Saturday 27th of April 2024
Home / অন্যান্য / দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০৭টি উপজেলার মাটি ও পানি লবণাক্ততায় আক্রান্ত

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০৭টি উপজেলার মাটি ও পানি লবণাক্ততায় আক্রান্ত

Published at ডিসেম্বর ৫, ২০২৩

ফকির শহিদুল ইসলাম (খুলনা) : বিশ্ব মৃত্তিকা দিবসটি বার্ষিক ইভেন্ট যা পৃথিবীতে জীবনকে সমর্থন করার জন্য মাটির তাৎপর্য প্রচার করার একটি প্ল্যাটফর্ম হিসাবে কাজ করে। এটির লক্ষ্য কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, জীববৈচিত্র্য, জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ এবং আরও অনেক কিছুতে মাটি যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সে সম্পর্কে ব্যক্তি এবং সম্প্রদায়কে সচেতন করা। মাটির স্বাস্থ্যের উপর গুরুত্ব কেন্দ্রীভূত করা এবং মৃত্তিকা সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনার পক্ষে সমর্থন করার জন্য প্রতি বছর ৫ ডিসেম্বর বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস (ডড়ৎষফ ঝড়রষ উধু) পালিত হচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়- “মাটি ও পানিঃ জীবনের উৎস”।

সোমবার সকাল ১০টায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালকের কার্যালয় হতে শুরু করে শহরের প্রধান প্রধান সড়ক ঘুরে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালকের কার্যালয়ে শেষ হয়। র‌্যালী শেষে কৃষি তথ্য সার্ভিসের কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাগেরহাট জেলার জেলা প্রশাসক মোহাঃ খালিদ হোসেন, সভায় স্বাগত বক্তব্য প্রদান ও মৃত্তিকা বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, লবণাক্ততা ব্যবস্থাপনা ও গবেষণা কেন্দ্র খুলনার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও গোপালগঞ্জ, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও পিরোজপুর কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প (এসআরডিআই অংগ)র প্রকল্প পরিচালক অমরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস। সভাপতিত্ব করেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ শঙ্কর কুমার মজুমদার।

এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন বিএডিসি এর কর্মকর্তা, জেলা মৎস্য অফিসার, জেলা প্রাণি সম্পদ অফিসার, জেলা তথ্য অফিসার, উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, কৃষক প্রমূখ। আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় মৃত্তিকা বিজ্ঞানী অমরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস বলেন, সারা পৃথিবীতে মানুষ যে সকল খাবার খায়, তার অন্তত শতকরা ৯৫ ভাগ আসে মাটি হতে। ২০৫০ সাল নাগাদ প্রায় ৯৩০ কোটি মানুষের খাদ্যের যোগান দিতে শতকরা ৬০ ভাগ বেশি খাদ্য উৎপাদন করতে হবে। পৃথিবীর পানির মাত্র ২.৫% হল সুপেয় পানি এবং বাকি ৯৭.৫% হল ভূগর্ভস্থ পানি ও বরফ। সুপেয় পানির ০.৩%-এরও কম অংশ পাওয়া যায় নদীতে, হ্রদে ও বায়ুমন্ডলে এবং তার চেয়েও ন্যূনতর অংশ পাওয়া যায় বিভিন্ন জীবের শরীর ও উৎপাদিত পণ্যে। ১৯৭১ সালে চাষযোগ্য জমি ছিল ২ কোটি ১৭ লাখ হেক্টর, খাদ্য উৎপাদন হতো ১ কোটি ১০ লক্ষ টন।

তিনি বলেন, বর্তমানে চাষযোগ্য জমি ৮৮ লক্ষ ২৯ হাজার হেক্টর, খাদ্য উৎপাদন ৩ কোটি ৬৬ লক্ষ টন (চাল) । স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের তুলনায় চাষযোগ্য জমি হ্রাস পেয়েছে অর্ধেকেরও বেশি কিন্তু তার বিপরীতে খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে ৩ গুণের বেশি।

