মঙ্গলবার , ডিসেম্বর ৩ ২০২৪

সুস্বাদু অর্থকরি ফসল কাজু বাদাম

কৃষিবিদ ড. এম আব্দুল মোমিন: কাজু বাদাম বিদেশি ফসল। একটা সময় ধারনা করা হতো এটি আমাদের দেশে চাষ করা সম্ভব নয়। দেশের চাহিদার পুরোটাই ছিল আমদানী নির্ভর। কিন্তু আশার কথা হচ্ছে- সৌদি খেজুর, ভিয়েতনামি নারিকেল, চায়না কমলাসহ আর দশটি বিদেশি ফলের ন্যায় এখন দেশেই চাষ হচ্ছে এই সুস্বাদু একটি অর্থকরি ফসল। শুধু চাষই হচ্ছে না বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে এর প্রক্রিয়াজাত কারখানাও। নানা পরীক্ষানিরীক্ষার পর এখন এই কারখানায় প্রক্রিয়াজাতকৃত কাজুবাদাম বিশ্ববাজারে রপ্তানির প্রস্ততি চলছে। দামে চড়া তাই এটি চাষে লাভও বেশি। দেশে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি কাজুবাদাম বিক্রি হয় ৮০০ থেকে ১০০০ টাকায়। আগ্রহী পাঠক আসুন জেনে নেই কাজু বাদামের উৎপাদন প্রযুক্তি, পুষ্টিগুণ ও দেশে এটি চাষে সাম্প্রতিক সাফল্যের গল্প।

উদ্ভিদতাত্ত্বিক পরিচয় ও উৎপত্তিস্থল

কাজু গাছ এর বৈজ্ঞানিক নাম Anacardium occidentale; প্রতিশব্দ Anacardium curatellifolium। এটি সপুষ্পক অ্যানাকার্ডিয়েসি পরিবারের বৃক্ষ। বীজ থেকে চারা তৈরি করা হয়। বেলে দো-আশঁ মাটি অথবা পাহাড়ের ঢালে ভাল জন্মে। পূর্ণবয়স্ক গাছ ১০ থেকে ১২ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। পাতা অর্ধডিম্বাকার, দেখতে কাঁঠালের পাতার মতো। নভেম্বর থেকে জানুয়ারি কাজু বাদামের ফুল ফোটার সময়। এপ্রিল থেকে জুন মাসে ফল সংগ্রহ করা হয়। কাজুবাদামের দৈর্ঘ্য ৪ থেকে ৫ সেন্টিমিটার। এর ওজন ৫ থেকে ২০ গ্রাম হয়ে থাকে। কাজুবাদামের উৎপত্তিস্থল ব্রাজিল। বর্তমানে প্রধানত ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত, কেনিয়া, মোজাম্বিক, তানজানিয়া, মাদাগাস্কার প্রভৃতি দেশে কাজুবাদাম উৎপাদিত হয়ে থাকে।  আমাদের দেশে এক সময় বাদামটির চাষ হতো না বলেই চলে। ধারনা করা হয় ১৪৯৮ সালে ভাস্কো দা গামার হাত ধরে উপমহাদেশে এন্ট্রি ঘটে কাজু বাদামের। তারপর থেকে ছড়িয়ে পড়ে এর স্বাদের সুখ্যাতি। এখন তো দক্ষিণ আমেরিকা এবং আফ্রিকা মহাদেশের একাধিক দেশে এই বাদামটির চাষ হয়ে থাকে।

বাংলাদেশে কাজু বাদামের প্রাপ্তিস্থান

খাগড়াছড়ির পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের খেজুরবাগান, হর্টিকালচার সেন্টার, সেনানিবাস, নারানখাইয়া, পানখাইয়া পাড়া, কমলছড়ি ও জামতলী এলাকায় কাজুবাদামের গাছ চোখে পড়ে। এছাড়া রামগড় উপজেলার হর্টিকালচার সেন্টারেও রয়েছে কাজুবাদামের বাগান। পার্বত্য চট্টগ্রামে কাজুবাদাম চাষ সম্প্রসারণের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে মাঝারি আকারে কাজুবাদামের চাষ হয়েছে। অনাবাদি জমিতে পরিকল্পিতভাবে কাজুবাদাম চাষের যথেষ্ট সুযোগ আছে। ভবিষ্যতে খাগড়াছড়ির কৃষিপণ্যের মধ্যে কাজুবাদামও একটি বিশেষ স্থান করে নিতে পারে।

