Thursday 25th of April 2024
Home / পোলট্রি / প্রোটিন শুধু খাবার নয়, মহাষৌধ

প্রোটিন শুধু খাবার নয়, মহাষৌধ

Published at জুলাই ১৯, ২০১৭

DSC01302নিজস্ব প্রতিবেদক : ‘প্রোটিন শুধু খাবার নয় বরং মানব স্বাস্থ্য রক্ষায় এটি এক মহাষৌধ। তাই মানব স্বাস্থ্য রক্ষায় প্রোটিন গ্রহণের ব্যাপারে আমাদের আরো বেশি সচেতন হতে হবে। এছাড়াও লিভার সিরোসিস হলে শরীর ফুলে যায়। অপুষ্টিজনিত সমস্যা এর অন্যতম একটি কারণ। রক্তে কোষের ভেতরে ও বাইরে পানির ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে প্রোটিন’। সোমবার রাজধানীর একটি হোটেলে বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) এবং ইউ.এস সয়াবিন এক্সপোর্ট কাউন্সিল (ইউএসএসইসি) এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ‘প্রোটিন ফর অল’ শীর্ষক সেমিনারে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের উপচার্য প্রফেসর ডা কামরুল হাসান খান এসব কথা বলেন।

DSC01401

সেমিনারে বক্তব্য রাখছেন বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের উপচার্য প্রফেসর ডা কামরুল হাসান খান। পাশে বিপিআইসিসি সভাপতি মসিউর রহমান।

ডা. হাসান বলেন, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাল থাকলে চিকনগুনিয়ার মত রোগ থেকেও দ্রুত আরোগ্য লাভ সহজতর হয়। পুষ্টিকর খাদ্য এ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।

তিনি আরো বলেন, মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি স্বাস্থ্য সচেতন। তরুণদের মাঝে পোল্ট্রি মুরগির মাংসের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। এছাড়াও পোল্ট্রি এদেশে একটি বিপ্লব ঘটিয়েছে। খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণের মাধ্যমে এ শিল্পটি দেশ গঠনেও ভূমিকা রাখছে। তাই তাদের দাবীর সাথে আমরা একাত্মতা প্রকাশ করছি। সরকার অনেক ক্ষেত্রেই প্রণোদনা দিয়ে থাকেন। তাই পোল্ট্রি শিল্পের দাবীগুলো অবশ্যই বিবেচনা করা উচিত।

বক্তব্য রাখছেন বিপিআইসিসি সভাপতি মসিউর রহমান

বক্তব্য রাখছেন বিপিআইসিসি সভাপতি মসিউর রহমান

বক্তব্য রাখছেন ইউএসএসইসি এর কনসালট্যান্ট মি. পাওয়ান কুমার

বক্তব্য রাখছেন ইউএসএসইসি এর কনসালট্যান্ট মি. পাওয়ান কুমার

DSC01434

বক্তব্য রাখছেন ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবু লুৎফে ফজলে রহিম খান শাহরিয়ার

অনুষ্ঠানে ইউএসএসইসি এর কনসালট্যান্ট মি. পাওয়ান কুমার বলেন প্রোটিন ঘাটতির কারণে বাংলাদেশের মানুষের আয়ুস্কাল অনেক কম। তাই গড় আয়ু বাড়াতে হলে পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। কারণ একজন মানুষ কত বছর বাঁচবে তার ২৫ শতাংশ নির্ভর করে জীনগত বৈশিষ্ট্যের ওপর। কিন্তু ৭৫ শতাংশই নির্ভর করে সে কী খাচ্ছে তার ওপর। তিনি বলেন বিশ্বের ৩৯টি দেশের মানুষের গড় আয়ু ৮০ বছরের উপরে। ২০১৬ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গড় আয়ুস্কাল সবচেয়ে বেশি ছিল মোনাকো’র (৮৯.৫ বছর)। দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল জাপান (৮৫ বছর)। এরপর সিঙ্গাপুর (৮৪.৯৫ বছর), হংকং (৮২.৪৪ বাছর), ইতালী (৮২.৪৪ বছর), কানাডা (৮১.৮৫ বছর), ফ্রান্স (৮১.৬৮ বছর), যুক্তরাষ্ট্র (৭৯ বছর) এবং শ্রীলংকা (৭৬.৭৫ বছর)। গড় আয়ুস্কালের দিক থেকে ভারত, নেপাল, এবং পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫৪ নম্বরে, গড় আয়ুস্কাল ৭১.২৩ বছর। ভারতের অবস্থান ১৬৭ নম্বরে (৬৮.৪৫ বছর), নেপাল ১৬৮ নম্বরে (৬৭.৮৬ বছর) এবং পাকিস্তান ১৬৯ নম্বরে (৬৭.৭৩ বছর)। মি. পাওয়ান বলেন, ২০৫০ সাল নাগাদ জাপান তার দেশের মানুষের গড় আয়ুস্কাল ৮৫ থেকে বাড়িয়ে ৯১.৫৮ বছরে এবং সিঙ্গাপুর ৯১.৫৫ বছরে উন্নীত করার পরিকল্পনা নিয়েছে। তাহলে বাংলাদেশ ও ভারতসহ উপমহাদেশের অপরাপর দেশগুলোর আয়ুস্কাল বাড়ানোর ব্যাপারে সরকারের অবশ্যই পরিকল্পনা নেয়া উচিত।
DSC01318
বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাষ্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) এর সভাপতি মসিউর রহমান বলেন, আমরা মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে যুক্ত হতে যাচ্ছি। সামনে এগুতে হলে আমাদের দরকার সুস্থ, কর্মক্ষম এবং মেধাবী জাতি। সেজন্য প্রোটিন ইনটেক বাড়াতে হবে এবং প্রাণিজ প্রোটিনের ইনটেক অন্তত: দ্বিগুণ করতে হবে।