তিনি আরো বলেন, বর্তমান কৃষি বান্ধব সরকারের সঠিক নীতি প্রণয়নের ফলে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২ এর আওতায় ২০৩০ সালের মধ্যে কৃষির উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই টেকসই কৃষি উন্নয়ন নিশ্চিত করতে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্য অর্জনে সীমিত মৃত্তিকা সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনার কোন বিকল্প নেই।

মৃত্তিকা বিজ্ঞানী বলেন, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৬৮,৭৬০ হেক্টর (০.৭৩%) আবাদি জমি অনাবাদি জমিতে পরিণত হচ্ছে। যেখানে গৃহ নির্মাণ হচ্ছে ৩০,৮০৯ হেক্টর জমিতে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ (শতকরা প্রায় ৩৪ ভাগ) মাটি অবক্ষয়ের শিকার। জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থা আশংকা করছে যে, বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ অবক্ষয়ের এই হার নব্বই শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়া বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৮টি জেলার ১০৭টি উপজেলার মাটি ও পানি বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ততায় আক্রান্ত। ১৯৭৩ সালে লবণাক্ত জমির পরিমাণ ছিল ৮ লক্ষ ৩৩ হাজার হেক্টর। ২০০০ সালে বেড়ে গিয়ে ১০ লক্ষ ২০ হাজার হেক্টরে দাড়িয়েছে এবং ২০১০ সালে লবণাক্ততায় আক্রান্ত জমির পরিমাণ ১০ লক্ষ ৫৬ হাজার হেক্টর । লবণাক্ততার কারণে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শুকনো মৌসুমে কৃষক ভাইয়েরা ফসল আবাদ করতে পারে না।

মৃত্তিকা বিজ্ঞানী আরো বলেন, জমিতে লবণাক্ত পানি ঢুকিয়ে চিংড়ি চাষ করার ফলে এলাকায় লবণাক্ততা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাবার অন্যতম একটি কারণ। লবনাক্ততার মান বৃদ্ধির পাশাপাশি জমির উর্বরতার মান দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। মুখ্য পুষ্টি উপাদান নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাসিয়াম ও গন্ধক এবং গৌণ পুষ্টি উপাদান দস্তা ও বোরন এর ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। লবণাক্ততা, নদী ভাঙন ইত্যাদি কারণে প্রতি বছর এক দিকে কৃষি জমি যেমন কমে যাচ্ছে অপরদিকে ভেজাল সার ও অপরিকল্পিতভাবে কীটনাশক ব্যবহারের কারণে মাটির স্বাস্থ ও পরিবেশ দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে । লবণাক্ত এলাকায় ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধির জন্য খামার পুকুর প্রযুক্তি, মালচ ব্যবহার ও কলস সেচের মাধ্যমে বিভিন্ন মাদা ফসল এর আবাদ বৃদ্ধি করা সম্ভব। মাটি হলো খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তার ভিত্তি। তাই মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষা সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ন। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাটির সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার বিকল্প নেই। তাই আমাদের উচিত মাটি পরীক্ষা করে জমিতে সুষম মাত্রায় জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা যাতে মাটির কাংখিত উর্বরতা ধরে রাখা যায় এবং ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।

প্রধান অতিথি  মোহা. খালিদ হোসেন বলেন, মৃত্তিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। এই সম্পদ ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। একদিকে মাটির পুষ্টি উপাদানের মাত্রা কমে যাচ্ছে,অন্যদিকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই আমাদের মৃত্তিকা সংরক্ষণের উপর গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। সভাপতির বক্তৃতায় শঙ্কর কুমার মজুমদার বলেন, মাটিকে আমাদের সম্পদে পরিণত করতে হবে। তবেই দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাটির সুস্বাস্থ্য বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এদেশের মাটিকে সোনার চেয়ে খাঁটি বলা হয় অথচ সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে এই মাটি আজ হুমকির সম্মুখীন। তাই আমাদের উচিত মাটি পরীক্ষা করে জমিতে সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করা যাতে মাটির কাংখিত উর্বরতা ধরে রাখা যায় এবং ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।

This post has already been read 732 times!