সৈয়দ আরিফ আজাদ (সাবেক মহাপরিচালক, মৎস্য অধিদপ্তর) :
১. ‘জীবন–জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’ শিরোনামে এবারের বাজেট পেশ করা হল। প্রেক্ষিত হিসেবে তা খুবই প্রণিধানযোগ্য।
২. স্বাস্থ্য, কৃষি, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ, অটোমোবাইল, ইলেকট্রনিকস এবং আইসিটি খাতের বিকাশ ও উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন মাননীয় অর্থমন্ত্রী । মুরগি/মাছের খাবার উপকরণ আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এতে মুরগি, মাছ ও গবাদিপশুর খাবারের দাম কমানোর সুযোগ তৈরি হবে। মাংস আমদানিতে শুল্কহার বাড়ানো হয়েছে। আরোপ করা হয়েছে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট। আবার ন্যূনতম শুল্কায়ন মূল্যের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ গুলো সব ইতিবাচক দিক। মাছের ক্ষেত্রেও এটা করা প্রয়োজন ছিল।
৩. দেশীয় মাছ উৎপাদনে সুরক্ষা দেয়া এবং মাছ গ্রহণ ও বাজারজাত করণ কিংবা রপ্তানিতে কি কি পদক্ষেপ নিয়ে সারপ্লাস উৎপাদনকে ব্যবহার করা হবে তার কোন দিক নির্দেশনা বাজেটে নেই। সুনীল অর্থনীতির অন্যতম নিয়ামক সামুদ্রিক মৎস্য খাতের প্রতি কোন নীতিগত ও কাঠামোগত সংস্কারের প্রস্তাবনাও বাজেটে প্রতিফলিত হয়নি। অপ্রচলিত মৎস্য চাষ, মেরিকালচার ইত্যাদি বিষয়ে সরকারের সংস্কার ও ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা থাকলে ভাল হত।
৪. আমাদের মনে রাখতে হবে দারিদ্র্য বিমোচনের অন্যতম হাতিয়ার কর্মসংস্থানের অপার সম্ভাবনা এখনও রয়েছে মৎস্য খাতে। যেখানে ফসল খাতে যান্ত্রিকীকরণের জন্য তা প্রায় তলানিতে। দেশের মানুষের আমিষ যোগান ও রোগ প্রতিরোধের নিয়ামক শক্তি হিসেবে মাছ আমাদের জন্য অতুলনীয় পুস্টি উপাদান। সেজন্য উৎপাদনের পাশাপাশি এখন মনোযোগ বেশী দেয়া প্রয়োজন ভ্যালু এডিশান এর দিকে এবং নিরাপদতার দিকে। সাদা মাছের রপ্তানী বাজার বৃদ্ধির দিকে এখনই মনোযোগ দিতে হবে। সে জন্য সাদা মাছের খামার রেজিস্ট্রেশন ও ট্রেসেবিলিটি নিয়ে অবিলম্বে কাজ শুরু করা দরকার। মৎস্য খাতের প্রাণশক্তি বেসরকারী খাতকে কী ভাবে আস্থায় নেয়া যায় তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাজেটে স্বল্প পরিসরে হলেও এসব বিষয় প্রতিফলিত হওয়া প্রয়োজন ছিল।
৫. মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এডিপিতে ২০২১-২২ অর্থ বছরে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৭৮৭.৮০ কোটি টাকা – যা ২০২০-২১ সালে ছিল ১৬১১.৮০ কোটি টাকা। এডিপি বাস্তবায়ন সক্ষমতার বিচারে তা সঠিক বলা যায়। মন্ত্রণালয়ের মোট বরাদ্দ ২০২০-২১ এর ৩১৯৩ কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি করা হয়েছে ৩৪৩৭ কোটি টাকা। রাজস্ব খাতে নুতন জনবল যুক্ত হলে তা বৃদ্ধির প্রয়োজন হবে।
৬. সুপারিশ:
সুপারিশ | বাস্তবায়নে | মন্তব্য |
মৎস্য চাষে ৩০ লাখ টাকার বেশী আয়ের ক্ষেত্রে ১৫% কর অরোপের প্রস্তাব প্রত্যাহার | অর্থমন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় | কতিপয় অসাধু ব্যক্তির জন্য পুরো খাতকে ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেয়া ঠিক হবে না |
মৎস্য খাতের বিদ্যুৎ বিল বানিজ্যিক হারের পরিবর্তে ফসল খাতের অনুরূপ করা | অর্থমন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় | ফসল খাতে বিদ্যুৎ বিল ৪-৫ টাকা/ইউনিট, মৎস্য খাতে ৭-৯ টাকা/ ইউনিট। এতে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যায়। |
