Thursday 25th of April 2024
Home / ফসল / দারুন স্বাদের মরমা চাষ

দারুন স্বাদের মরমা চাষ

Published at অক্টোবর ২০, ২০১৯

মৃত্যুঞ্জয় রায় : বরিশাল সিটি মার্কেট পাইকারী কাঁচাবাজারে শসার মতো বড়ো এক সবজি সুন্দর করে বিক্রির জন্য ব্যাপারী বৃত্তাকারে সাজিয়ে রেখেছেন আড়তের সামনে। দেখে কৌতুহল হলো সবজির নামটা জানার। শসাই তো। কিন্তু শসাও না। খোসা মসৃণ, খোসার উপর ছোট ছোট বুটি। বুটিগুলো আঁচিলের মতো। রঙ গাঢ় সবুজ বা পিত্তি, লম্বালম্বি অগভীর খাঁজ আছে, তাতে হালকা হলদেটে ভাব। পাকলে খোসা শক্ত হয়ে যায়। একটার ওজন দেড়-দু কেজি পর্যন্ত হয়। আড়তদারকে জিজ্ঞেস করতেই নামটা জানা গেল। এই সবজির নাম নাকি মরমা।

পার্বত্য চট্টগ্রামে মারফা দেখেছি। মরমা আর মারফা শসার গোত্রীয় একই সবজি হলেও দুটি আলাদা। মারফা কখনো এতো বড় হয় না। এর মতো খোসা এতো ত্যালতেলে না, কিছুটা খসখসে। তবে এ দুটি সবজিই কাঁচা ও রান্না করে খাওয়া হয়। পাহাড়িরা মারফা খায় শুটকি মাছ দিয়ে রান্না করে না হয় মিশ্র সবজি হিসেবে। মরমা খাওয়ার সবচেয়ে বেশি স্বাদ নাকি পাওয়া যায় চিংড়ি মাছ দিয়ে রান্না করে খেলে।

আড়তদার বললেন, কিনে নিন। খেয়ে দেখবেন। আটঘর কুরিয়ানার মরমার স্বাদ একবার খেলে জীবনেও ভুলবেন না।’ তার কথাতেই জানতে পারলাম, মরমা চাষের জায়গাটা হলো আটঘর-কুরিয়ানা। জায়গাটা কোথায়? খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, গ্রাম দুটো ঝালকাঠি সদর আর পিরোজপুরের নেছারাবাদের সীমান্ত লাগোয়া। একদিন সত্যি সত্যি সেই মরমা চাষের খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম ঝালকাঠির উদ্দেশ্যে। সাথে দুজন সিনিয়র অফিসার সুভাষ চন্দ্র গায়েন ও ড. আবু ওয়ালী রাগিব হাসান।

মাঘের মাঝামাঝি। ঝালকাঠির কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো: আবু বকর সিদ্দিক সাহেব আমাদের নিয়ে চললেন মরমা চাষের ক্ষেত দেখাতে কীর্তিপাশা ইউনিয়নের ডুমুরিয়া গ্রামের দিকে। সেটাও ঝালকাঠি সদরের মধ্যে। ঝালকাঠি থেকে গ্রামটার দূরত্ব প্রায় ১০ কিলোমিটার হবে। পাকা রাস্তায় গাড়ি রেখে হেরিংবোনের রাস্তা দিয়ে খালপাড় ধরে আমরা সেই মরমা ক্ষেতের দিয়ে হেঁটে চললাম। প্রায় এক কিলোমিটার যাওয়ার পর সেই মরমা ক্ষেতের দেখা পেলাম। মরমা ক্ষেতেই কৃষক মরমা তুলছেন। সরজন পদ্ধতিতে চাষ করা মরমা ক্ষেতের নালার জলে নৌকা নিয়ে মাচা থেকে মরমা তুলে নৌকায় ভরছেন। আমাদের দেখে ক্ষেতের কিনারে রাস্তার কাছে চলে এলেন। কৃষকের নাম গৌতম ব্যাপারী। তার কাছ থেকেই জানা গেল মরমা চাষের কথাগুলো।

