Friday 29th of March 2024
Home / অর্থ-শিল্প-বাণিজ্য / বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়ানোয় বাজারে আবারো আগুন জ্বলবে -ক্যাব চট্টগ্রাম!

বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়ানোয় বাজারে আবারো আগুন জ্বলবে -ক্যাব চট্টগ্রাম!

Published at ফেব্রুয়ারি ২৯, ২০২০

চট্টগ্রাম সংবাদদাতা: মুজিববর্ষে সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা অনেক। সাধারণ মানুষ আশা করে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্য পণ্য, বিদ্যুৎ-পানি ও গ্যাসের মূল্য এই বছরে তাদের নাগালের মধ্যে থাকবে। কিন্তু বছরের শুরুতেই একসঙ্গে বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়িয়েছে সরকার। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যান সংবাদ সম্মেলন করে এবং ঢাকা ওয়াসা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। বিইআরসি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আগে অন্তত লোক দেখানো গণশুনানি করেছিল। ঢাকা ওয়াসা গণমাধ্যমের মুখোমুখি না হয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে। ইতিমধ্যেই নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল পণ্যের দাম যেভাবে হু হু করে বেড়ে গিয়ে সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে, সেখানে ১৬ কোটি সাধারণ জনগনের স্বার্থ চিন্তা না করে বিদ্যুতে খুচরা পর্যায়ে ৮.৭৫%, ক্ষুদ্র শিল্প গ্রাহক ৪.৯%, মাঝারী শিল্প গ্রাহক ৫.৩%, ওয়াসার পানির দাম ২৭% শতাংশ বৃদ্ধির ঘোষনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন এ মূল্য বৃদ্ধি সাধারণ ভোক্তাদের চলমান জনজীবনে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির কারণে দেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের খরচ আরো বাড়বে। সব শ্রেণি-পেশার মানুষের বিরোধিতার পরও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোনো যুক্তি নেই। বাড়তি দামে বিদ্যুৎ কেনার পাশাপশি এর প্রভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্য পণ্য ও সেবা সার্ভিসের দাম বাড়বে। প্রতি মাসে ভোক্তাদের বাড়তি টাকা গুণতে হবে। এমনিতে গত কয়েক মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রধান পণ্যগুলোর দাম বেড়েছে। চালের দাম বাড়ানো হয়েছে কয়েক দফা। বেড়েছে চিনি, ভোজ্যতেল, ডাল, পেঁয়াজ ও রসুনের দাম। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতিও হঠাৎ লাফ দিয়েছে। সব মিলিয়ে মধ্যম ও নিম্ন আয়ের মানুষ যখন সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে, তখনই বিদ্যুতের দাম বাড়াল সরকার। অন্যদিকে বিগত ২৭ নভেম্বর ২০১৯তে অনুষ্ঠিত গণশুণাণীতে ভোক্তাদের পক্ষ থেকে প্রদত্ত সুপারিশের একটি সুপারিশও কার্যকর না করে গণশুনানিকে হাস্যকর করা, ভোক্তাদের স্বার্থ চিন্তা না করে বিদ্যুত ও পানির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত পুনঃবিবেচনা করে গণশুনানির মাধ্যমে নতুন মূল্য পূনঃ নির্ধারণ, একতরফাভাবে গ্রাহকের মতামত ছাড়া ওয়াসা পানির দাম বাড়ানোর ভোক্তা সংরক্ষন আইনের সুস্পষ্ট লংগনের প্রতিকার দাবি করেছেন কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগীয় ও মহানগর কমিটি।