মৎস্য খাদ্যের কাঁচামাল আমদানিতে যে কর অবকাশ দেয়া হয়েছে তার সুফল যাতে চাষি পর্যায়ে পৌঁছে তার জন্য মন্ত্রণালয় পর্যায়ে বিশেষ মনিটরিং এর ব্যবস্থা করা | মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় | মৎস্য খাদ্যের কাঁচামাল আমদানিতে যে কর অবকাশ দেয়া হয়েছে তার সুফল ভোগ করে মিলার গণ। |
মাছ চাষের যান্ত্রিকীকরন সহায়তার লক্ষে মৎস্য খাতে ব্যবহৃত ইন্সুলেটেড ট্রান্সপোর্ট ভ্যান, শ্যালো ও ডিপ টিউবওয়েল, জেটপাম্প, এরেটর, ব্লোয়ার, পানির গুণাগুণ পরীক্ষার যন্ত্রপাতি, জেনারেটর ইত্যাদির জন্য আমদানী, উৎপাদন ও ব্যবসা পর্যায়ে কর এবং ভ্যাট অব্যাহতি | অর্থমন্ত্রণালয় এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় | বাজেটে ফসল খাতের জন্য ইউডার (নিড়ানি) ও উইনোয়ারের (ঝাড়াইকল) উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ের ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে থ্রেসার মেশিন, পাওয়ার রিপার, পাওয়ার টিলার, অপারেটেড সিডার, কম্বাইন হারভেস্টর, রোটারি টিলার, নিড়ানি ও ঝাড়াইকলের আমদানি পর্যায়ের আগাম কর অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। |
পাঙ্গাশ, তেলাপিয়া, সামুদ্রিক মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রপ্তানির জন্য জন্য প্রণোদনা এবং বিশেষ রি-ফাইন্যান্স স্কিম চালু করা | অর্থমন্ত্রণালয় এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, মৎস্য অধিদপ্তর, এন বি আর এবং বাংলাদেশ ব্যাংক | কর অবকাশ, বাংলাদেশ ব্যাংক এর ঋণ নীতিমালা সংশোধন |
মৎস্য উৎপাদন জোন (যথাঃ ময়মনসিংহ, বগুড়া, রাজশাহী, সাতক্ষীরা, নওগাঁ ইত্যাদি) ভিত্তিক ছোট ছোট মৎস্য সংরক্ষণাগার গড়ে তোলা | মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, বিএফডিসি | মৌসুমে মাছ ক্রয় করে স্টোর করে চাহিদা বাড়লে বিক্রি করা |
টুনা বা টুনা জাতীয় হাইলি মাইগ্রেটরি মাছ আহরণে উদ্যোক্তা সৃষ্টির লক্ষে প্রণোদনা ও করমুক্ত বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি | অর্থমন্ত্রণালয় এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, মৎস্য অধিদপ্তর, এন বি আর এবং বাংলাদেশ ব্যাংক | ১। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় একক ভাবে দীর্ঘ দিন চেস্টা করেও এ ক্ষেত্রে উদ্যোক্তা তৈরি করতে পারছে না
২। অর্থমন্ত্রণালয় এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এর সহায়তায় বাংলাদেশ ব্যাংক হতে একটি বিশেষ ফাইন্যান্স স্কিম চালু করা যেতে পারে ৩। মৎস্য আহরণের জনবলের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ও কারিগরি সহায়তা দিবে মৎস্য অধিদপ্তর ৪। কারিগরি সহায়তার জন্য এফএও এর সহায়তায় একটি টিসিপি গ্রহণ করা যায় (মৎস্য অধিদপ্তর-এফএও-প্রাইভেট সেক্টর) |
পুস্টিসমৃদ্ধ ছোট মাছের মিশ্র চাষ সম্প্রসারণে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ | মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, মৎস্য অধিদপ্তর | ওয়ার্ল্ডফিশ সহ বেসরকারি সংস্থা/সংগঠন বিশেষভাবে সহায়তা করতে পারে |
সাদা মাছ রপ্তানীর জন্য রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা গ্রহণ ও ট্রেসেবিলিটির জন্য ডাটাবেইজ তৈরি | মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, মৎস্য অধিদপ্তর | ১। প্রাথমিকভাবে রপ্তানী চেইনে যুক্ত হতে ইচ্ছুক বানিজ্যিক খামার গুলোকে রেজিস্ট্রেশনের আওতায় আনা, পর্যায়ক্রমে সম্প্রসারণ
