ফকির শহিদুল ইসলাম (খুলনা) :
রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকের কঠিন শর্তে কাঁচা পাট রপ্তানী শিল্পে বিপর্যয়ের আশংকা দেখা দিয়েছে। পাটের ভরা মৌসুম শুরু হলেও কাঁচা পাট রপ্তানিকারকদের ব্যাংক ঋণের অর্থ সময়মতো ছাড় না হওয়ায় এ আশংকা তৈরি হয়েছে। কঠিন শর্তের বেড়াজালে আটকে পড়েছে কাঁচা পাট রপ্তানি শিল্প।
জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলো কাঁচা পাট রপ্তানিকারকদের ব্যাংক ঋণ প্রস্তাবে যে কঠিন শর্ত দিয়েছে সেই শর্তাবলী পূরণ করে কৃষক পর্যায় থেকে পাট ক্রয় করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন কাঁচা পাট রপ্তানিকারকরা। যুগ যুগ ধরে চলে আসা লুজ পাট পঞ্চাশ কেজিতে এক বোঝা ধরে প্লেজ ঋণ দেয়ার যে নিয়ম চলমান ছিল। এখন কাঁচাপাট রপ্তানিকারকদের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন পেতে বেল পাটের প্লেজের শর্ত দেয়া হয়েছে। এ শর্তে রপ্তানিকারকরা কৃষক পর্যায় থেকে সরাসরি পাট ক্রয় করা সম্ভবপর নয়। কেননা কৃষক পর্যায় থেকে পাট ক্রয় করতে নগদ টাকা প্রয়োজন। নগদ টাকা দিয়ে কৃষকের কাছ থেকে কাঁচা পাট ক্রয় করে তা গুদামজাত ও পাটকে বিভিন্ন গ্রেড অনুযায়ী ভাগ করে বেল পাটে রূপান্তরিত করতে হয়। সেক্ষেত্রে রপ্তানিকারকদের বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থের প্রয়োজন যা ব্যাবসায়ীদের নেই। আগে একজন পাট রপ্তানিকারকে প্লেজের বিপরীতে দশ ভাগ জামানত প্রয়োজন হতো। রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোর নতুন করে ঋণ প্রস্তাবে প্লেজের বিপরীতে শতভাগ জামানত প্রয়োজনের শর্ত জুড়ে দিয়েছে ব্যাবসায়ীদের। ফলে পাট ব্যাবসায়ীরা পড়েছেন উভয় সংকটে। ব্যাংকের এসব কঠিন শর্তেও বেড়াজালে চলতি মৌসুমের কাঁচা পাট নিয়ে কৃষকরা বিপাকে পড়ার আশংকা দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জুলাই মাসে কাঁচা পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানিতে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে ৬ কোটি ৯৭ লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার বা প্রায় ৫৪৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে কাঁচা পাট রপ্তানিতে আয় হয়েছে ২ কোটি ৫৫ লাখ মার্কিন ডলার। তবে ব্যাংকের শর্তের কারণে চলতি ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে কাঁচা পাট রপ্তানিতে ধ্বস নামতে পারে বলে রপ্তানিকারকরা আশংকা প্রকাশ করেছেন।
এদিকে পাট শিল্পকে এগিয়ে নিতে এবং পাটের সুদিন ফেরাতে বর্তমান সরকার নানামুখি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। শুধু তাই নয়, পাটকে কৃষিপণ্য হিসাবে ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বলেছেন, এখন থেকে পাট উৎপাদন, বিপণন ও রপ্তানির ক্ষেত্রে কৃষিপণ্য যেসব সুবিধা পায় তা পাটের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। গত কয়েক বছর ধরে পাটের বহুমুখী ব্যবহারের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর এমন ঘোষণায় পাটের সুদিন ফিরবে বলে আশা করছেন।
বাংলাদেশ জুট এ্যাসোশিয়সনের (বিজেএ)ভাইস-চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আব্দুস সোবাহান শরীফ বলেন, বিঋিণœ সময় বিদেশে কাঁচাপাট রপ্তানীতে নিষেধাজ্ঞা জারি করায় এ অঞ্চলের পাট ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বিজেএ’র পক্ষ থেকে আমরা সরকার প্রধান ও অর্থমন্ত্রীর সাথে আলোচনা করেছি। আমরা পাটকে কৃষিপণ্য হিসাবে ঘোষণার রপ্তানির প্রনোদনা দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছি। পাশাপাশি পাট রপ্তানিতে সরকারি নিষেধাজ্ঞায় ক্ষতিগ্রস্ত পাট ব্যাবসায়ীদের খেলাপী ঋণ ব্লক পূর্বক দশ বছরের সুদ ফেরত ও পূণরায় স্বল্পসুদে ব্যবসায়ীদের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রদান করা হলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পাট ব্যবসায়ীরা কিছুটা হলে ঘুরে দাড়াতে পারবেন।
