Tuesday 19th of March 2024
Home / আঞ্চলিক কৃষি / পানির নিচে সুনামগঞ্জের সবচেয়ে বড় হাওরের বোরো ধান

পানির নিচে সুনামগঞ্জের সবচেয়ে বড় হাওরের বোরো ধান

Published at এপ্রিল ১০, ২০২২

শহীদ আহমদে খান (সিলেট সংবাদদাতা):  সুনামগঞ্জের একটি বড় হাওর হচ্ছে চাপতির হাওর। গত বুধবার রাত দেড়টার দিকে জেলার দিরাই উপজেলার চাপতির হাওরের বৈশাখী এলাকার ফসল রক্ষা বাঁধটি ভেঙে হাওরে ঢলের পানি প্রবেশ করেছে। এতে তলিয়ে গেছে হাওরের কাঁচা ধান।

সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ নেতা আবদুল মোনেম চৌধুরী এডভোকেট এক বিবৃতিতে বলেন, সুনামগঞ্জে হাওরে একের পর এক বাঁধ ভাঙছে, ডুবছে কৃষকের শ্রমে-ঘামে ফলানো সোনার ধান। গত ১ সপ্তাহে অন্তত ১০টি হাওরে ফসলহানি ঘটেছে। তবে ডুবে যাওয়া হাওরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে চাপতির হাওর।

তিনি বলেন, সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলা করিমপুর, জগদল, তাড়ল এই ৩টি ইউনিয়নে চন্ডিপুর, কচুয়া, নাসিরপুর, টুকদিরাই, চানপুর, মাটিয়াপুর, দক্ষিণ হালিমপুর, নোয়াগাঁও, উত্তর হালিমপুর, গোবিন্দপুর, ধিতপুর, বড় নগদীপুর, নগদীপুর, কাউয়াজুরী, পুরান নগদীপুর, পুকিচর, দৌলতপুর, সিকন্দরপুর, হুসেনপুর, কামারবীচ, জগদল, মাতারপুর, কালিয়ার কাপ, বকশিপুর, মাটিরগাঁও সহ ২৯টি গ্রামের প্রায় ৪ হাজার হেক্টর বোরো ফসল পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বছরের একমাত্র ফসল হারিয়ে অত্র এলাকার কৃষকগণ নিঃস্ব হয়ে আহাজারী করছেন।

চাপতির হাওরের বৈশাখী বাঁধটি ভাঙ্গে যাওয়ায় ঝুঁকিতে পড়েছে পাশের জগদল ও মাটিয়াপুরের হাওর। উজানের ঢল নামা অব্যাহত থাকায় পানি বাড়ছে জেলার জাদুকাটা, রক্তি, বৌলাই, পাটলাই, নলজুর, কালনি, চলতি, ধারাইন, চেলা, কংসসহ অন্যান্য নদ-নদীর পানি। গত এক সপ্তাহ ধরে ভারতের মেঘালয় ও চেরাপুঞ্জি থেকে নামা পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জে অস্বাভাবিকভাবে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে ঝুঁকিতে পড়েছে জেলার সব হাওরের বোরো ফসল।

হাওরের কৃষকেরা বলছেন, হাওরে ধান পাকতে কমপক্ষে ১০ দিন সময় লাগবে। ২০১৭ সালে এই সময়েই হাওরের সব কাঁচা ধান তলিয়ে গিয়েছিল। যদি ঢল নামা অব্যাহত থাকে, তাহলে পানি উন্নয়ন বোর্ড যেসব বাঁধ দিয়েছে, তাতে ফসল রক্ষা হবে না।

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এবার জেলায় ২ লাখ ২২ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। এতে ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকার ফসল উৎপাদিত হওয়ার কথা। তাদের হিসাবমতে, গতকাল পর্যন্ত জেলায় ফসলহানি হয়েছে ৬৪৪ হেক্টরের। তবে হাওর আন্দোলনের নেতারা বলছেন, ক্ষতির পরিমাণ চাপতির হাওর ছাড়াই ৫ থেকে ৬ হাজার হেক্টর হবে।

