Sunday , September 14 2025

জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ‘অদৃশ্য রক্তক্ষরণ’

মো. খোরশেদ আলম জুয়েল: বাংলাদেশের অর্থনীতি জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে নিঃশব্দে রক্তক্ষরণ করছে; যা হয়তো আমাদের অধিকাংশ মানুষের চোখেই পড়ছে না। এটি এমন এক অদৃশ্য রক্তক্ষরণ যার ফলে প্রতি বছর বর্তমানে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ১-২ শতাংশ হারাচ্ছে, যা টাকার অঙ্কে দাঁড়ায় আনুমানিক ৪৫০ কোটি থেকে ৯০০ কোটি মার্কিন ডলার বা প্রায় ৫০ হাজার কোটি থেকে ১ লাখ কোটি টাকা।

সরকারি ও বিশেষজ্ঞ মহলের হিসাব অনুযায়ী আরো আশঙ্কাজনক বিষয় হলো- যদি বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকে, ভবিষ্যতে এই ক্ষতি জিডিপির ৯ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। অর্থাৎ তখন প্রতিবছর ৪ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের বেশি, বা ৪০ লাখ কোটি টাকারও বেশি অর্থনীতি থেকে হারিয়ে যাবে।

বাংলাদেশের জন্য এই চিত্র উদ্বেগজনক। কারণ, জলবায়ু পরিবর্তন শুধু অবকাঠামো ধ্বংস করছে না, বরং কৃষি উৎপাদন কমাচ্ছে, মানুষের জীবিকা হুমকির মুখে ফেলছে এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষাক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। শুধু তাই নয়, রাজনীতিতে এর এক বাস্তবমুখী প্রভাব আছে। কারণ- খাদ্য, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো বিষয়গুলোর সাথে একটি দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অস্থিরতাও নির্ভর করে।

যাইহোক, জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (NAP) বাস্তবায়নে ২০৫০ সাল পর্যন্ত ২৩​০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, আর জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান (NDC) পূরণে শর্তযুক্ত অংশে ১৭৫ বিলিয়ন ডলার এবং শর্তহীন অংশে ৪৫ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে, জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞগণ। অর্থাৎ দীর্ঘমেয়াদে শত শত বিলিয়ন ডলারের অর্থায়ন ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।

কিন্তু আমাদের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ কয়েকদিন আগে খুব আফসোসের সাথে বলেছেন, “জলবায়ু অর্থায়নে খুব সম্ভবত বাংলাদেশের জন্য বছরে ৩ হাজার কোটি ডলার প্রয়োজন। অথচ আইএমএফ থেকে ১০০-১৫০ কোটি ডলার বের করতেই আমাদের জান বেরিয়ে যায়।“

এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ জলবায়ু খাতে নিজস্ব অর্থ থেকে ব্যয় করছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) প্রায় ১০ শতাংশ, যা জিডিপির প্রায় ১ শতাংশ সমান। তবে এই ব্যয় ক্রমেই বাড়ছে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মধ্যে বাংলাদেশ গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ড (GCF) থেকে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং লিস্ট ডেভেলপড কান্ট্রিজ ফান্ড (LDCF) থেকে প্রায় ৩০ মিলিয়ন ডলার পেয়েছে। অ্যাডাপ্টেশন ফান্ডে রয়েছে মাত্র একটি প্রকল্প। অথচ বাংলাদেশের প্রয়োজন শত শত বিলিয়ন ডলার, যা বর্তমান সহায়তার তুলনায় খুবই নগণ্য।

জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক ফান্ডের আরো একটি মজার বিষয় হলো -এজন্য দায়ী দেশগুলো প্রয়োজনে তুলনায় খুবই নগণ্য পরিমান অর্থায়ন করতে রাজী হলেও, সেটিও তারা ঋণ হিসেবে দিতে চায়। অথচ এটির জন্য যে তারা দায়ী এবং সেজন্য ঋণ নয়; বরং ক্ষতিপূরণ দেয়া উচিত -সেটি তারা কোনভাবে শুনতেই নাকি চান না।

জলবায়ু অর্থায়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো অনুদান বনাম ঋণ, অর্থপ্রবাহের পূর্বাভাসযোগ্যতা এবং সহজ প্রবেশাধিকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্ষতি যদি দ্রুত না ঠেকানো যায়, তবে অদূর ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তন দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে।

অন্যদিকে আরো একটি প্রশ্ন হচ্ছে- জলবায়ু পরিবর্তনের এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমরা কি শুধু অনুদান বনাম ঋণের অপেক্ষাতেই থাকবো নাকি জনসচেতনতা তৈরি ও স্থানীয় পরিবেশ দুর্বাত্তয়ন ঠেকাতে কঠোর ও কার্যকর হবো। নয়তো,এই রক্তক্ষরণ একদিন জাতীয় অর্থনীতিতে রক্ত শূন্যতা তৈরি করতে পারে।

লেখক: সম্পাদক ও প্রধান নির্বাহী, এগ্রিনিউজ২৪.কম।

This post has already been read 21 times!

Check Also

গরু ও মাংসের বাজার: সংকট ও ভবিষ্যৎ করণীয়

নাহিনুর রহমান : গরু নিয়ে দেশে বড় রকমের মশকরা ঘটে গেছে গত হপ্তায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার  …