সামর্থ্যসাধ্য ও আধুনিক শক্তিপ্রাপ্ত জ্বালানি নিশ্চিত করা। বাংলাদেশের জন্যে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সৌরশক্তির ব্যবহার হতে পারে গূরূত্বপূর্ণ নিয়ামক ও অর্জন।

গ্রীষ্মমন্ডলীয় দেশ হওয়ায় অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশে সৌরশক্তির প্রাচুর্য রয়েছে। সাধারণ সৌর আলোকে শক্তির মাত্রা প্রতিদিন বর্গমিটারে ৪.০ থেকে ৬.৫ কিলোওয়াট-ঘণ্টা এবং প্রখর সূর্যালোক প্রতিদিন ৬-৯ ঘণ্টার মধ্যে উঠানামা করে। সুতরাং বাংলাদেশের জন্য সৌর শক্তিচালিত কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার প্রযুক্তিগত কারণেই উপযোগী। সৌর কোষ অপেক্ষাকৃত ব্যয়বহুল হওয়ায় এর গ্রহণযোগ্যতা কম। প্রযুক্তির অগ্রসরতায় এর মূল্য উল্লেখ্যযোগ্য হারে কমছে। যেখানে বিদ্যুৎ সুবিধা নেই সেসব অঞ্চল সেচের আওতায় আনা প্রয়োজন। এই এলাকাগুলোতে ফসল উৎপাদনের জন্য সৌর পাম্প বসানো যেতে পারে। দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটে সেচ সমস্যা সমাধানের জন্য সৌরশক্তি চালিত সেচ পাম্প বিকল্প সেচ ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

বাংলাদেশে সেচের আওতায় জমির পরিমাণ শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ। সেচ যন্ত্রের স্বল্পতা, জ্বালানি সংকট, বিদ্যুতের অভাব ইত্যাদি কারণে অবশিষ্ট শতকরা ৪০ ভাগ জমি সেচের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। বোরো ধানে সেচের জন্য উৎপাদনের প্রায় এক পঞ্চমাংশ বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১৭ লক্ষ সেচ পাম্প রয়েছে, যার শতকরা ৮৩ ভাগ ডিজেল চালিত। প্রতি বছর প্রায় ৮০ কোটি  লিটার ডিজেল সেচ কাজে ব্যবহার হয়, যা কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে ভর্তুকির মাধ্যমে কৃষকের নিকট বিক্রয় করতে হয়। সেচ মৌসুমে অতিরিক্ত মূল্য দিয়েও কৃষকের জন্য জ্বালানি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। সেচ পাম্প দিয়ে পুকুর বা খাল থেকে ভুপৃষ্ঠস্থ পানি উঠিয়ে জমিতে দেয়া যায়। তদুপরি এ পাম্প দিয়ে প্রায় ২৫ ফুট নিচ থেকে পানি উঠানো যায়।

বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থানের কারণে সূর্য পূর্ব দিকে উদিত হয়ে দক্ষিণ দিক দিয়ে অতিক্রম করে পশ্চিম দিকে অস্ত যায়। সুতরাং সৌর প্যানেল থেকে সর্বাধিক শক্তি পেতে হলে সৌর প্যানেলকে দক্ষিণমুখি করে স্থাপন করতে হবে। সৌর প্যানেল দু’ভাবে স্থ্াপন করা হয়, নির্দিষ্ট ট্রেকার ও অটো ট্রেকারের সাহায্যে। বাংলাদেশের জন্য দক্ষিনমুখি করে ২৩.৫ ডিগ্রি আনত কোণে প্যানেল স্থাপন করলে মোটামুটি সারা বছর ধরে বেশি সূর্য রশ্মি পাওয়া যায়।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি), গাজীপুরে সৌর শক্তি দিয়ে কৃষি যন্ত্রপাতি চালানোর উপযোগিতা বিষয়ে গবেষণা চালানো হয়। কৃষি যন্ত্রপাতিগুলোর মধ্যে মাড়াই, ঝাড়াই যন্ত্র কম অশ্ব শক্তি দিয়ে চালানো হয়ে থাকে বিধায় প্রাথমিকভাবে সৌর শক্তি দিয়ে ঝাড়াই যন্ত্র ব্যবহারের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। এ জন্যে ব্রি অটোমোবাইল ওয়ার্কশপের ছাদে ২০০ ওয়াট সৌর প্যানেল বসিয়ে সৌর শক্তি সংগ্রহ করে ব্যাটারিতে সঞ্চয় করা হয়। এতে ০.৫ অশ্বশক্তি সম্পন্ন ডিসি মটর, কানেকটার ব্যবহার করা হয়। এতে রয়েছে একটি চার্জ কন্ট্রোলার যা অতিরিক্ত চার্জ বা ডিসচার্জে ব্যাটারি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে রক্ষা করে। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াকে চালু ও বন্ধ করার জন্যে একটি একসেলারেটর ব্যবহার করা হয়।

