Thursday 25th of April 2024
Home / মৎস্য / নরম খোলসের কাঁকড়া চাষ: সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত

নরম খোলসের কাঁকড়া চাষ: সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত

Published at জানুয়ারি ৩০, ২০২০

নরম খোলসের কাঁকড়া

মোহাম্মদ রেদোয়ানুর রহমান : মৎস্য সেক্টরের ব্যাপক উন্নয়নের ফলে বাংলাদেশ বিশ্বে স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনে পঞ্চম স্থান চলে এসেছে। তবে অবহেলিত রয়ে গেছে সামুদ্রিক বিশাল জলরাশি। মৎস্য সেক্টরের উন্নয়নে সময় এসেছে সামুদ্রিক নীল-অর্থনীতির (Blue-Economy) দিকে গুরুত্ব দেওয়া। আর্ন্তজাতিক বাজারে চাহিদা সম্পন্ন মৎস্য এবং মাৎস্যজাত পণ্য যেমন: সামুদ্রিক উইড, কাঁকড়া, সবুজ ঝিনুক, স্কুইড ইত্যাদি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে। উন্নত দেশগুলোতে কাঁকড়ার চাহিদা বৃদ্ধির কারণে কাঁকড়া চাষের প্রতি চাষিরা আগ্রহী হচ্ছেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে কাঁকড়া চাষীরা আর্থসামাজিক উন্নয়নসহ দেশের অর্থনীতির উন্নতির ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখছেন। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী কাঁকড়া রপ্তানি করে বাংলাদেশ সরকার ২০১৪-২০১৫ অর্থ বছরে ৭.৬৫, ২০১৫-২০১৬ অর্থ বছরে ২৩.৮২, ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরে ৪৭.৯৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে। বাংলাদেশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জীবন্ত কাঁকড়া রপ্তানি করে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে, যার মধ্যে চীন, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালেয়শিয়া, জাপান, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলো অন্যতম।

বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা এবং লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে উপকূলীয় বিশাল অঞ্চলে কৃষি পণ্যের উৎপাদন দিন দিন কমে যাচ্ছে এবং গলদা ও বাগদা চিংড়ির ঘেরে পরিণত হচ্ছে। নরম খোলসের কাঁকড়ার উন্নত চাষ প্রযুক্তি সুদীর্ঘ ৭১১ কিলোমিটার উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যবহার করে বদলে দেয়া যেতে পারে লাখো মানুষের ভাগ্য। কাঁকড়া আর্থ্রাপোডা পর্বের ক্রাস্টাসিয়া প্রাণী। চলাফেরা ও খাবার গ্রহণের সুবিধার্থে কাঁকড়ার ১০টি পা রয়েছে। সবচেয়ে বড় সাঁড়াশির মতো পাগুলোকে চিলেপেড/চেলাযুক্ত পা বলা হয়। চিলেপেডের সাহায্যে কাঁকড়া আত্মরক্ষা করে এবং শিকার ধরে। এছাড়া মাটিতে চলাফেরার জন্য তিন জোড়া হাঁটার পা দিয়ে কাঁকড়া যে কোনকিছু আঁকড়ে ধরতে পারে এবং পিছনের পায়ের সাহায্যে কাঁকড়া সাঁতার কাটতে পারে।

কাঁকড়া চাষের ধাপসমূহ

পুকুর নির্বাচন প্রস্তুতকরণ : আধা নিবিড় পদ্ধতিতে নরম খোলসের কাঁকড়া চাষে পুকুরের আয়তন খুব বেশি প্রভাব না ফেললেও পানির গভীরতা অনেকাংশে প্রভাব রাখে। এজন্য পুকুরের আয়তন ০.৫-১.০ একর এবং পানির গভীরতা ৪-৫ ফুট হওয়া বাঞ্চনীয়। আধা লবণাক্ত পানি প্রবেশ করানো সম্ভব এমন স্থানে পুকুর নির্বাচন করে তলদেশ সমতল করতে হবে।

