Friday 29th of March 2024
Home / পোলট্রি / জলবায়ুর পরিবর্তন ও পোলট্রি শিল্পের চ্যালেঞ্জ

জলবায়ুর পরিবর্তন ও পোলট্রি শিল্পের চ্যালেঞ্জ

Published at আগস্ট ২৬, ২০১৮

মো. খোরশেদ আলম জুয়েল : জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বব্যাপী বর্তমান সময়ের আলোচিত বিষয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল ভোগকারী দেশগুলোর তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করছে বাংলাদেশের নাম। বিশেষজ্ঞগণের মতে জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় ধাক্কা সামলাতে হবে বাংলাদেশকে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ছে কৃষি সেক্টরে। শস্যজাতীয় ফসল, মাছ ও মুরগি উৎপাদনে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে। তবে কৃষির এ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শাখার মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত ও সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে পোলট্রি শিল্প ইতোমধ্যে নিজেদের একটি স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করে নিতে সক্ষম হেেছ। প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ও অর্ধ কোটি লোকের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থানের শিল্পটির উদ্যোক্তারা স্বপ্ন দেখছেন সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ২০৫০ সন নাগাদ এই শিল্পের বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের পরিমাণ বর্তমানের দ্বিগুণ হবে। আয়তনের দিক দিয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে ছোট্ট একটি দেশ হলেও বাজার চাহিদা বিবেচনায় বিশাল বাজারের একটি দেশ। কৃষি সেক্টরে আমাদের যেমন অর্জন আছে ঠিক তেমনি এ অর্জনকে ধরে রাখতে ও টেকসই রূপ দিতে সামনের দিনগুলোতে আমাদের আরো অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে; মোকাবেলা করতে হবে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক নানা চ্যালেঞ্জের বাইরেও পরিবেশ ও জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত চ্যালেঞ্জ। গতানুগতিক চিন্তা ধারার বাইরে পোলট্রি শিল্পে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব, মোকাবেলা, করণীয় সম্পর্কে আমরা কতটুকু দৃষ্টি দিয়েছি।

এ কথা অনস্বীকার্য যে কৃষির সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ও লাভজনক একটি উপখাতের নাম পোলট্রি শিল্প। তবে তার সাথে এ কথাও বাস্তব সত্য যে, কৃষির অন্য যেকোন শাখার চেয়ে এ সেক্টরে ঝুঁকির পরিমাণও বেশি। এ ঝুঁকি যতটা না কৃত্রিম তারচেয়ে বেশি প্রাকৃতিক। সামান্য একটু অসতর্কতা ও অবহেলার কারণে ঘটে যেতে পারে বিশাল বিপর্যয়। পোলট্রি শিল্প যেহেতু অত্যন্ত সংবেদনশীল তাই পরিবর্তিত জলবায়ুতে এর ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে এটিই স্বাভাবিক। সুতরাং এ ব্যাপারে অবহেলার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। কারণ পৃথিবীতে ক্রমাগত বাড়ছে গ্রীন হাউস গ্যাসের প্রভাব। উত্তপ্ত হচ্ছে বায়ুম-ল, ঋতু বৈচিত্র্যে ঘটছে ব্যাঘাত, বাড়ছে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা। চিরচেনা পরিচিত আবহাওয়া যেন হঠাৎ করেই বৈরি হয়ে উঠছে। মাঝে মাঝে অপরিচিত মনে হয় নিজের দেখা প্রকৃতিকে। কেন হচ্ছে এমন পরিবর্তন; মাঝেমধ্যেই বেসামাল আচরণ? জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রকৃতির এমন বৈরি আচরণ আসলে গ্রীন হাউস গ্যাসের প্রভাবেই। তবে আসুন আগে জেনে নিই গ্রীন হাউস গ্যাস কী?