ব্যাটারিতে সঞ্চিত শক্তি দিয়ে কোনরূপ বাধা ছাড়াই মাড়াই, ঝাড়াই যন্ত্র চালানো হয়। এতে প্রতি ঘণ্টায় ৩২০ কেজি মাড়াই, ৬০০-৮০০ কেজি ধান ঝাড়াই করা সম্ভব হয়। এর সাহায্যে ধান, গম ছাড়া অন্যান্য দানাদার শস্য মাড়াই, ঝাড়াই করা যায়। শস্য সংগ্রহকালীন সময়ের পূর্বে ও পরে ব্যাটারিতে সঞ্চিত শক্তি দিয়ে ১৫ ওয়াটের চারটি বাতি জ্বালানো হয়। সৌর প্যানেল বসিয়ে সংগৃহীত সৌর শক্তি দু’ভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এক. সরাসরি সৌর শক্তি দিয়েও বাতি জ্বালানো যেতে পারে। অধিককন্তু এ শক্তি দিয়ে সাবমারসিবল পাম্পের সাহায্যে ভূউপরিস্থ পানি এবং ভ’গর্ভস্থ পানি সেচ ও আবাসিক কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। দুই. ব্যাটারিতে সঞ্চিত শক্তি দিয়ে যে কোন ডিসি লোড যেমন টিভি চালানো, মোবাইল চাজার, সোলার ফ্যান, টচ, পাওয়ার ব্যাংক, আলোর ফাঁদ ব্যবহার করা যায়।

বর্তমানে সৌর প্যানেলের দাম উল্লেখ্যযোগ্য হারে হ্রাস পাওয়ায় সৌর সেচ পাম্প অথনৈতিকভাবে ব্যবহার উপযোগী হচ্ছে। এখন বাংলাদেশে বিভিন্ন কোম্পানি বা এনজিও কর্তৃক সৌর পাম্প ব্যবহার হচ্ছে যা সম্পূর্ণ বিদেশ থেকে আমদানীকৃত। অধিকšতু সৌর পাম্প দুষনমুক্ত এবং পরিবেশ বান্ধব সেচ প্রযুক্তি। তাছাড়া সৌর পাম্প ব্যবহার নিশ্চিত ও ঝামেলা মুক্ত। ডিজেল চালিত পাম্প তেল, জ্বালানি, যন্ত্রাংশ ক্রয়, পরিবহন ও ব্যবহারে ঝামেলা পোহাতে হয়। অপর পক্ষে সৌর পাম্প একবার স্থাপন করলে অনেকদিন ঝামেলামুক্তভাবে চালনা করা যায়। যে সকল স্থানে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই, বিশেষ করে চর এলাকায় সেচের জন্য এ পাম্প উপযোগী।

সৌর পাম্পের প্রধান উপকরণ সৌর প্যানেল, যার দাম অপেক্ষাকৃত বেশী হলেও এর জীবনকাল ২৫ বৎসর। সৌর পাম্প চালাতে কোন প্রকার জ্বালানি লাগে না। একই সোলার পাম্প হতে প্রাপ্ত সৌরশক্তি সেচ মৌসুমে সেচ প্রদানে, শস্য সংগ্রহকালে ঝাড়াই, অন্য সময়ে পানি উত্তোলন ও বাতি জ্বালানোর কাজে ব্যবহার করা যায়। খুবই নগন্য মেরামত খরচ, দীর্ঘ জীবনকাল ও পরিবেশ বান্ধব হওয়ায় সৌর সেচ পাম্প ভবিষ্যতে ডিজেল  চালিত সেচ পাম্পের  জায়গা জুড়ে নেয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।  সূর্যালোকের প্রাচূর্য্য এ দেশের জন্য এক বিরাট আশির্বাদ যা সহায়ক শক্তি হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে যেমন- সৌরশক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তরে মাধ্যমে (সেচ পাম্প পরিচালনা, প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুতায়ন ইত্যাদি) জাতীয় গ্রীডের ক্রমবর্ধমান বৈদ্যুতিক চাপ হ্রাসকরণ সম্ভব। সেচ কাজে সৌরশক্তি ব্যবহার করে ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি করা যেতে পারে।

লেখক: বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি), গাজীপুর।

This post has already been read 4342 times!