২। ইতোপূর্বে প্রায় ৯ হাজার সাদা মাছ চাষিকে রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছিল। এটা আপডেট করা প্রয়োজন |
সাদা মাছ রপ্তানীর জন্য বাজার অনুসন্ধান ও সম্প্রসারণ | ইপিবি, বানিজ্য মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, মৎস্য অধিদপ্তর | বৈদেশিক মিশনে কর্মরত কমার্শিয়াল কাউন্সিলরগণকে বিশেষ প্রশিক্ষণ ও দায়িত্ব অর্পণ এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে |
মৎস্য চাষের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঋণ দেয়ার নীতিমালার পাশাপাশি ভ্যালু এডিশান এর জন্য (যথাঃ শুঁটকি, চ্যাপা, ফিস বল, ফিশ ফিঙ্গার, আঁচার, ফিস পাউডার এবং অন্যান্য রেডি টু কুক মৎস্যপণ্য) রেয়াতি হারে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ঋণ চালু (মসলা খাতের অনুরূপ ৪% হারে) | মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, ব্যাংকিং ডিভিশান, বাংলাদেশ ব্যাংক | কর অবকাশ, বাংলাদেশ ব্যাংক এর ঋণ নীতিমালা সংশোধন করে রি-ফাইন্যান্স স্কীম চালু করা যেতে পারে |
জেলেদের ভিজিএফ বিতরণের পাশাপাশি মা ইলিশ ধরা বন্ধ এবং সাগরে ৬৫ দিনের মাছ ধরা বন্ধকালীন প্রায় ৪ লক্ষ জেলের জন্য ক্যাশ ইনসেন্টিভ প্রদান | প্রধান মন্ত্রীর কার্যালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, ত্রাণ মন্ত্রণালয় | বর্তমানে ৪০ কেজি করে মাসে চাল দেয়া হচ্ছে |
স্বাদু পানির মাছ আমদানীতে কর বৃদ্ধি | অর্থমন্ত্রণালয়, এন বি আর | ১৫% ভ্যাট সহ সমপূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব |
ক্রপ হাইপোথেকিশন এর মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের মাছ চাষ সহ ছোট ছোট উদ্যোগে (যথাঃ শুঁটকি ও চ্যাপা তৈরি, কেটে পরিস্কার করে বিক্রির জন্য মৎস্য খাদ্যের জন্য ছোট পিলেট মেশিনের ব্যবহার ইত্যাদির জন্য) ঋণ প্রদান। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের জন্য কো-লেটারেল সিকিউরিটি প্রদানের ব্যবস্থা প্রত্যাহার। | মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, ব্যাংকিং ডিভিশান, বাংলাদেশ ব্যাংক | বাংলাদেশ ব্যাংক এর পল্লীঋণ নীতিমালা সংশোধন |
বড় মৎস্য চাষিদের ঋণ পুনঃতফসিলিকরণ এবং ঋণ-পরিধি বৃদ্ধি | ব্যাংকিং ডিভিশান, বাংলাদেশ ব্যাংক | বাংলাদেশ ব্যাংক এর পল্লী নীতিমালা সংশোধন |
মাছের কৃত্রিম প্রজননের উপাদান যথাঃ পিজি, এলএইচএ, অভাপ্রিম সহ বিভিন্ন হরমোন এর উপর আমদানী শুল্ক প্রত্যাহার | অর্থমন্ত্রণাল, এনবিআর | আমদানী ও করনীতিমালা সংশোধন |
গবেষণাঃ
ক। অপ্রচলিত মৎস্য চাষের প্রযুক্তি উন্নয়নে বিশেষ উদ্যোগ (যথাঃ কুঁচিয়া, মাসল, ওয়েস্টার, সী উইড ইত্যাদি) খ। মেরিকালচার (যথাঃ ভেটকি, কবিয়া ইত্যাদি) এর জন্য বিশেষ প্রায়োগিগ গবেষণা গ। হালদার জন্য বায়োলজিকেল গবেষণার পাশাপাশি, পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক গবেষণায় বিশেষ বরাদ্দ উদ্যোগ ঘ। অভ্যন্তরীণ মৎস্যবৈচিত্র রক্ষার (যথাঃ মৎস্য অভয়াশ্রম ও আবাসস্থল উন্নয়ন) এর সুফল সম্পর্কে গবেষণা। |
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, বিএফআরআই এবং সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় | বি এফ আর আই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যৌথভাবে গবেষণা করবে |