গ্রীন হাউস গ্যাস কী?
কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস-অক্সাইড, ওজোন ও জলীয় বাষ্প এসব বায়বীয় পদার্থগুলোকে গ্রীন হাউস গ্যাস বলা হয়। এ গ্যাসগুলোকে গ্রীন হাউস গ্যাস নামে ডাকার একটি কারণও আছে। সাধারণত শীত প্রধান যেখানে প্রয়োজনীয় তাপের অভাব সে অঞ্চলগুলোতে স্বচ্ছ কাঁচ দিয়ে এক ধরনের ঘর বানানো হয় যার ভেতরে বিভিন্ন ধরনের সবজি ও ফুলের চাষ করা হয়। সূর্যের তাপ যখন স্বচ্ছ কাঁচের ভেতর দিয়ে এসব ঘরের ভেতর ঢুকে সেটি আর বের হতে পারেনা। এই তাপমাত্রাকে তখন চাহিদা অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করে সেখানে ফসল ফলানো হয়। সমগ্র পৃথিবীটাও এক ধরনের কাঁচের ঘর। এ ঘরে ব্যবহৃত কাঁচের নাম হচ্ছে বায়ুমণ্ডল। উল্লেখিত গ্যাসগুলো বায়ুম-ল ভেদ করে পৃথিবী নামক কাঁচের ঘর থেকেও বের হতে পারেনা। তবে বায়ুম-ল প্রতিনিয়ত যে ছিদ্র হচ্ছে সেটির ভেতর দিয়ে কিন্তু সূর্যের আলট্রা ভায়োলেট রশ্মি ঠিকই প্রবেশ করছে। পৃথিবীতে সূর্যের কাছ থেকে শুধু আলো-ই আসেনা সেই সাথে আসে তাপ (ইনফ্রারেড ফ্রিকোয়েন্সিতে) যা কিনা পৃথিবীর গায়ে প্রতিফলিত হয়। পৃথিবীর সব বস্তু যেখানে এই সূর্যের আলো এবং ইনফ্রারেড পড়ে, সে জায়গাগুলো আলো থেকে তাপ শোষণ করে এবং তার তাপমাত্রা বেড়ে যায়। সমস্যা হলো এই তাপমাত্রা উল্লেখিত ছয়টি গ্যাসের কারণে বায়ুমণ্ডলের ভেতরে আটকে থাকে এবং পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়তে থাকে।

সোজা কথা, পৃথিবী হচ্ছে এ গ্যাসগুলোর জন্য একটি আবদ্ধ কাঁচের ঘর যেখানে প্রবেশ করা যায় কিন্তু বের হওয়া যায় না। পার্থক্য হলো, কাঁচের ঘড়ের ভেতর তাপমাত্রা ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণ করা যায় কিন্তু পৃথিবী নামক বিশাল ঘরের জন্য সেটি প্রায় অসম্ভব। কাঁচের ঘড়ের ভেতর গ্রীন হাউজ গ্যাস যেমন দরকার তেমনি পৃথিবীর জন্যও তা দরকার তবে সেটি নির্দিষ্ট পর্যায়ের। কিন্তু বায়ুম-লের ক্রমাগত কার্বন ডাই অক্সাইড ও নাইট্রাস অক্সাইড গ্যাস বৃদ্ধির কারণে সেটি দিনকে দিন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। ফলে বাড়ছে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, সুনামি, সাইক্লোন, অতিবৃষ্টি, খরা, বন্যা ইত্যাদি নানা রকমের দুর্যোগ।