মসিউর রহমান আরো বলেন, বাংলাদেশে মাথাপিছু প্রোটিন কনজাম্পশন প্রায় ৬৬ গ্রাম। এর মধ্যে মাত্র ২৫ শতাংশ আসে প্রাণিজ আমিষের উৎস থেকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মাথাপিছু প্রোটিন কনজাম্পশন ৮৩ গ্রাম যার ৬৭ শতাংশই আসে প্রাণিজ আমিষের উৎস থেকে। তিনি বলেন, আমাদের দেশে মুরগির ডিম ও মাংসই হচ্ছে সবচেয়ে সস্তা প্রাণিজ আমিষ। ২০২১, ২০২৫ কিংবা ২০৪১ সালে পোল্ট্রির ওপর নির্ভরশীলতা আরো বাড়বে। তাই এ শিল্পের ওপর অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

তিনি আরো বলেন, শুধু বাংলাদেশেই নয় এ উপমহাদেশের দেশগুলোতে ‘পুষ্টি ঘাটতি’ একটি বড় সমস্যা। পুষ্টি ঘাটতির কারণে মানুষ নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হয়। এতে সে আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অপুষ্টি, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দুর্বল কওে দেয়। বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। শিশু ঘনঘন অসুস্থ হলে তার ওজন কমে যায়। রক্ত স্বল্পতা দেখা দেয়। গবেষকরা বলছেন, ডায়রিয়া এবং নিউমোনিয়ায় পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর আরেকটি কারণও অপুষ্টি। মায়ের শরীর থেকে পাওয়া পুষ্টি শিশুকে বিভিন্ন রোগ থেকে রক্ষা করে। শূন্য থেকে ৮ বছর বয়সের মধ্যেই মস্তিকের প্রায় ৯০ ভাগ কোষের গঠন সম্পন্ন হয়। তাই এ সময় তাকে পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে। মেয়ে-শিশুদের পুষ্টিকর খাবার দিলে ভবিষ্যতে সে স্বাস্থ্যবান শিশুর মা হতে পারবে।

তিনি বলেন, বর্তমান সরকার ‘পুষ্টি নিরাপত্তা’র ওপর জোর দিয়েছেন। এখন অপুষ্টির হার কিছুটা কমলেও তা প্রত্যাশার অনেক নিচে। গত ৬ মে, দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে-অপুষ্টি দূর করার জন্য সরকারের নানাবিধ কার্যক্রম চালু থাকা সত্ত্বেও, সচেতনতার অভাবে অপুষ্টি সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব হচ্ছে না। অপুষ্টির হার কমাতে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি সরকারকেও স্কুলের টিফিনে সপ্তাহে অন্তত: ২-৩ দিন ১টি করে সেদ্ধ ডিম দেয়ার উদ্যোগ নিতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞান ইনন্সিটিউটের প্রফেসর ড. খালেদা ইসলাম বলেন, আমরা অনেকেই জানিনা প্রতিদিন কী পরিমান প্রোটিন গ্রহণ করতে হবে। প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রতি কিলো ওজনের জন্য এক গ্রাম হিসেবে প্রোটিন গ্রহণ করতে হবে। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে এ পরিমাণ অনেক বেশি। তিনি বলেন, সুস্থ্য-সবলভাবে বাঁচতে হলে পর্যাপ্ত প্রোটিন গ্রহণ করতে হবে। শিশুর দৈহিক গঠন ও মেধার বিকাশে এবং প্রসূতি মায়েদের পুষ্টিকর খাবার দেয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ যতœবান হওয়া দরকার।

বিশিষ্ট রন্ধন শিল্পী কেকা ফেরদৌসী বলেন, মুখরোচক খাবার নয় বরং সুস্বাস্থ্যের জন্য পুষ্টিকর খাবারের প্রতি মনোযোগী হতে হবে। ডিম, দুধ, মাছ, মাংস ইত্যাদি খাবারগুলো প্রোটিনের ভালো উৎস। বর্তমান প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা ব্রয়লার মুরগির মাংসই বেশি পছন্দ করে। তাছাড়া ব্রয়লার মুরগির মাংস দিয়ে যত পদের মজাদার খাবার তৈরি করা যায় অন্য কিছু দিয়ে হয়ত তা সম্ভব নয়।