কাজু বাদামের বংশ বিস্তার

বীজ এবং কলম উভয় পদ্ধতিতেই কাজু বাদামের বংশ বিস্তার করা যায়। কলমের মধ্যে গুটি কলম, জোড় কলম, চোখ কলম ইত্যাদি উপায়ে কাজু বাদামের বংশ বিস্তার করা সম্ভব। একটি কাজু বাদাম গাছ ৬০-৭০ বছর পর্যন্ত বাঁচে এবং ৫০-৬০ বছর পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। বীজ থেকে পলি ব্যাগে চারা তৈরি করে কিংবা কলম প্রস্তুত করে জমিতে রোপণ করতে হবে। চারা রোপণের আগে ৭-৮ মিটার দূরত্ব বজায় রেখে ১ ঘনমিটার আয়তনের গর্ত তৈরি করতে হবে। গর্তে সবুজ সার এবং পরিমাণমত ইউরিয়া ও টিএসপি সার মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে ১৫ দিন পর চারা লাগাতে হবে। চারা গজালে একটি সতেজ চারা রেখে বাকি চারা তুলে ফেলতে হয়। বীজের পরিবর্তে চারা তৈরি করে নিয়েও রোপণ করা যায়। হেক্টর প্রতি প্রয়োজনীয় চারার সংখ্যা ২৪৫-৩৩৫ টি।

গাছের আন্ত: পরিচর্যা

কাজু বাদাম গাছে খুব একটা আন্ত:পরিচর্যা ও সার দেয়ার প্রয়োাজন হয় না। তবে ভাল ফলনের জন্য প্রতি ফলন্ত গাছে গোবর-৪০কেজি, ইউরিয়া-১কেজি, টিএসপি-১কেজি এবং এমপি সার ১কেজি প্রয়োগ করা যেতে পারে। এ ছাড়া পাতা শোষক পোকা ও পাতা কাটা পোকা প্রভৃতি কাজু বাদামের ক্ষতি সাধন করে। তাই পরিমিত পরিমাণে কীটনাশক প্রয়োগ করে কীটপতঙ্গ দমন করা যায়। আন্ত:পরিচর্যা বলতে আগাছা পরিষ্কার করা, মরা অপ্রয়োজনীয় ডাল ছাটাই করা বা প্রুনিং এবং সাথী ফসল চাষ করা যেতে পারে।

ফলন ও বাদাম সংগ্রহ

চারা রোপণের পর গাছের বয়স তিন বছর হলে প্রথম ফুল এবং ফল আসে। নভেম্বর থেকে জানুয়ারি ফুল ফোটার সময়। এপ্রিল থেকে জুন মাস কাজু বাদাম সংগ্রহকাল। গাছ থেকে সুস্থ ফল সংগ্রহ করে খোষ ছাড়িয়ে বাদাম সংগ্রহ করে তারপর ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে ভেজে প্যাকেট-জাত করা হয়। সাধারণত একটি গাছ থেকে ৫০-৬০ কেজি ফলন পাওয়া যায়। ১ কেজি ফল প্রক্রিয়াজাত করে তা থেকে গড়ে ২৫০ গ্রাম কাজু বাদাম পাওয়া যায়। জাতভেদে ফলনের তারতম্য হতে পারে।

প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি

কাজুবাদাম সাধারণত ভেজে খাওয়া হয়। পাহাড়ি এলাকায় সাধারণত কাজুবাদামকে দা দিয়ে কেটে খুঁচিয়ে শাঁস বের করা হয়। তারপর রোদে শুকিয়ে বীজের আবরণ তুলে ফেলা হয়। লবণ-জলে কিছুক্ষণ ভিজিয়ে তারপর ভাজা হয়। এতে লবণাক্ত স্বাদের কাজুবাদাম পাওয়া যায়। আর মিষ্টি স্বাদের কাজুবাদামের জন্য বাদাম ভাজার পর চিনির শিরায় ডুবিয়ে নেওয়া হয়। বিভিন্ন খাদ্যের স্বাদ বাড়ানোর জন্যও কাজুবাদাম ব্যবহার করা হয়। কারখানায় প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি ভিন্ন এবং অপেক্ষাকৃত নিরপাদ।