গ্রীন হাউস গ্যাস ও পোলট্রি শিল্প
অন্যান্য ভারী শিল্পের তুলনায় পোলট্রি শিল্প থেকে গ্রীন হাউস নির্গমনের পরিমাণ তুলনামূলক অনেক কম। তবে গ্রীন হাউস গ্যাসের কারণে কৃষির অন্যতম এ খাতটিতে ঝুঁকির পরিমাণ তুলনামূলক বেশি। আর বাংলাদেশ যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের কুপ্রভাবের শীর্ষে থাকা দেশ সেখানে ঝুঁকিটা আরো বেশি। গ্রীন হাউস গ্যাসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর কার্বন ডাই অক্সাইড উৎপন্ন হয় জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে। সাধারণত খামার বা হ্যাচারির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, গাড়ি ইত্যাদি থেকে এসব হয়। পোলট্রি লিটার ও অন্যান্য আবর্জনা থেকে উৎপন্ন হয় নাইট্রাস অক্সাইড (N2O) ও মিথেন (CH4) গ্যাস। তবে এই নাইট্রাস অক্সাইড ও মিথেন গ্যাস নির্গতের পরিমাণ অনেকটা নির্ভর করে পোলট্রি ফার্মগুলোর আবর্জনা এবং লিটার ব্যবস্থাপনার ওপর। যেসব পোলট্রি ফার্মের এসব ব্যবস্থাপনা যত ভালো তাদের থেকে এসব গ্যাস নির্গত হওয়ার পরিমাণও তত কম। এখানে একটি আশাপ্রদ দিক হলো, ইতোমধ্যে দেশের বড় বড় বেশ কয়েকটি পোলট্রি কোম্পানি তাদের খামারের পোলট্রি লিটার ও আবর্জনা সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে একদিকে যেমন নিজেদের বিদ্যুৎ উৎপন্ন করছেন অন্যদিকে গ্রীন হাউস গ্যাস নির্গমনের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রেখে পরিবেশগত উন্নয়নে অবদান রাখছে। উল্লেখ্য, প্রাণিজ কৃষির মধ্যে পোলট্রি থেকে সবচেয়ে কম পরিমাণ মিথেন গ্যাস নির্গত হয় যার পরিমাণ বার্ষিক ০.২৬ কেজি/মুরগি। অন্যদিকে গরুর ক্ষেত্রে নির্গমনের পরিমাণ ৮৪-১২৩ কেজি/গরু। যুক্তরাষ্ট্রের ইপিএ (Environmental Protection Agency) রিপোর্ট অনুযায়ী প্রাণিজ কৃষির মোট ৯% নাইট্রোজেন গ্যাস নির্গত হয় পোলট্রি থেকে।

সস্তায় মানসম্মত প্রোটিন উৎপাদনের সবচেয়ে উত্তম উৎস হচ্ছে পোলট্রি। এটি একদিকে যেমন মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণে অনন্য ভূমিকা পালন করে তেমনি খামারিদের স্বচ্ছল জীবনযাপন, আর্থিক ও সামাজিক ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের নারীর ক্ষমতায়নে শিল্পটি অনবদ্য ভূমিকা পালন করছে। কৃষিখাতের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশটি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবের ফলে পোলট্রি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণের প্রাপ্যতা সমস্যা, ফিডের পুষ্টিগত গুণাগুণের তারতম্য, রোগবালাই বৃদ্ধি ও বিস্তার, পানির দুষ্প্রাপ্যতা এবং মুরগির টিকে থাকাকে কঠিন করে তুলতে পারে (Spore, 2008)। জলবায়ুর ক্রমাগত পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে আর্দ্রতা কমে যায় যেটি নানা ধরনের ব্যাকটেরিয়াল ও ফাংগাল রোগ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। ককসিডিওসিস, হেমোরেজিক সিনড্রোম, ফাউলপক্স, ব্রংকাইটিস এর মতো মুরগির রোগগুলোর প্রাদুর্ভাব অনিবার্য হয়ে পড়ে এমন পরিবেশে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য মুরগি খাদ্য গ্রহণ মাত্রা কমে যায়। ফলে সঠিক সময়ে কাক্সিক্ষত বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং মুরগির মৃত্যুহারও বেড়ে যায়; যার সরাসরি প্রভাব পড়ে খামারিদের ওপর। কারণ তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে মুরগি বেশি করে পানি পান করে পক্ষান্তরে খাদ্য কম খায় ফলে মুরগির স্বাভাবিক বৃদ্ধি হ্রাস পায়। আবার তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে পোলট্রির নিউ ক্যাসেল নামক একটি ভাইরাসজনিত রোগের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।