সম্প্রতি এনার্জি রেগুলেটরী কমিশনের বিদ্যুত ও ওয়াসার পানির মূল্যবৃদ্ধির প্রতিক্রিয়ায় সংবাদ পত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ বলেন বিইআরসি বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গণশুনানির পরামর্শ আমলে না নিয়ে দেশের বাজারে বারংবার মূল্য সমন্বয় করার প্রস্তাব নিয়ে কোন প্রকার প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে, ভুর্তকি হ্রাস, উন্নয়ন প্রকল্পে ঋন পরিশোধ ইত্যাদি অজুহাতে দামবৃদ্ধির ঘোষনা চলমান জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধি মধ্যবিত্তসহ সাধারণ জনগনের জীবন জীবিকা নির্বাহে নিত্য প্রয়োজনীয় সকল প্রকার দ্রব্যসামগ্রী ও জীবনযাত্রার উপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সরকার ১৬ কোটি জনগনের জন্য ভুর্তকি না দিয়ে গুটিকয়েক ব্যবসায়ীদের জন্য ভুর্তকি দিবে এটাই এখন বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সুযোগে ব্যবসায়ীরা নিত্য প্রয়োজনীয় সকল প্রকার সকল দ্রব্যসমাগ্রী ও সেবা সার্ভিসের আরেক দফা আগুন ধরাবে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরী কমিশন সরকারী ও ব্যক্তি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে আবেদনের প্রেক্ষিতে ভোক্তাদের স্বার্থ চিন্তা না করে ভুর্তকি হ্রাস, সিস্টেম লস, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ’র পরামর্শে বিদ্যুতের মুল্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্তকে হঠকারী ও দুঃখজনক বলে মন্তব্য করে এ প্রক্রিয়াকে হতাশাজনক ও বিইআরসির সরকারের গুটিকয়েক ব্যবসায়ীর স্বার্থ সংরক্ষণের বর্হিপ্রকাশ বলে অবিলম্বে এ ধরনের হটকারী সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন।

বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ বলেন, আবাসিক বা শিল্পখাত, কোনো পর্যায়ের ভোক্তার জন্য বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নাই। বিদ্যুৎ খাতে অযৌক্তিক ব্যয়, সিস্টেম লস, উন্নয়ন প্রকল্পের নামে অপরিকল্পিত ব্যয় ও লুটপাট না কমিয়ে সরকার জনগণের ব্যয়ভার বাড়িয়ে দিয়েছে। ভোক্তা যে মানের বিদ্যুৎ পায়, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মূল্য পুনরায় নির্ধারণের দাবি জানিয়ে বলেন ইতিপূর্বেকার মতো ধারাবাহিকতায় গতানুগতিক ঐকিক ক্ষেত্রে বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারিত হয়েছে।

নেতৃবৃন্দ আরো বলেন আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির কথা বলে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করে এবং এ খাতে বিরাট দুর্নীতির ক্ষেত্র তৈরি করে। সাময়িক সংকট সমাধানের বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কথা বলা হলেও এখনও সেগুলো চলছে। উৎপাদন না করেই ভাড়া হিসেবে জনগণের পয়সা নিয়ে হরিলুট করা হচ্ছে। বিদ্যুতের এই দাম বাড়ার প্রভাব কেবল বাসাবাড়িতে পড়বে তা নয়, কৃষি ও শিল্পপণ্যের উৎপাদন খরচও অনেক বাড়বে। করেনা ভাইরাসসহ বৈশ্বিক অনেকগুলি কারনে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি চাপের মধ্যে রয়েছে। বেশির ভাগ সূচকই নিম্নগামী। বিশ্ব অর্থনীতিও মন্দার আশঙ্কায়। কমে যাচ্ছে সামগ্রিক চাহিদা। এ রকম এক সময়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কতটা সময়োপযোগী।  এই মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো নিম্ন ও মধ্যবিত্তের স্বার্থবিরোধী। অর্থ খরচ করে অর্থহীন কাজ হয়েছে। সব ক্ষেত্রে জনগণের খরচ ও পণ্যের দাম বাড়বে। পুরো প্রক্রিয়াটিই জনগণের বিরুদ্ধে চলে গেছে।

বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ আরো অভিযোগ করেন বাজারে যখন লাগামহীন সবকিছুর দাম ঊর্ধ্বগতিতে সীমিত আয়ের মানুষ অসহায়, তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন শিল্প খাত ঝুঁকিতে, তখন বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়ানো কতটা যৌক্তিক? বিদ্যুৎ খাতের লোকসান কমানোর জন্য দাম বাড়ানোর পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বিইআরসির চেয়ারম্যান সংবাদ সম্মেলন করে পদক্ষেপ নেবার কথা বললেও এ মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল না। পিডিব সরকারি প্রতিষ্ঠান হলেও লাভজনক। সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পিডিবির দায়িত্ব হলো জনগণকে সেবা দেওয়া, মুনাফা করা নয়। বিদ্যুৎ বিভাগ অনুৎপাদনশীল খাতে যে বিপুল পরিমান অর্থ খরচ করছেন, সিস্টেম লস, চুরি বন্ধ করতে পারলে ভোক্তাদের ওপর বাড়তি বোঝা চাপাতে হতো না। অন্যদিকে তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন শিল্পের উদ্যোক্তারা বিদ্যুতের এ দাম বাড়গানোর কারনে তৈরি পোশাক খাতসহ অনেক শিল্পের উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হবে।