কাঠের ব্রিজ তৈরি: নরম খোলসের কাঁকড়া চাষের ক্ষেত্রে দৈনিক অর্থাৎ প্রতি ২৪ ঘন্টায় অন্তত ৬-৮ বার পর্যবেক্ষণ করতে হয়। কাঁকড়ার খাবার প্রয়োগ ও খোলস পরিবর্তনের অবস্থা সহজে পর্যবেক্ষণ করার জন্য পুকুরের মাঝে একটি শক্ত ও টেকসই কাঠের ব্রিজ তৈরি করতে হবে। ব্রিজের উপরে ছাউনি এবং নিচে নাইলনের সুতা টানানোর ব্যবস্থা রাখতে হবে, যেন তীব্র জোয়ার ও জলোচ্ছাসে ব্রীজ ভেঙে না যায় এবং বাক্সগুলো দূর্যোগময় পরিবেশে হারিয়ে না যায়।

ভাসমান কাঠামো বাক্স স্থাপন: বাক্স পানিতে ভেসে থাকার জন্য ভাসমান কাঠামো তৈরি করতে হবে। কাঠামো তৈরিতে ৫টি সমান দৈর্ঘ্যরে পিভিসি পাইপ পাশাপাশি নিয়ে কাঁকড়ার বাক্সের দৈর্ঘ্যের সমান দূরত্ব ফাঁকা রেখে বাঁশ দিয়ে বেঁধে দিতে হবে। কাঠামো পুকুরের দৈর্ঘ্যের অর্ধেক হলে ভালো।

কাঁকড়া চাষে ভাসমান কাঠামো।

কাঁকড়া সংগ্রহ পরিবহন: সারা বছর নরম খোলসের কাঁকড়া চাষ করা যায়। এজন্য প্রাকৃতিক উৎস থেকে ৫০-৬০ গ্রাম ওজনের কাঁকড়া সংগ্রহ করতে হবে। কেননা এই আকারের অপ্রাপ্ত বয়সের কাঁকড়া দ্রুত খোলস পরিবর্তন করে থাকে। প্রকৃতিগতভাবে কাঁকড়া খুবই আক্রমণাত্মক প্রাণী। তাই সংগৃহীত কাঁকড়া পরিবহনে মূলত ২টি বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে-

১. কাঁকড়ার চিলেপেড ২টি বাঁধা থাকতে হবে।

২. বাতাস থেকে কাঁকড়ার অক্সিজেন গ্রহণের ব্যবস্থা এবং আদ্র থাকার জন্য কাঁকড়ার শরীরে কাঁদা মাখতে হবে, এতে মৃত্যুহার অনেকাংশে কমে যায়।

কাঁকড়া মজুদ, খাদ্য প্রয়োগ এবং পুকুর ব্যবস্থাপনা: বর্তমানে ১টি বাক্সে ১টি কাঁকড়া রেখে বাণিজ্যিকভাবে নরম খোলসের কাঁকড়া চাষের ফলে ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু চিলেপেড ফেলে দিয়ে নরম খোলসের কাঁকড়া চাষে একই বাক্সে একের অধিক কাঁকড়া মজুদ করা সম্ভব। কাঁকড়া চাষে খাদ্য হিসেবে উচ্ছিষ্ট মাছ সর্বোত্তম। কাঁকড়ার ওজনের ৫-১০% হারে প্রতি দুইদিন অন্তর অন্তর খাদ্য সরবারহ করতে হবে। নরম খোলসের কাঁকড়া চাষের জন্য পানির লবণাক্ত ১৫-১৮ পিপিটি, পি.এইচ ৬.৫-৮.০ এবং ক্ষারত্ব ৮০’র উপরে থাকা বাঞ্ছনীয়। ক্ষারত্ব কমে গেলে দ্রুত পানি পরিবর্তন অথবা চুন প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়া প্রতি মাসে একবার প্রোবায়োটিক ব্যবহার করা উত্তম। এজন্য পুকুরের পানির গুণাগুণ নিয়মিত পর্যাবেক্ষণ করতে হবে।

