Thursday , September 11 2025

নদী বাঁচলে, মানুষ বাঁচবে

শহীদ আহমদ খান : বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একেবারে উত্তর-পূর্ব কর্ণারে অবস্থিত বৃহত্তর জৈন্তিয়ার কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর ও কানাইঘাট উপজেলা। এগুলো ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পৃথিবীর সবচেয়ে বৃষ্টিপ্রবণ পাহাড়ি স্থান, বৃহত্তর জৈন্তিয়া চেরাপুঞ্জির পাদদেশে। ফলে বর্ষাকালে চেরাপুঞ্জিতে অধিক বৃষ্টিপাত হলেই উজান থেকে নেমে আসা তীব্র পাহাড়ি ঢল মুহূর্তের মধ্যে সমগ্র জনপদকে প্লাবিত করে ফেলে। এতে ফসলহানি, ঘরবাড়ি বিনষ্ট, গবাদিপশুর প্রাণহানি, মৎস্য খামার ভেসে যাওয়া এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।

চলতি বছরের জুন মাসে দেশ-বিদেশের সকল মানুষই প্রত্যক্ষ করেছেন সর্বনাশা প্রলয়ংকারী বন্যার তাণ্ডবলীলা। প্রশ্ন হলো, বন্যা সমস্যার এত তীব্রতার কারণ কী?

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, স্বাধীনতা-উত্তর ১৯৭২–৭৫ সাল পর্যন্ত নদীগুলো ছিল স্রোতস্বিনী। যার ফলে সেখানে ধানের বাম্পার উৎপাদন হতো, প্রাকৃতিক জলাশয়ে প্রচুর মিঠা পানির মাছ পাওয়া যেত, আর বনাঞ্চল সমৃদ্ধ হওয়ায় বর্ষা ও শুকনো মৌসুমে প্রচুর প্রাকৃতিক ঘাস জন্মাত। এতে গবাদিপশু লালন-পালন সহজ ছিল। এজন্যই জৈন্তিয়ার ঘি, দুধ, মাটির সুখ্যাতি আজও লোকমুখে শোনা যায়।

কিন্তু দুঃখজনকভাবে বছরের পর বছর নদী ও জলাশয়ে পলি-বালু জমে ক্রমে তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। পিয়াইন নদী আজ মৃতপ্রায়, সারি, সুরমা ও গোয়াইন নদী আধমরা অবস্থায় বয়ে চলেছে। সমস্যা শুরু হয়েছিল অল্প করে প্রায় ৫০ বছর আগে, আর এখন তা মহাকার ধারণ করেছে। সমৃদ্ধ জৈন্তিয়া আজ বারবার পাহাড়ি ঢলে আক্রান্ত হয়ে ফসল, ঘরবাড়ি, মৎস্যসম্পদ, গবাদিপশু হারাতে হারাতে শ্মশানে পরিণত হয়েছে।

এবারের কয়েক দফা প্রলয়ংকারী বন্যায় মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ে। তবে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে ধন্যবাদ জানাই সরকারকে, সামাজিক সংগঠনগুলোকে, সমাজের বিত্তশালী মানুষকে এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ সিলেট জেলা ও মহানগর শাখা সহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে—যারা বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল।

রাতারগুল জলাধার বনটি সেই গোয়াইন নদীর তীরেই অবস্থিত। একসময় সমগ্র জৈন্তিয়াজুড়ে এরকম বহু জলাধার বন ছিল, যেখানে বাস করত বানরসহ অসংখ্য প্রাণী ও পাখি। বর্তমানে রাতারগুল ছাড়া আরও দুটি জলাধার বন রয়েছে—একটি গোয়াইনঘাট উপজেলার নন্দিরগাঁও ইউনিয়নের সালুটিকর বাজার সংলগ্ন দামারি ও বৌলা বিলে, অপরটি একই উপজেলার তোয়াকুল ইউনিয়নের বালিধার নদী থেকে শুরু হয়ে ফুলতৈলছগাম, কামারগ্রাম, লাকিগ্রামের পশ্চিম দিকে বিস্তৃত। কিন্তু এগুলো লোকচক্ষুর আড়ালে থাকায় মিডিয়াতে তেমন আসে না।