পরিবেশের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বাড়া-কমার সাথে পোলট্রির গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। যখন প্রকৃতির তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় মুরগির তখন স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে উচ্চশক্তির দরকার হয়। পোলট্রির ক্ষেত্রে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ এজন্য যে, এসব মুরগির দেহের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ তাপমাত্রার একটা সীমা-পরিসীমা (মুরগির জন্য স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৭৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট) থাকে। তাপমাত্রা পরিবর্তনের সাথে সাথে এদের দৈহিক ও আচরণগত পরিবর্তন লক্ষণীয়। তাপমাত্রার পরিবর্তন মুরগির বিভিন্ন রোগের চারিত্রিক ও বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তনকে প্রভাবিত করে এবং রোগ ছড়ানোর ব্যবস্থাকে সহজে ত্বরান্বিত করতে পারে। আবার অতি বৃষ্টি এবং আপেক্ষিক পরজীবী প্রজননের জন্য সহায়ক ক্ষেত্র তৈরি কওে, যার ফলে রোগের বিস্তার সহজ হয় এবং মুরগির ডিম উৎপাদনের পরিমাণ কমিয়ে দেয়।

জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক পোলট্রি শিল্প
নাইজেরিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমের ওনডো প্রদেশ যেটি মূলত নাইজেরিয়ার মধ্যে উষ্ণ প্রদেশ হিসেবে পরিচিত। গ্রীষ্মম-লীয় অঞ্চলটিতে মূলত এপ্রিল মাস থেকে নভেম্বরের শেষ সময় পর্যন্ত প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এবং বাকি সময়টা শুষ্ক থাকে। পোলট্রি শিল্পের ওপর জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রভাব খেয়াল করার জন্য দেশটিতে ২০১০ সনে মোট ৮৩টি পোলট্রি ফার্মের ওপর এক গবেষণা জরিপ চালানো হয়। উক্ত জরিপে দেখা যায়, বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় শুষ্ক মৌসুমে সেখানে ডিম ও মুরগির উৎপাদন হার কমে যায় আবার খাদ্য তৈরির প্রয়োজনীয় কাঁচামালের দাম বেড়ে যায়। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৯৪ শতাংশই জানিয়েছেন যে, অধিক তাপমাত্রায় মুরগির মাংস ও ডিম উৎপাদন কমে যায়। ৭৮.৪% উত্তরদাতা বলেছেন, উচ্চ তাপমাত্রায় মুরগি বেশি পরিমাণে পানি পান করে কিন্তু খাবার কম খায়। উত্তরদাতাদের মধ্যে ৯০.৪% স্বীকার করেছেন যে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে রোগের বিস্তার ঘটাতে সহায়ক হয় এবং ৯৫.২% মনে করেন অধিক বৃষ্টিকালীন আবহাওয়ায় রোগের বিস্তার সবচেয়ে বেশি সহায়ক হয়। যার ফলে মুরগির মৃত্যুহার বেড়ে যায়। উক্ত গবেষণায় আরো দেখা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পোলট্রির নতুন নতুন রোগ সৃষ্টি করে এবং সেগুলো ছড়াতে সহায়তা করছে।

ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর এগ্রিকালচারাল রিসার্চ (ICAR) -এর ২০১০ সনের এক গবেষণা জরিপে দেখা যায়, যদি পরিবেশের তাপমাত্রা ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে হয় তখন ব্রয়লার মুরগির হিটস্ট্রোকজনিত মৃত্যুর হার স্বাভাবিকের চেয়ে ৮.৪% বেড়ে যায়; ৩১.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় মুরগির দৈনিক খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ যেখানে ১০৮.৩ গ্রাম, সেখানে ৩৭.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ কমে গিয়ে দাঁড়ায় ৬৮.৯ গ্রাম এবং এ তাপমাপত্রায় স্বাভাবিকের চেয়ে লেয়ার মুরগীর ডিম পাড়ার পরিমাণ কমে যায় ৬.৪ শতাংশ।

জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশ
আবহাওয়া অধিদপ্তরের গত ৩৫ বছরের (১৯৮১-২০১৬) দৈনিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৯৮১-১৯৯২ পর্যন্ত প্রাক-বর্ষা মৌসুমে (মার্চ, এপ্রিল, মে) স্বাভাবিকের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। পরবর্তী ২০ বছর (১৯৯২-২০১২) স্বাভাবিকের চেয়ে ২০ শতাংশ কম এবং পরবর্তী ৪ বছর বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ওঠানামা করেছে।

ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ড এক গবেষণায় জানা গেছে, শুধু ঢাকা শহরেই মে মাসের গড় তাপমাত্রা ১৯৯৫ সনের পর ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। অন্য এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের আর্দ্রতার মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০৩০ সন নাগাদ বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১০-১৫ ভাগ এবং ২০৭৫ সন নাগাদ তা প্রায় ২৭ ভাগ বেড়ে যাবে। ফলে বাতাসে আর্দ্রতার মাত্রা বেড়ে যাবে চরম হারে। এই আর্দ্রতা অসহনীয় গরম বাড়িয়ে দিবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) -এর প্রথমবারের মতো চালানো জরিপে জানা গেছে, ২০০৯-২০১৪ সন পর্যন্ত ছয় বছরে দেশের পরিবারগুলোর আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৮ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা। বিজলি, ‘আইলা’সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মূলত কৃষি খাতে এ ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে প্রাণিসম্পদ খাতে ৮৭৭ কোটি, পোলট্রি শিল্পে ২২২ কোটি, মৎস্য খাতে এক হাজার ১০০ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর ভাষ্য অনুযায়ী, এটিই জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব বিষয়ে দেশে প্রথম কোনো সরকারি জরিপ। তবে এ ব্যাপারে বিবিএসের দায়িত্বশীল সূত্র থেকে জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দুর্যোগের মাত্রা, গতি-প্রকৃতি, হার ও সময়ের পরিবর্তন এসেছে সেই সাথে পড়েছে জনজীবনে গভীর প্রভাব। তবে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে পুরোপুরি তথ্য সরকারের কাছে নেই। একেকজন বিশেষজ্ঞ একেক রকম তথ্য উপস্থাপন করছেন। তাই এ জরিপের মাধ্যমে একটি বেজলাইন করা হচ্ছে। এর ভিত্তিতে পরে আরও অনেক কাজ করা সম্ভব হবে।

তবে বিবিএস’র ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণে আলোচনা-সমালোচনা যাই-ই থাকুক এখানে আশাপ্রদ একটি দিক হলো সরকার প্রাথমিক কাজটি শুরু করতে পেরেছে। পরবর্তীতে ভুল ত্রুটি শুধরে নেয়া কঠিন হবেনা। পোলট্রি শিল্পে যে ২২২ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে সেটি টাকার পরিমাণের চেয়ে মনস্তাত্ত্বিক উন্নয়ন ও সে অনুযায়ী খামারি তথা শিল্পোদ্যাক্তাদের সতর্ক এবং আগাম প্রস্তুতি নিতে সহায়ক হবে।

আমাদের যা করণীয়
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবেলা এবং পোলট্রি শিল্পের ধারাবাহিক উৎপাদন অব্যাহত রাখতে এই শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্ব রয়েছে। শুধু সরকার এবং সরকারি সংস্থার ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়ার সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে খামারিদেরও যথেষ্ট সচেতন হতে হবে।

