Saturday 27th of April 2024
Home / পোলট্রি / মুরগী নিজের ডিম নিজে যখন খায়!

মুরগী নিজের ডিম নিজে যখন খায়!

Published at নভেম্বর ১২, ২০১৭

অপু রায়হান : খাদ্য পাত্রে যদি অল্প পরিমাণে এবং একই ধরনের খাবার দেয়া হয় তাহলেও মুরগী খুটে খুটে খাবে এবং পা দিয়ে আঁচড়াবে অর্থাৎ নতুন খাদ্য খুঁজবে। আবার যদি খাদ্যপাত্র ভর্তি করে খাদ্য দেয়া হয় তাহলেও একই ধরনের আচরণ করবে। এজন্য মুরগীকে বলা হয় অনুসদ্ধিৎসু খাদক। এটা মুরগীর একটি অভ্যাস বা আচরণগত বৈশিষ্ট্য বা natural behavior । অনেক সময় মুরগী পরস্পরের সাথে ঠোকরাঠুকরি করে, পালক টেনে তুলে এমনকি ঠোকরাতে ঠোকরাতে মেরে ফেলে নাড়ী-ভুড়ি খেয়ে ফেলে, ডিম ভাঙ্গে এবং ভাঙ্গা ডিম ভক্ষণ করে। এগুলো মুরগীর বদ অভ্যাস। Managemental disorder বা Nutritional deficience’র কারণে এই বদঅভ্যাস সমূহ গড়ে উঠে। ডিম ভাঙ্গা এবং খেয়ে ফেলা মুরগীর একটি অন্যতম অর্থনৈতিক গুরুত্ববহ বদঅভ্যাস। এই বদঅভ্যাসগুলো good production performance এর জন্য ক্ষতিকর। বদ অভ্যাস সংক্রামক রোগের মতো একবার তা গড়ে উঠলে তা সংক্রামক রোগের মতোই সমস্ত ফ্লকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, যা প্রতিরোধ করা দুরূহ হয়ে পড়ে। অনেক খামারি ভাই মুরগীর নিজের ডিম বা অন্য মুরগীর ভেঙ্গে খেয়ে ফেলার বিষয়টি নিয়ে সমস্যায় ভোগেন। মুরগীর ডিম খাওয়ার কিছু কারণ ও প্রতিকার সম্বন্ধে এ লেখায় আলোকপাত করা হলো।

মুরগীর ডিম খাওয়ার কারণ ও প্রতিকার
ডিম খাওয়া productive behavior নয়। বিভিন্ন কারণে মুরগী ডিম ভাঙ্গে বা মুরগীর ডিম ভাঙ্গা এবং খেয়ে ফেলার অভ্যাস গড়ে উঠে। পুষ্টি ও ব্যবস্থাপনাজনিত ত্রুটি, অপর্যাপ্ত ও অস্বাস্থ্যকর বাসস্থান ইত্যাদি কারণ এর মধ্যে অন্যতম। এছাড়াও মুরগী সামাজিক জীব, পরিবেশের নানান পরিবর্তনে, তা ভালো হোক আর খারাপ হোক মুরগী প্রতিক্রিয়াশীল। কোন মুরগী কোন কারণে যদি একটি ডিম ভাঙ্গে বা খেয়ে ফেলে তাহলে অন্য মুরগী বিষয়টি দেখে তা করতে পারে। এটাকে বলা হয় learned behavior।