পর্যবেক্ষণ সংরক্ষণ: নরম খোলসের কাঁকড়া চাষে প্রতি ৩ ঘণ্টা অন্তর অন্তর দিনে রাতে পর্যবেক্ষণ করে নরম এবং মৃত কাঁকড়াগুলোকে দ্রুত তুলে ফেলতে হবে। নরম কাঁকড়া চেনার সহজ উপায় হচ্ছে বাক্সে পরিত্যক্ত খোলসের কারণে মজুদকৃত কাঁকড়ার চেয়ে বেশীসংখ্যক কাঁকড়া দেখা যাবে। নরম খোলসের কাঁকড়া ৩-৪ ঘন্টা আধা লবণাক্ত (১৫-২০ পিপিটি) পানিতে থাকলে খোলস পুনরায় শক্ত হয়ে যায়। এজন্য নরম খোলসের কাঁকড়া চাষে আহরণের পূর্বে খোলস পরিবর্তনের পর খোলস শক্ত না হওয়ার জন্য দ্রুত লবণ পানি থেকে তুলে মিঠা পানিতে কয়েক ঘন্টা সংরক্ষণ করতে হবে। সংগৃহীত নরম খোলসযুক্ত কাঁকড়াকে আর্দ্র রাখার জন্য ট্রেতে সাজিয়ে রেখে ভেজা তোয়ালে দিয়ে ঢেকে দিতে হবে এবং যথাসম্ভব দ্রুত সংগৃহীত নরম খোলসযুক্ত কাঁকড়াগুলোকে প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় পাঠাতে হবে।

কাঁকড়ার পুকুরে মাছ চাষ: কাঁকড়া চাষে পুকুরের পানির উপরি স্তর ব্যবহৃত হয়। ফলে অব্যবহৃত থাকে পানির নিচের স্তর। পুকুরের পানির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য কাঁকড়ার পাশাপাশি লবণাক্ততা সহ্যক্ষম ভেটকি ও তেলাপিয়া মাছ চাষ করলে পানির গুণাগুণ ঠিক থাকে। ভেটকি মাংশাসী প্রজাতির হওয়ায় কাঁকড়ার জন্য ব্যবহৃত উচ্ছিষ্ট মাছের উদ্বৃত্ত্ অংশ, মৃত কাঁকড়া ভেটকি মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং তেলাপিয়া মাছ পুকুরের জৈবিক??? নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।

বাংলাদেশে ‘কাঁকড়া চাষ’ এখন বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী চিংড়ির পরেই অন্যতম প্রধান খাত। স্বল্প পরিসরে বিজ্ঞানসম্মতভাবে কাঁকড়া চাষবাদ দারিদ্র বিমোচনের ক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা পালন করতে পারে। উপকূলীয় অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে খাঁচায় কাঁকড়া চাষ পদ্ধতি বেশ জনপ্রিয়। বিশ্ববাজারে কাঁকড়ার চাহিদা বৃদ্ধি, অধিকফলন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি, প্রতিকূল পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতা এবং সহজ চাষপদ্ধতির কারণে বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলের চিংড়ি চাষীরা কাঁকড়া চাষের প্রতি ঝুঁকছেন। সম্ভাবনাময় এই খাত থেকে আরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য এখন প্রয়োজন দ্রুত হ্যাচারিতে কাঁকড়ার বাণিজ্যিক পোনা উৎপাদন, বানানো খাদ্যে অভ্যস্তকরণ এবং অধিক ঘনত্বে চাষের উপায় বের করার জন্য ব্যাপক গবেষণা।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়।

This post has already been read 4094 times!