নেতৃবৃন্দ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন বিইআরসির চেয়ারম্যান সৌজন্যবশত বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পক্ষে গণমাধ্যমে কিছু কথাবার্তা বললেও ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ সেই সৌজন্য দেখানোরও প্রয়োজন বোধ করেনি। ওয়াসা নামক প্রিিতষ্ঠানটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে, সেই প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধ করে দায়ভার সব সময় জনগনের উপর চাপানো হচ্ছে। অধিকন্তু প্রতিটি সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানের পদাধিকারীরা ভোক্তা তথা জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য। ঢাকা ওয়াসা আইনের তোয়াক্কা না করছে না, বিষয়টি দুঃখজনক। ঢাকা ওয়াসার পানি বিপজ্জনক মাত্রায় দূষিত, যা মানুষের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। ফুটিয়ে বা অন্য উপায়ে বিশুদ্ধ না করলে এই পানি পানযোগ্য হয় না। ওয়াসার পানিতে কাদা-ময়লা, শেওলা তো থাকেই, মাঝে মাঝে কীট-কেঁচোরও দেখা মেলে। তাই পানির দাম বাড়ানোর আগে ওয়াসা কর্তৃপক্ষের উচিত কী মানের পানি গ্রাহককে দিচ্ছে। একতরফাভাবে গ্রাহকের মতামত ছাড়া ওয়াসা পানির দাম বাড়ানোর ভোক্তা সংরক্ষন আইনের সুস্পষ্ট লংগন। অথচ ভোক্তা অধিকার আইন অনুসারে, পানির দাম বাড়াতে হলে ওয়াসার অবশ্যই ভোক্তাদের মতামত নেওয়া উচিত। গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আগে গণশুনানির ব্যবস্থা আছে, কিন্তু ওয়াসার তেমন কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। তাই এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হোক।

নেতৃবৃন্দ উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, সরকার এমন এক সময়ে বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়াল, যখন চাল, চিনি, ভোজ্যতেল, ডাল, পেঁয়াজ, রসুনসহ অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে চলেছে। চীনের সাম্প্রতিক কোরোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব ইতিমধ্যে দেশের  অর্থনীতিতে পড়তে শুরু করেছে। বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়লে সেই প্রভাব যে আরো কষ্টকর হবে। সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে শিল্পগ্রাহকদের কাছ থেকে যে বাড়তি অর্থ পাবে, তা শিল্পের মালিকেরা নিজেদের পকেট থেকে দেবেন না। তাঁরা উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়িয়ে ভোক্তাদের পকেট থেকে উশুল করবেন। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে শেষ বিচারে ভোক্তাদের ওপরই আর্থিক চাপ বাড়বে, বিপুলসংখ্যক নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার মান আরো কমে যাবে। বিদ্যুৎ ও পানির দাম না বাড়িয়ে ওই দুটি খাতে যে বিপুল অপচয়, অনিয়ম ও দুর্নীতি হচ্ছে, তা বন্ধ করতে কার্যকর ও টেকসই পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানান। জনগনের করের অর্থে পরিচালিত সরকারী সেবা প্রতিষ্ঠানের পদাধিকারীদের ব্যর্থতা, অদক্ষতা ও অপচয়ের দায় কেন জনগণের ওপর চাপানো  ঠিক হবে না বলে মন্তব্য করেন।

বিবৃতিতে যারা স্বাক্ষর করেন তারা হলেন ক্যাব কেন্দ্রিয় ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন, ক্যাব চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাধারণ সম্পাদক কাজী ইকবাল বাহার ছাবেরী, ক্যাব মহানগরের সভাপতি জেসসিন সুলতানা পারু, সাধারণ সম্পাদক অজয় মিত্র শংকু, ক্যাব দক্ষিন জেলা সভাপতি আলহাজ্ব আবদুল মান্নান, ক্যাব মহানগরের যুগ্ন সম্পদক তৌহিদুল ইসলাম প্রমুখ।

This post has already been read 2502 times!