মুরগীর ডিম খাওয়ার অন্যতম কারণ হলো খাদ্য ও পুষ্টি ঘাটতি। ডিমপাড়া অবস্থায় জাতভেদে একটি মুরগীর জন্য দৈনিক ১১০-১২০ গ্রাম খাদ্য দরকার। যদি কোন কারণে এর চেয়ে তুলনামূলক অনেক কম পরিমাণ খাদ্য কিছু সময় ধরে সরবরাহ করা হয়, তাহলে ডিম খাওয়ার প্রবণতা গড়ে উঠতে পারে। তাছাড়া খাদ্যে পুষ্টি উপাদান বিশেষ করে প্রোটিন, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন -ডি ঘাটতি হলে মুরগী ডিম ভেঙ্গে খায়। লেয়ার রেশনে শতকরা ৩.৫০ ভাগ ক্যালসিয়াম দরকার। আমরা জানি ডিমের খোসার অন্যতম গাঠনিক উপাদান ক্যালসিয়াম যৌগ। মুরগীর দৈহিক চাহিদার পাশাপাশি ডিম গঠনের জন্য অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম সরবরাহ না করলে মুরগীর শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যালসিয়ামের একটা বড় অংশ ডিম গঠনে ব্যয় হয় ফলে মুরগী শরীর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ক্যালসিয়াম ঘাটতি হয়। এই ঘাটতি মেটাতে আবার ক্যালসিয়ামের ঘাটতি হলে ডিমের খোসার গঠন ঠিকমতো হয় না, ফলে খোসা খুব পাতলা ও ভঙ্গুর হয় ফলে ঠোকর মারলে খুব সহজেই ডিম ভেঙ্গে যায়। এ কারণে মুরগীর ডিম খাওয়ার অভ্যাস গড়ে উঠে। এজন্য মুরগী যখন ডিম পাড়ার প্রস্তুতি শুরু করে তখন থেকে খাদ্যে প্রায়েজনীয় পরিমান প্রোটিন বাড়তি ক্যালসিয়াম ও পর্যাপ্ত ভিটামিন -ডি জাতীয় পুষ্টির চাহিদা পূরণ করতে হবে। মুরগীর খাদ্যে ভিটামিন -ডি এর অভাব হলে শরীরে ক্যালসিয়াম ভালোভাবে শোষিত হয় না। শরীরে সরবরাহকৃত ক্যালসিয়াম শোষিত না হওয়ার কারণে ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাদ্য উপাদান সরবরাহের পরেও ঘাটতি হতে পারে। এজন্য ভিটামিন -ডি এর চাহিদা পূরণ করতে হবে। বিভিন্ন খাদ্য উপাদান থেকে ভিটামিন-ডি পাওয়া যায় আবার বিভিন্ন কোম্পানির বাজারজাতকৃত এডি৩ই ব্যবহার করা যেতে পারে। এবং ক্যালসিয়ামের জন্য ঝিনুক চূর্ণ, লাইমস্টোন, ডিসিপি ইত্যাদি ব্যবহার করা যায়।

ফ্লোর বা মাচায় পালনের ক্ষেত্রে মুরগীর জন্য ডিম পাড়ার বাক্স (nesting box) খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি ৪টি মুরগীর জন্য একটি বাক্স দরকার এবং chickens’ roost হতে অন্তত ৪ ফুট দুরত্বে বাক্স স্থাপন করতে হবে। মুরগী সাধারনত: অন্ধকার জায়গায় ডিম পাড়তে পছন্দ করে। যে সময় মুরগী ডিম পাড়ে সে সময় মুরগীর ঘরের আলো পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে। এমনকি পর্দা দিয়ে বাক্স আড়াল করে দিতে হবে। দু’টি কারণে ডিম পাড়ার স্থান অন্ধকার করা প্রয়োজন, প্রথমত: মুরগী অন্ধকার জায়গায় ডিম পাড়তে পছন্দ করে, দ্বিতীয়ত: ডিমপাড়ার স্থান অন্ধকার হলে মুরগী ডিম দেখতে পাবে না। ফলে ডিম ভাঙ্গতে পারে না।

ডিম পাড়ার বাক্সের জায়গা হবে গড়ে ১২ বর্গইঞ্চি। বাক্সের ভেতরে ২ ইঞ্চি পুরু করে শুকনা, পরিষ্কার ও নরম nesting material যেমন- শুকনা খড়, কাঠের গুড়া ইত্যাদি দিতে হবে যাতে মুরগী ডিম পাড়ার পর গড়িয়ে যেতে না পারে। ডিম গড়িয়ে পড়ার সময় ভেঙ্গে গেলে অথবা ডিম গড়িয়ে মুরগীর সামনে পড়লে কৌতুহলের কারণে ঠোকরাতে পারে এবং ভেঙ্গে গেলে অভ্যাসে পরিনত হতে পারে।