শের-ই-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. আনোয়ারুল হক বেগ বলেন, প্রোটিনের চাহিদা পূরণে দেশীয় পোল্ট্রি শিল্প বড় ভূমিকা রাখছে। তিনি বলেন, বিদেশীরা মাত্র ২.৫ শতাংশ হার সুদে টাকা এনে এদেশে বিনিয়োগ করছে। এমন অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রতিযোগিতায় দেশীয় খামারি ও উদ্যোক্তারা এখনও কিভাবে টিকে আছে সেটাই আশ্চর্যের বিষয়।

চট্টগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. নীতিশ দেবনাথ বলেন, সবচেয়ে স্টেবল এবং কম দামের প্রাণিজ আমিষের খাবার হচ্ছে ডিম এবং অন্য যেকোনো মাংসের চেয়ে মুরগির মাংসের দাম সবচেয়ে কম। আমাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন দরকার। একইসাথে স্বাস্থ্য বিষয়ক শিক্ষারও আমূল পরিবর্তন আনতে হবে।

ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবু লুৎফে ফজলে রহিম খান শাহরিয়ার বলেন, ২০-২৫ বছর আগেও আমরা বছরে গড়ে ১৫টা ডিম খেতাম। মুরগির মাংস খেতাম ১.৫ কেজি। কিন্তু এখন ডিম খাই গড়ে প্রায় ৫১টি, মুরগির মাংস প্রায় সাড়ে ৪ কেজি। আগে সবচেয়ে বেশি দাম ছিল মুরগির মাংসের আর এখন মুরগির মাংসই সবচেয়ে সস্তা।

তিনি বলেন, চাহিদা বাড়াতে হবে। তাহলে উৎপাদন খরচ কমানো সম্ভব হবে। সরকার যদি হঠাৎ হঠাৎ করে পলিসি পরিবর্তন করেন তবে পোল্ট্রি উদ্যোক্তারা বিপদের মুখে পড়বেন। আমরা সাবসিডি চাইনা। উৎপাদন খরচ কমানোর স্বার্থে ভুট্টার আমদানির ওপর থেকে অগ্রিম আয়কর এবং সয়াবিনের ওপর থেকে আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।

প্রশ্নোত্তর পর্বে বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ডা. এম.এম খান বলেন অনেকের ধারণা পোল্ট্রি মুরগি এত তাড়াতাড়ি বাড়ে কারণ এতে হরমোন ব্যবহার করা হয়। এটি একটি সম্পূর্ণ ভুল ধারনা। মুরগির বৃদ্ধির সাথে হরমোনের কোন সম্পর্ক নেই। এটি সম্ভব হয়েছে জেনেটিক ডেভেলপমেন্টের কারণে। তিনি বলেন, খাদ্যে এন্টিবায়োটিক নয়, প্রোবায়োটিক এবং প্রিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। খাদ্যের উপকরণগুলো যাতে সর্বোচ্চ পর্যায়ে মুরগির শরীরে কাজে লাগে এবং যেন সহজেই হজম হয় সেভাবেই ফিডের ফর্মূলা তৈরি করা হয়।

সেমিনারে সঞ্চালক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিপিআইসিসি’র উপদেষ্টা জনাব শ্যামল কান্তি ঘোষ। অন্যান্যের মাঝে উপস্থিত ছিলেন- নাহার এগ্রোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক রকিবুর রহমান, ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান বাবু, ওয়াপসা বাংলাদেশ শাখার সাধারণ সম্পাদক মাহবুব হাসান, সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল হক, আহকাব এর সাধারণ সম্পাদক ডা. মো. কামরুজ্জামান, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের উপসচিব অনিমা রাণী বিশ্বাস, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের এনিমেল হেলথ এন্ড এডমিনিস্ট্রেশনের অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টর মো. আবু সুফিয়ান, অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টর খামার নকিবুল্লাহ সিদ্দিক, শের-ই-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. মো. মুফাজ্জল হোসেন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. লুৎফর রহমান, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস এর এগ্রোভেট ডিভিশনের জেনারেল ম্যানেজার জয়ন্ত দত্ত গুপ্ত, বিপিআইসিসি’র সচিব দেবাশিস নাগ, মিডিয়া উপদেষ্টা মো. সাজ্জাদ হোসেন এবং কর্মকর্তা আবু বকর, প্রমুখ। এছাড়াও মহাখালীস্থ টি এন্ড টি মহিলা কলেজ এবং টি এন্ড টি গার্লস স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষাথীরাও সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন।

This post has already been read 4866 times!