কাজু বাদামের পুষ্টিগুণ

শরীরিক উপকারিতার দিক থেকে কাজু বাদামের কোনও বিকল্প হয় না। এতে উপস্থিত প্রোটিন, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, খনিজ এবং ভিটামিন নানা ভাবে শরীরের উপকারে লেগে থাকে। শুধু তাই নয়, কাজু বাদামে ভিটামিনের মাত্রা এত বেশি থাকে যে চিকিৎসকেরা একে প্রকৃতিক ভিটামিন ট্যাবলেট নামেও ডেকে থাকেন। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত যদি কাজু বাদাম খাওয়া যায়, তাহলে শরীরে নান পুষ্টিকর উপাদানের ঘাটতি দূর হয়, সেই সঙ্গে আরও কিছু উপকার পাওয়া যায়। প্রতিদিন একমুঠো করে কাজু বাদাম খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। আসলে এই বাদমটির শরীরে রয়েছে প্রচুর মাত্রায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা ক্যান্সার সেলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলে। কাজু বাদামে থাকা প্রম্যান্থো সায়ানিডিন নামে একটি উপাদান এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রাকৃতিক উপাদানটিতে থাকা জিঙ্ক, ভাইরাসের আক্রমণের হাত থেকে শরীরকে রক্ষা করে। প্রতিদিন কাজু বাদাম খেলে হার্টের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা কমে। এতে উপস্থিত অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট একদিকে যেমন ক্যান্সার রোগকে দূরে রাখে, তেমনি নানাবিধ হার্টের রোগ থেকে বাঁচাতেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। কাজুতে রয়েছে ওলিসিক নামে এক ধরনের মোনো-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড, যা দেহে বাজে কোলেস্টরলের মাত্রা কমাতে দারুন কাজে আসে। তাই তো নিয়মিত এই বাদমটি খেলে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ফলে হার্টের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা হ্রাস পায়। কাজু বাদাম খেলে চুলের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়। কপার হল সেই খনিজ, যা চুলের ঔজ্জ্বল্য বাড়ানোর পাশাপাশি চুলের গোড়াকে শক্তপোক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। আর এই উপাদানটি প্রচুর পরিমাণে রয়েছে কাজুতে। আমাদের দেশে যে হারে সুগার রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে বাদাম খাওয়ার প্রয়োজন বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। কারণ একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে- প্রোটিন এবং ফাইবার সমৃদ্ধ এই খাবারটি নিয়মিত খেলে রক্তে সুগারের মাত্র নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আশঙ্কা কমে। সেই সঙ্গে শরীরর কর্মক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়।

কাজু বাদাম চাষে সাফল্যের গল্প

চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় ডেইলপাড়ায় দেশের প্রথম কাজুবাদামের সমন্বিত কারখানা প্রতিষ্ঠা করেছেন স্থানীয় উদ্যোক্তা শাকিল আহমেদ। শাকিল আহমেদ বলেন, পাহাড়ি এলাকার উৎপাদিত কাজুবাদাম তিনি ভারতে রপ্তানি করেন। বাংলাদেশ থেকে সেটিই ছিল কাঁচা কাজুবাদাম রপ্তানির প্রথম চালান। এরপর ২০১৬ সালে দেশের প্রথম কাজুবাদাম প্রস্ততকরণের সমন্বিত কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। সংযুক্ত আরব আমিরাতে সাড়ে তিন হাজার কেজি কাজুবাদাম রপ্তানির চুক্তিপত্র হয়েছে বলেও জানান এই উদ্যোক্তা।

This post has already been read 129 times!

Check Also

বারি উদ্ভাবিত আনারসের লাড্ডু মেটাবে পুষ্টি চাহিদা

কৃষিবিদ ইফরান আল রাফি : বাংলাদেশের প্রধান ফলগুলোর মধ্যে পুষ্টিগুন সম্পন্ন আনারস অন্যতম। উৎপাদন মৌসুমে …