Friday 29th of March 2024
Home / অন্যান্য / পাল্টে যাচ্ছে  খুলনার প্রত্যন্ত জনপথ দাকোপ উপজেলার মানচিত্র

পাল্টে যাচ্ছে  খুলনার প্রত্যন্ত জনপথ দাকোপ উপজেলার মানচিত্র

Published at সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৮

ফকির শহিদুল ইসলাম (খুলনা): অব্যাহত নদী ভাঙ্গনের ফলে পাল্টে যাচ্ছে  খুলনা জেলার প্রত্যন্ত জনপথ দাকোপ উপজেলার মানচিত্র । আর এ নদী ভাঙ্গনের সাথে ভেসে গেছে হাজার হাজার বিঘা ফসলী জমি, মৎস্য ঘের, সাথে বিলীন হয়েছে শত বছরের পর বছর বসবাসের বসতভিটা। ফলে সহায় সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে হাজারও পরিবার। দাকোপ উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা এখন নদী গর্ভে বিলীন।

সুন্দরবন সংলগ্ন প্রবহমান স্রোতোস্বিনী শিবসা ও পশুরসহ সাতটি নদী গিলে খাচ্ছে উপজেলার নদীসংলগ্ন এলাকা ও গ্রামগুলো। প্রতিদিনেই ভাঙছে কোনো না কোনো এলাকা। ভাঙ্গনে আবাদযোগ্য জমি, বাজার, কাঁচা-পাকা ঘর ও গাছপালা নদীতে বিলীন হচ্ছে। ভেড়িবাঁধ ভেঙ্গে ক্ষেতের ফসল ও ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়ে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ওয়াপদার রাস্তা নির্মাণ কাজ চললেও সে কাজ খুবই ধীরগতিতে এগোচ্ছে। এলাকাবাসি দীর্ঘদিন যাবত নদী ভাঙ্গনের এই দুর্ভোগ-দুর্যোগ প্রতিরোধে উঁচু টেকসই বিকল্প বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না ।

জেলার প্রত্যন্ত জনপথে দাকোপ উপজেলাটি একটি পৌরসভা ও নয়টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত । যা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ৩১, ৩২ ও ৩৩ নম্বর পোল্ডারের আওতায় তিনটি দ্বীপ নিয়ে গঠিত পললভূমি। মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততার বিরূপ প্রভাব থেকে সম্পদ ও জনগণকে রক্ষার উদ্দেশ্যে ষাটের দশকে পোল্ডারগুলোর নদীর তীরে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়। কিন্তু প্রয়োজনীয় সংস্কার ও মেরামতের অভাবে, যত্রতত্র স্লুইজগেট নির্মাণ ও বাঁধ কেটে চিংড়ি ঘেরে পানি উত্তোলন করায় বাঁধগুলোর নানা স্থান ভেঙ্গে নদীতে বিলীন হয়েছিল। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয় ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডর ও ২০০৯ সালে আইলা’র আঘাতে। তখন বেড়িবাঁধের বিভিন্ন স্থান ভেঙ্গে প্রায় এ এলাকাটি প্লাবিত হয়। ক্ষত-বিক্ষত হয় গোটা উপজেলা। তখনকার সেই ক্ষতি ৯ বছর পরেও কাটিয়ে উঠতে পারেননি এলাকাবাসি। গৃহহীন প্রায় ৪শ’র বেশি পরিবার এখনও বেড়িবাঁধ ও রাস্তার উপর বসবাস করছে।

এলাকাবাসির ভাষ্যমতে, আইলার পূর্বে যে স্থানটিতে বাঁধ ছিলো তা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ায় অনেকটা ভেতরের দিকে এসে রিংবাঁধ দেওয়া হয়েছে। নদী ভাঙ্গন ও বাঁধ ভেঙ্গে বিলীন হয়েছে আবাদযোগ্য জমি, হাট-বাজার, বাড়িঘর। অনেকটা ভেতরের দিকে এসে রিংবাঁধ দেওয়াতে প্রচুর জমি নদীতে চলে গেছে এবং যাচ্ছে। এভাবে শিবসা, পশুর, ঢাকি, ভদ্রা, মাঙ্গা, ঝপঝপিয়া ও চুনকুড়ি নদী গিলে খাচ্ছে উপজেলার নদীসংলগ্ন এলাকা ও গ্রামগুলোকে।

তারা আরও জানায়, এ অঞ্চালের বেড়িবাঁধসমূহ বহুকাল ধরে এলাকাবাসীর চলাচলের রাস্তা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। পশুর ও শিবসা নদীর ভাঙ্গনে বাঁধ বা রাস্তার পার্শ্ববর্তী স্থানে গড়ে ওঠা দোকান ও বসতঘর এবং বিপুল পরিমাণ আবাদী জমি নিশ্চিহ্ন হয়েছে। উন্নয়নের মহাসড়কে আ’লীগ সরকারের দুই মেয়াদ পূর্ণ হতে চললেও তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি অব্যাহত নদী ভাঙ্গনের স্বীকার এ এলাকার। এলাকার জনপ্রতিনিধিদের সাথে আলাপকরে জানা যায়, উপজেলার ৩১ নম্বর পোল্ডার চালনা পৌরসভা, পানখালী ইউনিয়ন, তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের বটবুনিয়া এলাকার প্রায় ২ শত বিঘা জমি ঢাকি নদীতে এবং ঝালবুনিয়া এলাকার প্রায় ৩ শত বিঘা জমি শিবসা নদীতে বিলীন হয়েছে।

