Thursday 25th of April 2024
Home / পোলট্রি / সোনালী মুরগি পালনের কলাকৌশল

সোনালী মুরগি পালনের কলাকৌশল

Published at নভেম্বর ১২, ২০১৯

মো. মহির উদ্দীন, কৃষিবিদ : সোনালী মুরগি ডিম এবং মাংস উৎপাদন এ দুই উদ্দেশ্যেই পালন করা যায়। তবে ডিমের চেয়ে ককরেল উৎপাদনের জন্য বেশি পালন করা হয়। আমাদের দেশে সাধারনত দুই মাস বয়স পর্যন্ত পালন করে বাজারজাত করা হয়। ২ মাস বয়সে ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ওজন হয়। বাজারে এই বয়স এবং ওজনের সোনালী মুরগির বেশ চাহিদা রয়েছে। তবে যে উদ্দেশ্যেই পালন করা হোক না কেন সোনালীর মুরগির প্রাথমিক পরিচর্যা একই রকমের। একজন নুতন খামারির জন্য এই প্রাথমিক পরিচর্যার বিষয়গুলো জানা দরকার। এই বিষয়গুলো হলো-

ব্রুডিং : সদ্য ফোটা মুরগির বাচ্চার শরীরের তাপমাত্রা বেশি থাকে তাই পরিবেশের তাপমাত্রার সাথে মুরগির শরীরের তাপমাত্রাকে সমন্বয় করতে হলে মুরগির শরীরের তাপমাত্রা পরিবেশের তাপমাত্রার সমান থাকতে হয়। এ কারণে মুরগির বাচ্চাকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ঋতুভেদে ২-৪ সপ্তাহ কৃত্রিমভাবে তাপ দিতে হয়। কৃত্রিম উপায়ে এই তাপ দেয়াকে বলা হয় ব্রুডিং। ব্রুডিং এর উদ্দেশ্য হলো মুরগির বাচ্চার জন্য আরামদায়ক ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করা।

ব্রুডিং এর সময় কাক্সিক্ষত পরিবেশগত অবস্থা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে দৈহিক বৃদ্ধি, খাদ্য রুপান্তর হার কমে যাবে এবং রোগবালাই ও মৃত্যুহার বেড়ে যাবে। ফলে খামারের লাভ কমে যাবে। খামারে পালিত সব জাতের মুরগির জাতের মুরগির ব্রুডিং ব্যবস্থাপনা প্রায় একই রকম।

লিটার : মুরগির ব্রুডি পিরিয়ডটা সর্বদায় লিটারে পালন করা হয়। এক্ষেত্রে বাচ্চা শেডে আসার আগেই লিটার সামগ্রি বিছিয়ে শেড প্রস্তত করতে হবে। শুকনা, পরিষ্কার লিটার সামগ্রি ২-৪ ইঞ্চি পুরু করে মেঝেতে বিছাতে হবে। লিটার সামগ্রি কোন ধরনের পেস্টিসাইড, মোল্ড, ফানজাই দ্বারা কলুষিত কি না তা দেখে ব্যবহার করতে হবে। পেস্টিসাইড লিভার এবং কিডনিকে নস্ট করে দেয় এবং মাসল এবং চর্বিতে জমা হয়। ছত্রাক বায়ুতে স্পোর অবমুক্ত করে এবং মুরগির বাচ্চা যখন এটি নিঃশ্বাসের সাথে গ্রহণ করে তখন রোগাক্রান্ত হয়, বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং মারা যায়। কোনো কারণে লিটার ভিজে গেলে বা অন্য কোনো কারণে নষ্ট হলে দ্রুত শুকনা লিটার প্রতিস্থাপন করতে হবে। লিটার হিসেবে আমাদের দেশে সর্বাধিক ব্যবহৃত হয় ধানের তুষ ও কাঠের গুঁড়া। আবার কেউ কেউ ধানের তুষ এবং কাঠের গুঁড়া মিশিযে ব্যবহার করেন। লিটার মুরগির পায়খানার আর্দ্রতা শোষণ করে ক্ষতিকর জীবাণুর বিস্তার রোধ করে। এছাড়া মুরগির আরামদায়ক অবস্থা তৈরি করে এবং অত্যধিক শীতের সময় উষ্ণতা প্রদান করে। ব্রুডিং পিরিয়ড শেষে মুরগি খাঁচা, মাচা এবং লিটার বা মেঝে যে কোনো পদ্ধতিতে পালন করা যায়।

মুরগির ঘনত্ব : ব্রুডার হাউজে মুরগির ঘনত্ব কত হবে তা মুরগির জাত, কোন উদ্দেশ্যে পালন করা হবে, স্থানীয় অবস্থা, ঘরের ধরন ব্যবহৃত সরঞ্জামাদি ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে। মুরগির ঘনত্ব বেশি হলে ভবিষ্যতে মুরগি তার বায়োলজিক্যাল পারফরমেন্স কাক্সিক্ষত মাত্রায় ংযড়ি করতে পারেনা। প্রথম ৩দিন ৫০টি বাচ্চার জন্য এক বর্গমিটার জায়গা দরকার হয়। বয়স ৪ দিন পর হতে আস্তে আস্তে জায়গা বাড়াতে হবে এবং ১৪ দিন বয়সের পর চিকগার্ড উঠিয়ে দিয়ে জায়গা বাড়িয়ে দিতে হবে। মেঝে বা ফ্লোরে পালনের ক্ষেত্রে একটি পূর্ণবয়স্ক ডিমপাড়া সোনালী মুরগির জন্য ২ বর্গফুট এবং ককরেল হিসেবে পালন করলে প্রতিটি মুরগির জন্য ১ বর্গফুট জায়গা দরকার হবে।