একাধিক কৃষক জানিয়েছেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) যেসব স্থানে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করেছে, সেসব বাঁধ ভাঙল কি না, এর তথ্যই কেবল কৃষি কর্মকর্তারা নিচ্ছেন। পাউবোর অর্থায়নে নির্মিত এসব বাঁধের বাইরেও অনেক বাঁধ স্থানীয়ভাবে নির্মিত হয়েছে। এর অনেকগুলো এরই মধ্যে ভেঙে ফসল তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া অসংখ্য বাঁধ এখন ঝুঁকিতে আছে। পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকলে যেকোনো মুহূর্তে এসব বাঁধ ভেঙে যাবে। বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও নিম্নমানের কাজই এর জন্য দায়ী। এর বাইরে নদ-নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় বাঁধ উপচেও বেশ কয়েকটি হাওর তলিয়ে গেছে।

হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের সময়সীমা ছিল ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি। পরে সময় আরো ১০ দিন বাড়ানো হয়। এরপরও বাঁধ নির্মাণের কাজ শেষ করতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা। কৃষকদের অভিযোগ, নির্ধারিত সময়ে নির্মাণ করতে না পারায় অনেক বাঁধ অপরিপক্ব ও কাঁচা রয়ে গেছে। অথচ এসব বাঁধ নির্মাণের কাজ ও প্রকল্পগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার দায়িত্ব পাউবো ও স্থানীয় প্রশাসনের।

হাওরপারের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, পাহাড়ি ঢল বেশি এসে যদি অকালবন্যা দেখা দেয়, তাহলে বাঁধ সঠিকভাবে নির্মিত হলেও কাজ হবে না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, হাওর অধ্যুষিত সাত জেলার বিভিন্ন স্থানে বাঁধ নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। কোথাও মাটির সঙ্গে বালু মিশিয়ে বাঁধে ফেলা হয়েছে। কোথাও আবার ফেলা হয়েছে কাদামাটি। মাটি দুরমুজ না করায় অনেক বাঁধ টেকসইভাবে তৈরি হয়নি। ফলে যে হারে পানি বাড়ছে, এতে সামান্য পানির তোড়েই বাঁধ ভেঙে যায়।

আবদুল মোনেম চৌধুরী এডভোকেট বলেন, বাঁধগুলো প্রয়োজন উচ্চতা বৃদ্ধি করে দুই লেনের সড়কে পরিণত করতে পারলে একই সাথে হাওরের ফসল রক্ষার পাশাপাশি মানুষের যোগাযোগ সহজতর হবে বলে বিশ্বাস করেন। তিনি সরকারকে হাওর রক্ষা বাঁধকে সড়কে পরিণত করার আহবান জানান। ফলে বাধগুলো স্থায়ীত্ব বৃদ্ধি পাবে এবং বছর বছর বাঁধ ভাঙ্গার আশঙ্কা থেকে কৃষকগণ মুক্ত থাকবেন। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।

এডভোকেট আবদুল মোনেম চৌধুরী বলেন, ইতিমধ্যে পানি সম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম ও স্থানীয় সংসদ সদস্য ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। উপমন্ত্রী হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণে অবহেলা ও দুর্নীতির সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আশ্বাস প্রদান করেছেন। পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জ হাওরের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করে সর্বোচ্চ সহায়তা এবং প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল, ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা সহযোগিতা প্রদানের ঘোষণা দেন।

বিবৃতিতে এডভোকেট আবদুল মোনেম চৌধুরী সুনামগঞ্জ জেলা দুর্গত এলাকা ঘোষণা করে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সর্বোচ্চ আর্থিক অনুদান সহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদান এবং হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণে অবহেলা ও দুর্নীতির সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের আহ্বান জানান।

This post has already been read 2152 times!