৩২ নম্বর পোল্ডারের সুতারখালী ও কামারখোলা ইউনিয়ন মিলে একটি দ্বীপ। এর চারদিক ঘিরে রয়েছে শিবসা, ভদ্রা ও ঢাকি নদী। এটি উপকূলীয় এলাকার সবচেয়ে দক্ষিণের জনবসতির একটি। এর দক্ষিণে রয়েছে সুন্দরবন। এটি বাংলাদেশের একটি দুর্গম এলাকা হিসেবেও পরিচিত। উপজেলা সদরের সঙ্গে এই এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা বরাবরই নাজুক। নদী ভাঙ্গনে দুর্যোগ-দুর্ভোগের শিকার হয়ে প্রকৃতির সাথে এক প্রকার যুদ্ধ করেই এখানে অর্ধলক্ষাধিক মানুষের বসবাস। সুতারখালী ইউনিয়নের তেলিখালি, কালাবগী বাজার, ডা. শশি কুমারের বাড়ির সামনে, কালাবগী বাজার থেকে পন্ডিতচন্দ্র প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত ও গোনারী কালীবাড়ি এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকার বেড়িবাঁধে ব্যাপক আকারে ফাটল ও ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। সস্প্রতি নলিয়ান কালাবগী এলাকার জরাজীর্ণ বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ভাঙ্গন কবলিত স্থান এখনও সঠিতভাবে মেরামত করা হয়নি।

৩৩ নং পোল্ডারের আওতায় রয়েছে কৈলাশগঞ্জ, বাজুয়া, লাউডোব, দাকোপ ও বানিশান্তা ইউনিয়ন। এই পোল্ডারের পূর্ব ঢ্যাংমারী, ভোজনখালী, আমতলা, বাজুয়া, চুনকুড়ি, পোদ্দারগঞ্জ, কৈলাশগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে ছোট-বড় অসংখ্য ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়েছে। তবে বানিশান্তার পতিতা পল্লী থেকে আমতলা পুলিশ ফাঁড়ি পর্যন্ত মারাত্মক ভাঙন দেখা গেছে। নদীভাঙ্গনের ফলে কৃষক হারাচ্ছে ফসলী জমি। এমন মরার উপর খাঁড়ার ঘাঁ সহ্য করতে না পেরে এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দারা।

সুতারখালি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাসুম আলী ফকির বলেন, আমার এলাকা সর্বত্রই নদী ভাঙন অব্যাহত। পাউবো’র গাফিলতি এবং চায়না ঠিকাদারের বেড়িবাঁধ সংস্কার কাজের দীর্ঘসুত্রিতায় ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে এলাকার। যে স্থানে নির্মাণ কাজটি আগে করার প্রয়োজন সেখানে কোনোভাবেই কাজ করছে না প্রকল্পটি। তিনি অভিযোগ করে বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ঠিকমতো দেখাশোনা করে না। সংস্কার কাজ দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য পাউবোর তদারকি চোখে দেখছে না। বারবার অভিযোগ করার সত্ত্বেও কোনো উপকার পাওয়া যাচ্ছে না।

তিলডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রনজিৎ কুমার মন্ডল মুঠোফোনে বলেন, ইউনিয়নের ২৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের ১৬ কিলোমিটার খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। সম্প্রতি কামিনীবাসিয়া গ্রামে নদী ভাঙনে বিলীন হয়েছে ৩৬টি পরিবার। ক্ষতিগ্রস্থ মানুষগুলো মানবেতর জীবনযাপন করছে। তিনি আরও বলেন, বর্ষামৌসুমে নদীতে যেভাবে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে আগামী গোনমুখে (ভরাটকাল) আমার ইউনিয়নের মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো ভেঙে প্লাবিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন বলেন, অতিরিক্ত নদী শাসনের কারণে এমন ভয়াবহ ভাঙ্গনের রূপ দেখা দিয়েছে। ভাঙ্গন কবলীত একালার সমস্ত তথ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তাছাড়া এসব এলাকা এখন বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বেড়িবাঁধ সংস্কারের কাজ চলছে। যা চায়না ঠিকাদারের মাধ্যমে কাজটি করা হচ্ছে। এটি এখন পাউবো’র আওতাবহির্ভূত। বিষয়টি নিয়ে গেলো দু’দিন ধরে খুলনা-১ আসনের সাংসদ পঞ্চানন বিশ্বাসের মুঠোফোনে কথা বলার জন্য একাধিকবার চেষ্টা করলেও কোন মন্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।

This post has already been read 1994 times!