এভাবে জলাধার বন, নলখাগড়া, ছন, শীতল পাটির কাঁচামাল মুড়তা, জালিবেত, দুবড়ীবনসহ অসংখ্য উদ্ভিদ আজ বিপন্ন। শুকনো মৌসুমে নদী-হাওড়-ঝিলে পানি না থাকায় শিকড় দিয়ে পানি সংগ্রহ করতে না পেরে ফাল্গুন-চৈত্র মাসে উদ্ভিদগুলো মরে যায়। রাখাল ছেলেরা আনন্দ করতে গিয়ে মৃত বনে আগুন ধরালে বনভূমি ছারখার হয়ে যায়। অথচ এর কোনো দেখভাল নেই, দায়ও নেয় না কেউ।

এভাবে বন-জঙ্গল ও পশুখাদ্য বিলুপ্ত হওয়ায় এককালের সমৃদ্ধ জৈন্তিয়ায় প্রচুর গবাদিপশু থাকলেও আজ তা গল্প মাত্র। কৃষিকাজে গরু দিয়ে হালচাষ এখন হাস্যকর; কৃত্রিম লাঙ্গল দিয়ে চলছে চাষাবাদ।

একইভাবে প্রাকৃতিক জলাশয়ে মাছ প্রায় বিলুপ্তপ্রায়। মৎস্য খরার পাশাপাশি নদীতে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অসাধু মৎস্যজীবিদের কার্যকলাপ। তারা জলাশয়ে বিষ প্রয়োগ করে মাছ ধরছে, আর পোনা মাছ প্রজনন মৌসুম থেকে সারা বছরই নিধন করা হচ্ছে। এতে প্রাণী, উদ্ভিদ ও পাখি ধ্বংসের মুখে পড়েছে।

ফলে বৃহত্তর জৈন্তিয়া বর্ষায় ভয়াবহ পাহাড়ি ঢলের শিকার আর শীতে পানির অভাবে মরুভূমিতে পরিণত হয়। সত্যিকারের এই দুর্দশা কেবল ভুক্তভোগীরাই উপলব্ধি করতে পারে।

জৈন্তিয়াকে বাঁচাতে হলে কেবল ত্রাণ নয়, প্রকৃত সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজন নদীগুলোর ক্যাপিটাল ড্রেজিং, দ্রুত পানি নিষ্কাশনের জন্য বঙ্গবন্ধু মহাসড়কের সেতুগুলোর সংস্কার, এবং হাওড়ের জনপদে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে পরিবেশবান্ধব প্রকল্প গ্রহণ।

অন্যদিকে, জৈন্তিয়ার নদীগুলো মরে গিয়ে যখন জনপদকে ধ্বংস করছে, তখন সেই নদীর গর্ভে থাকা সিলেট স্টোন ও সাদা পাথর দেশের মেগা প্রকল্পগুলোতে ব্যবহার হয়ে গর্বের কারণ হয়েছে। ভৈরবের মেঘনা সেতু, বঙ্গবন্ধু যমুনা বহুমুখী সেতু, এমনকি স্বাধীনতা-উত্তর সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন পদ্মা সেতুতেও এ অঞ্চল থেকে সংগৃহীত পাথর ব্যবহৃত হয়েছে।

তবু নদীগুলো বাঁচাতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের বিকল্প নেই। ছড়াগুলোসহ নদীগুলো টিকিয়ে রাখতে পারলে সিলেট স্টোন সংগ্রহের সুযোগ আজীবন থাকবে; অন্যথায় সেই সুযোগও হারিয়ে যাবে।

আজ উন্নয়নের রোল মডেল, মানবতার জননী, দেশরত্ন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওড়পাড়ের ৬ জেলার কোটি মানুষের জীবনমান উন্নয়নে (মেঘনা থেকে বরাক পর্যন্ত) নদীগুলোকে বিআইডব্লিউটিএ’র মাধ্যমে ক্যাপিটাল ড্রেজিং করার নির্দেশ দিয়েছেন।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পিয়াইন (শাখাসহ) এবং সারি-গোয়াইন নদী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। ফলে বৃহত্তর জৈন্তিয়া রাষ্ট্রীয় বিমাতাসুলভ আচরণের শিকার হতে চলেছে লাল ফিতার দৌরাত্ম্যে—যা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। বিষয়টি জানাজানির পর বহু সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।

বৃহত্তর জৈন্তিয়া তথা সিলেটের মানুষকে বন্যার কবল থেকে বাঁচাতে হলে ছোট-বড় সব নদীই জরুরি ভিত্তিতে খনন করতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক সামাজিক সংগঠক

This post has already been read 3 times!

Check Also

গরু ও মাংসের বাজার: সংকট ও ভবিষ্যৎ করণীয়

নাহিনুর রহমান : গরু নিয়ে দেশে বড় রকমের মশকরা ঘটে গেছে গত হপ্তায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার  …