ডিম পাড়ার পর যেন দীর্ঘ সময় মুরগীর সামনে ডিম পড়ে না থাকে। অনেক সময় ধরে ডিম বাক্স, খাঁচা বা ফ্লোরে পড়ে থাকলে ডিম খাওয়ার অভ্যাস গড়ে উঠতে পারে। এজন্য দিনে কমপক্ষে দুই বার একবার সকালে এবং একবার বিকালে ডিম সংগ্রহ করতে হবে। যদি সামনে ডিম না থাকে তাহলে ঠোকরাবে কি আর ভাঙ্গবেই বা কি।

ফ্লকের কুঁচে মুরগী এবং কোন মুরগী ডিম খাওয়া শুরু করলে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পরেও যদি এ অভ্যাস বজায় থাকে তাহলে এমন মুরগী ফ্লক থেকে বাতিল করতে হবে। তা না হলে অন্যান্য মুরগীর মধ্যেও এ অভ্যাস সংক্রমিত হবে।

মুরগীর জন্য ধকলমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। যদি মুরগীকে অল্প জায়গায খুব চাপাচাপি করে থাকতে হয় এবং এছাড়া অন্য কোন কারণেও যদি মুরগী বিরক্ত বোধ করে তাহলে ডিম ঠোকরানো বা খাওয়ার অভ্যাস তৈরি হতে পারে।

যদি ডিম সংগ্রহের সময় কখনো দুর্ঘটনাবশত: একটি ডিম ভেঙ্গে যায় এবং কোন মুরগী ঐ ভাঙ্গা ডিম খাওয়ার সুযোগ পায় তাহলে পরবর্তীতে মুরগীর ডিম খাওয়ার প্রবনতা শুরু হয়। কারণ মুরগীর ডিম একটি পুষ্টিকর ও সুস্বাদু খাদ্য যে কেউ একবার এর স্বাদ গ্রহণ করলে পূনরায় স্বাদ গ্রহণের আকাঙ্খা জাগে এজন্যও ডিম খাওয়ার অভ্যাস গড়ে উঠে। একবার এ অভ্যাস গড়ে উঠলে তা প্রতিরোধ করা কষ্টসাধ্য। তাই কোন কারণে মুরগীর ঘরের ভিতরে ডিম ভেঙ্গে গেলে তা মুরগীর খাওয়ার জন্য ফেলে না রেখে দ্রুত সরিয়ে ফেলতে হবে। যাতে কোনভাবেই মুরগী ডিমের স্বাদ গ্রহণ করতে না পারে।

মুরগীকে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হবে। অন্যান্য পাখির তুলনায় মুরগী বেশি পানি গ্রহণ করে। পানি স্বল্পতা সৃষ্টি হলে শরীরের moisture level ঠিক রাখতে ডিমের তরল অংশ ভক্ষণের জন্য ডিম ভেঙ্গে খেতে পারে।

ডিম খাওয়া শুরু হয় যখন মুরগীর শেডে বিরক্তিকর তীব্র আলো থাকে। এ অবস্থায় যদি ডিম খাওয়া শুরু করে তাহলে অন্যান্য ব্যবস্থাপনা গ্রহণের সাথে সাথে মুরগীর ঘরে বিরক্তিকর আলো বন্ধ করে দিতে হবে।

ডিম খাওয়া এক প্রকার ক্যানাবলিজম। সুতরাং ক্যানাবলিজম প্রতিরোধে গৃহিত ব্যবস্থাদি গ্রহণের মাধ্যমে এটা প্রতিরোধ করা যায়। মুরগী সাধারনত: ডিম খায় না। খামারের ব্যবস্থাপনা বা পরিচর্যা ভালো না হলে মুরগী ডিম খাওয়া শুরু করে। যদি খামারের ব্যবস্থাপনা মুরগীর জন্য কাঙ্খিত বা গ্রহণযোগ্য মাত্রায় নিশ্চিত করা যায় তাহলে ডিম খাওয়ার অভ্যাস তৈরি হবে না বা বন্ধ হয়ে যাবে।

This post has already been read 10969 times!