ডুমুরিয়া গ্রামের গৌতম ব্যাপারী ২২ কাঠা জমিতে সরজন বা কান্দি পদ্ধতিতে ৪ বছর ধরে মরমা চাষ করছেন। জমিটা পৈতৃক সূত্রে পাওয়া। নিচু জমি হওয়ায় আগে জোয়ারের জলে ডুবে থাকতো। এক মৌসুমে শুধু ধান চাষ করা ছাড়া এ জমিতে আর কোনো ফসল চাষ করা সম্ভব হতো না। চার বছর আগে সেই জমিতে শুকনোর সময় কান্দি তৈরি করেন তিনি। পৌষ-মাঘ মাসে মাটি কেটে প্রায় এক বুক সমান উঁচু বেড বা কান্দি তৈরি করেন। দুটি কান্দির মাঝে খালের মতো গর্ত তৈরি হয়।

ফাল্গুণ মাসে কান্দি তৈরির কাজ শেষ হলে সেসব কান্দির উপরের মাটি কুপিয়ে সমান করে তাতে ধৈঞ্চার বীজ বুনে দেন। ধৈঞ্চার বীজ গজিয়ে লক লক করে বেড়ে ওঠে। মাটিকে শক্ত অর্থাৎ কান্দি যাতে ভেঙ্গে না যায় সেজন্য আলগা মাটিকে বসতে কিছুদিন সময় দিতে হয়। সে সময়টা শুধু ধুধু ফাঁকা না রেখে ধৈঞ্চা বুনলে দুটো উপকার হয়। প্রথমত: ধৈঞ্চার শিকড়গুলো আলগা মাটি ধরে রাখে, কান্দি ভেঙ্গে যেতে দেয় না। দ্বিতীয়ত এতে সার হয়, মাটির শক্তি বাড়ে। ধৈঞ্চার পাতা ঝরে মাটিতে পড়ে পচে ও উর্বরতা বাড়ায়। পরে ধৈঞ্চা গাছ কেটে মাচা দেয়ার কাঠি বানানো হয়। ধৈঞ্চা গাছ কান্দির জমিতে প্রায় ৬-৭ মাস থাকে। এরপর ধৈঞ্চা গাছ কেটে কান্দির জমি চাষ দেয়া হয়। সাধারণত আশ্বিন মাস পড়লে এ কাজ করা হয়।

আশ্বিন থেকে জমিতে চাষ দিয়ে হরেক রকমের সবজির বীজ বোনা বা চারা লাগানোকে তারা বলেন জমি সাজানো। নানা রকম শীতকালীন সবজিতে আসলেই তারা জমিকে সাজিয়ে তোলেন বিয়ের কন্যের মতো। প্রায় ৮-১০ ফুট চওড়া এক একটা কান্দিতে লাগান এক এক রকমের ফসল। কখনো কখনো একই কান্দিতে মিশ্র সবজি ও ফলের চাষও করেন। কান্দির পাড়ে বা কিনারে লাগান লতানো সবজি। দুটি কান্দির মাঝে নালার উপরে বাঁশের খুঁটি ও ধৈঞ্চার গাছ দিয়ে নৌকার ছৈয়ের মতো মাচা রচনা করেন। এ এক অপূর্ব চাষ শিল্প। জমির প্রতিটি ইঞ্চির যথাযথ ব্যবহার। বেডে লাগান ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, মূলা, মরিচ, বেগুন, টমেটো, মানকচু, দুধ মানকচু অথবা বিন্নাসুফী লালশাক। বেডের কিনারায় লাগান মরমা, চিচিঙ্গা বা রেখা, কাকরোল, মিষ্টি কুমড়া, চালকুমড়া, লাউ ও করলা। এগুলো পরে মাচায় তুলে দেন। বেডে কাঁচকলা ও পেঁপে গাছও লাগান।