তিনি আরো বলেন, এছাড়া কৃষিভিক্তিক শিল্পের রপ্তানি সহায়তা যাতে দ্রুত পাওয়া যায় তার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আমরা দাবি জানিয়েছি। আমাদের এ ন্যায্য দাবীর প্রেক্ষিতে সম্প্রতি খুলনা-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানে নেতৃত্বে ঢাকার একটি ক্লাবে অর্থমন্ত্রী ও পাট প্রতিমন্ত্রীর উপস্থিতে আমরা আমাদের বিদ্যমান সমস্যা নিরসনের দাবী জানাই। আমাদের দাবীর সমর্থনে একত্মতা প্রকাশ করেন পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম। ওই সভায় পাট প্রতিমন্ত্রী স্বীকার করেছেন বিদেশে কাঁচা পাট রপ্তানি বন্ধের সরকারের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। মির্জা আজম তার বক্তব্যে ক্ষতিগ্রস্থ পাট ব্যাবসায়ীদের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে অর্থমন্ত্রীর হস্থক্ষেপ কামনা করেন। জবাবে অর্থমন্ত্রী পাট ব্যবসায়ীদের খোলামেলা জবাব দিয়েছেন, বলেছেন আপনাদের ঋণ মওকুফ করতে না পারলেও আপনাদের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে একটি প্যাকেজ দিচ্ছি। এই প্যাকেজের আওতায় আপনারা পাট ব্যাবসার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবেন এবং পাশাপাশি ঋনের সুদের হার কমানো ও কাঁচাপাট রপ্তানীকারকদের শহজ শর্তে দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ দেয়ার আশ্বাস দেন।
অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা সত্বেও খুলনাঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ব সোনালী, রুপালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকের বড় কর্তারা তা মানছেন না বলে তিনি অভিযোগ করেন। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কতিপয় স্বার্থান্বেষী কর্মকর্তারা পাটের ঋণ গ্রহিতাদের চলতি মুলধনের ঋণ প্রস্তাবে একের পর এক অযৌক্তিক শর্তাবলী চাপিয়ে দেয়ার কারণে কাঁচা পাট রপ্তানিকারকরা পাটের চলতি ভরা মৌসুমে তাদের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনে ব্যাংকের কর্তারা বিভিণœ অজুহাত দেখাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন বিজেএর এই নেতা। ফলে খুলনাঞ্চলের ব্যাংক কর্মকর্তাদের শর্তের বেড়াজালে বর্তমান সরকারের পাট শিল্পের সাফল্য ভেস্তে যেতে পারে বলে জানিয়েছেন পাট রপ্তানিকারকরা।
কাঁচা পাট রপ্তানিকারক মেসার্স বাবুল জুট এর সত্বাধিকারী নুরুল ইসলাম বাবুল বলেন, বিদেশে কাঁচা পাট রপ্তানিতে সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে আমরা অনেক আর্থিক ক্ষতির স্বীকার হয়েছি। বর্তমান সরকার পাট শিল্পের প্রতি বিশেষ নজর দিয়েছে তাই আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে প্রয়োজনীয় বিশেষ প্রণোদনা দেয়ার দাবি জানাচ্ছি।
অপর একটি সূত্র জানায়, দেশের কাঁচা পাট রপ্তানির রাজধানী হচ্ছে খুলনার দৌলতপুর। পাট রপ্তানিকারকরা সোনালী ব্যাংক দৌলতপুর কর্পোরেট শাখা, বিএল কলেজ রোড শাখা, ফুলবাড়ি গেট শাখা, খালিশপুর নিউজপ্রিন্ট গেট শাখা ও প্রধান কার্যালয় করপোরেট ব্রাঞ্চ, রুপালী ব্যাকের দৌলতপুর কর্পোরেট ব্যাঞ্চ, অগ্রনী ব্যাংক দৌলতপুর শাখা। এ কয়টি ব্যাংকই মূলত কাঁচা পাট রপ্তানিকারক ও সাধারণ পাট ব্যবসায়ীদের প্লেজ ঋণ, হাইপো ঋণ ও পিসিসি ঋণ বিতরণ করে। কাঁচা পাট রপ্তানিকারকদের সিংহভাগই সোনালী ব্যাংকের ঋণ গ্রহিতা।
পাট রপ্তানিকারকদের সংগঠন জুট এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যানুযায়ী, এখন বাংলাদেশ থেকে প্রতিমাসে ৬০০-৭০০ কোটি টাকার কাঁচা পাট ও পাটজাত পণ্য বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৫ দেশের বাইরেও দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম, আইভরিকোস্ট, অস্ট্রেলিয়াসহ ১২০টি দেশে এসব পণ্য রপ্তানি হয়।