পানি : পানি একটি অপরিহার্য পুষ্টি উপাদান। পানি ছাড়া জীবন চলেনা। মুরগির বাচ্চাকে পর্যাপ্ত পরিমাণ পরিষ্কার, সতেজ এবং বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হবে। স্বাভাবিক অবস্থায় একটা মুরগির বাচ্চা যে পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করবে তার দ্বিগুণ পানি পান করবে। মুরগির বাচ্চা যদি কম পরিমাণ পানি গ্রহণ করে বা যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি সরবরাহ না করা হয় তাহলে পানিশূন্যতায় ভুগবে এর ফলে সমরূপ দৈহিক বৃদ্ধি হবে না এবং মৃত্যুহার বাড়বে। ব্রুডিং পিরিয়ডে অতিরিক্ত পানি পাত্র প্রদান করতে হবে। প্রথম ৩-৭ দিন বয়সে ৪ লিটার পানি ধরে এমন একটি পাত্র ১০০ বাচ্চার জন্য প্রদান করতে হবে। প্রথম ২৪ ঘণ্টা বয়সে পানির পাত্র এমনভাবে বসাতে হবে যাতে মুরগির বাচ্চাকে পানি পেতে ১ মিটারের বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে না হয়। কোনো অবস্থাতেই খুব ঠা-া বা গরম পানি প্রদান করা যাবে না। সরবরাহকৃত পানির তাপমাত্রা হবে কক্ষ তাপমাত্রার সমান মুরগির ক্ষেত্রে খাদ্যের আগে পানি অর্থাৎ শেডে মুরগির বাচ্চা প্রবেশের আগেই পানি প্রদান করতে হবে। পানির পাত্র প্রতিবার পানি প্রদানের আগে ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে।

খাদ্য : বাচ্চার বয়স ৫-৭ দিন পর্যন্ত স্টার্টার ফিড দিতে হবে। প্রতিটি ফিড ট্রে তে ১০০ বাচ্চা খেতে পারে এমন ট্রে সরবরাহ করা উচিত। তবে স্থানীয়ভাবে যে ধরনের ট্রে পাওয়া যায় সেটা ব্যবহার করাই যুক্তিযুক্ত। ব্রুডিং পিরিয়ডে প্রথম ৩ দিন পুরো লিটারের ওপর কাগজ বিছিয়ে তার ওপর খাবার ছড়িয়ে দিতে হবে। এর ফলে জীবনের প্রথম থেকে মুরগির বাচ্চার লিটার সামগ্রি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে উঠবে না এবং পেপারের ওপর খাবার ছিটিয়ে দেওয়ার ফলে মুরগির বাচ্চা সহজেই খাবার খুঁজে পায় ফলে জীবনের শুরুতেই খাবার সংগ্রহের প্রতিযোগিতায় নামতে হয় না। একবারে বেশি পরিমাণ খাদ্য সরবারহ না করে বারবার অল্প অল্প করে খাদ্য সরবরাহ করলে খাদ্য গ্রহণে উদ্দীপ্ত হয়। শেডে বাচ্চা আসার পর যত দ্রুত সম্ভব খাদ্য সরবরাহ করা উচিত। ৩ দিন পর হতে পাত্রে খাদ্য প্রদান শুরু করতে হবে। প্রথম সপ্তাহে একটি সোনালী মুরগির বাচ্চা সাধারণত ০৯ গ্রাম খাদ্য খায় এবং প্রতিসপ্তাহে গড়ে ৪-৬ গ্রাম করে বৃদ্ধি পায়। একটি পূর্ণবয়স্ক প্রতিদিন ১০৪ করে গ্রাম খাদ্য খাবে। ককরেল বা ০২ মাস বয়স পর্যন্ত বাড়ন্ত অবস্থায় বিক্রয় করলে সোনালী মুরগির জন্য প্রথম দুই সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত ব্রয়লার স্টার্টার এবং বাকি সময় স্টার্টার + গ্রোয়ার খাদ্য প্রদান করলে ককরেলের দৈহিক বৃদ্ধি ভালো হয়।

টিকা প্রদান ও রোগ দমন : সোনালী মুরগি হলো আমাদের দেশের আবহাওয়ায় সর্বোৎকৃষ্ট অভিযোজনশীল মুরগি। তাই এই মুরগির খুবই রোগ সহনশীল অর্থাৎ রোগবালাই কম হয়। যদি ডিম উৎপাদনের জন্য পালন করা হয় তাহলে টিকা প্রদান কর্মসূচি ভিন্ন হবে এবং সিডিউল মোতাবেক টিকা করতে হবে। যদি ককরেল উৎপাদনের জন্য পালন করা হয় তাহলে প্রথম সপ্তাহে বিসিআরডিভি চোখে ড্রপ দিতে হবে এরপর ১০-১৪ দিন বয়সে গামাবোরো ১ম ডোজ এবং প্রথম ডোজের ৭ দিন পর ২য় ডোজ দিতে হবে এরপর ২১ দিন বয়সে আবার বিসিআরডিভি বুস্টার ডোজ দিতে হবে এবং দুই মাস বয়সে রানের মাংসে আরডিভি দিতে হবে।

লেখক: উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা, চাটমোহর, পাবনা।

This post has already been read 56669 times!