গৌতম জানান, মরমা চাষের জন্য আশ্বিন মাস থেকেই প্রস্তুতি নিতে হয়। মরমার বীজ নিজেরাই রাখেন ও গত মৌসুমের সেসব বীজ ব্যবহার করে চারা তৈরি করেন। মরমার চারা তৈরির জন্য ধুপ বা ফাস মাটি লাগে। এরূপ ভেজা মাটি মুঠো করে দইল্যা, দউলা বা দোলা (দলা) বানানো হয়। প্রতিটি দইল্যাতে ৩-৪টি গজানো বীজ বসানো হয়। দইল্যাতে বসানোর আগে বীজ ভিজিয়ে রেখে বীজের মুখ ফাটানো হয়। এভাবে মুখফাটা বা গজানো বীজ দইল্যাতে পুঁতে দেয়ার ৫-৬ দিনের মাথায় তা দইল্যা থেকে মাথা উঁচু করে বেরিয়ে আসে। তখন সেসব দইল্যা আগে থেকে তৈরি করে রাখা বেডের কিনারার মাদাতে লাগিয়ে দেন। মাদা থেকে মাদার দূরত্ব দেয়া হয় প্রায় ৪ ফুট। গাছ বড় হয়ে মাচায় উঠে যায়। মাদাতে প্রধানত জৈব সার বেশি দেন। এতে অন্য সার না দিলেও চলে। এতে রোগ পোকা কম লাগে। সার দিলে রোগ বেশি ধরে।

আগাছা পরিষ্কার ও বাউনি/মাচার যত্ন নেয়া ছাড়া আর বিশেষ কোনো কাজ করতে হয় না। চারা লাগানোর ঠিক ১মাস ১ সপ্তাহ পর গাছে প্রথম ফুল আসে। ফুল আসার পর থেকেই ফল ধরতে থাকে। চারা লাগানোর ৫০ থেকে ৫৫ দিন পর থেকে কচি ফল তোলা শুরু করা যায়। কাঁচা ফলের চাহিদা বাজারে বেশি। পৌষ মাস পর্যন্ত ভালো ও বেশি ফল পাওয়া যায়। এরপর ফল কমতে থাকে। গাছ রেখে দিলে ফাল্গুণ মাস পর্যন্ত মরমা পাওয়া যায়। যেহেতু উৎপাদন কমে আসে তাই এ সময় দামও ভালো পাওয়া যায়। বিঘায় ৩০ থেকে ৪০ মণ মরমা পাওয়া যায়। গড়ে প্রতি কেজি মরমা বিক্রি হয় ২৫ টাকা কেজি দরে। ক্ষেত থেকেই ফড়িয়ারা এসে কিনে নিয়ে যায়, বিক্রি করতে বাজারে না গেলেও চলে। ক্ষেতের সাথে খালের যোগ আছে। তাই নৌকায় তুলে নৌকায় করেই বাজার পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যায়। বরিশাল-ঝালকাঠি জেলায় মরমা এক জনপ্রিয় সবজি। কাঁচা, সালাদ বা রান্না যেভাবেই হোক অনেকেই চান খাবার টেবিলে মরমা যেন থাকে।

কীর্তিপাশা ব্লকের উপ সহকারী কৃষি অফিসার তপন কান্তি ব্যাপারী জানালেন, মাদ্রা, আতা জামগাঁও, নবগ্রাম ও কীর্তিপাশা ইউনিয়নে প্রায় ৭৫০ হেক্টর জমিতে সরজন পদ্ধতিতে সবজি ও ফল চাষ করা হচ্ছে। অনেক সরজনেই মরমা চাষ করা হচ্ছে। ভীমরুলী, সরদাসকাঠি, আদমকাঠি, কাঠুরাকাঠি, জিন্নাকাঠি, কাপড়কাঠি, পাহাগাছি প্রভৃতি গ্রামের সরজনে মরমা চাষ হয়। ফিরতে ফিরতে রাস্তায় এসব তথ্য দিলেন তিনি। ততক্ষণে আমরা গৌতম বাবুর বাড়ি এসে পে্যঁছে গেছি। সুন্দর ছিমছাম টিনের ঘরওয়ালা বাড়ির নিকোনো উঠোনে আমাদের জন্য কয়েকটা প্লাস্টিকের চেয়ার পাতা হয়েছে। মাঝখানে টেবিলে সাজানো রয়েছে আমাদের আপ্যায়নের জন্য ফালি করে কাটা মরমার টুকরো। হাঁটতে হাঁটতে তেষ্টা পেয়েছিল খুব। মরমার ফালিগুলো চিবোতেই সে তেষ্টায় যেন গঙ্গাজল পড়লো। মুখে মরমার স্বাদ নিয়ে ফিরে এলাম বরিশাল।

This post has already been read 5460 times!