পোলট্রি উৎপাদন ব্যবস্থাপনার বেশিরভাগ সার (ময়লা/ পোলট্রি লিটার) কঠিন আকারে তত্ত্বাবধান করা হয়। পোল্ট্রি শিল্পে মিথেন গ্যাসের প্রধান উৎস হচ্ছে পোলট্রি লিটার বা মুরগির পায়খানা। প্রাণিজ আবর্জনা থেকে উৎপন্ন মিথেনের একটি চরিত্র হলো তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে এটি নির্গমনের মাত্রাও বৃদ্ধি পায়। পোলট্রি লিটার ও অন্যান্য আবর্জনা যত বেশি জমে থাকবে তত বেশি মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বৃহৎ আকারের পোলট্রি ফার্ম ও হ্যাচারিগুলোতে আবর্জনা ব্যবস্থাপনার সুব্যবস্থা থাকলেও ছোট ও মাঝারি আকারের ফার্মগুলোতে এ সমস্যাটা রয়েই গেছে। এ ব্যাপারে তাদেরকে সচেতন করে তুলতে হবে। পরিবেশ ও জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রভাব সম্পর্কে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। সরকারি উদ্যোগে খামারিদেরকে পরিবর্তিত জলবায়ু এবং এই পরিস্থিতিতে খামার ব্যবস্থাপনার ওপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। এছাড়াও পোলট্রি শিল্প সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব ও মোকাবেলা সম্পর্কে খামারিদের সচেতন করে তোলার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, শক্তির ব্যবহার এবং অপচয় যত কম হবে পরিবেশে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ তত কম হবে। এজন্য কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য খামার ব্যবস্থাপনার প্রযুক্তিগত আধুনিকায়নের বিকল্প নেই। খামারের দেয়ালগুলোতে সিমেন্টের আস্তরণ থাকতে হবে এবং ছাদ এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে যতটা সম্ভব কম তাপ শোষণ করে। খামারে পর্যাপ্ত এগজস্ট ফ্যানের ব্যবস্থা রাখা উচিত যাতে করে ভেতরের তাপমাত্রা সব সময় নিয়ন্ত্রণে থাকে। শক্তি খরচ সাশ্রয়ী মডেলের জেনারেটর ব্যবহার করা উচিত। নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে খামারি ও শিল্পোদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করে তুলতে হবে এবং প্রয়োজনে স্বল্প সুদে ঋণের বন্দোবস্ত করা যেতে পারে। এর ফলে একদিকে যেমন জ্বালানি খরচ সাশ্রয় হবে, জৈব সার উৎপাদন করা যাবে; অন্যদিকে পরিবেশ দুষনের হাত থেকে রক্ষা পাবে।

খামারিদের সঠিক ও ভালো ব্রিড নির্বাচন করতে হবে। কারণ ভালো মানের ব্রিডের মুরগির বৃদ্ধির হার যেমন বেশি হয় তেমনি খাদ্য ও শক্তি খরচও কম হয়। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারগণ প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন কীভাবে পোলট্রি জাত আরো বেশি উন্নত করা যায়। বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট এ ব্যাপারে আরো বেশি উদ্যোগী হতে পারে। এদেশে উচ্চ তাপমাত্রা সহনশীল ধানের জাত আবিষ্কৃত হচ্ছে। তাই উচ্চতাপমাত্রা সহনশীল মুরগির জাত উদ্ভাবনের উদ্যোগ নেয়া যেতেই পারে।

শেষ কথা
ধরুন একজন মানুষ সিগারেট খায়। সিগারেট খেলেই কি সাথে সাথে মানুষটি মারা যায়? কিংবা সাথে সাথেই ফুসফুসে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়? কিন্তু সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে লেখা থাকে, ধূমপান মৃত্যুর কারণ কিংবা ধূমপান ফুসফুসের ক্যান্সারের জন্য দায়ী। এখন এই সাথে সাথে লক্ষণ প্রকাশ পায়না বলেই কী উল্লেখিত কথাগুলো মিথ্যা হয়ে যাবে? মোটেই না… কারণ কিছু কিছু বিষয় আছে যেগুলোর প্রভাব সরাসরি এবং সাথে সাথে অনুভব করা যায়না। প্রভাবগুলো অনেকটা নীরবে, আড়ালে আবডালে কাজ করে সিঁধেল চোরের মতো কাজ করে। কিন্তু যখন প্রকাশ পায় তখন হয়তো আর সময় থাকেনা। জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত পোলট্রি শিল্পে ক্ষতিগুলো হচ্ছে অনেকটা নীরবে। এই নীরব ক্ষতির বিষয়টি আমরা যত তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবো দেশ ও শিল্পের জন্য তত তাড়াতাড়ি মঙ্গলজনক হবে।

তথ্যসূত্র :

1.FFECTS OF CLIMATE CHANGE ON POULTRY PRODUCTION IN ONDO STATE, NIGERIA

2. wattagnet.com

3. Journal of Agricultural Science; Vol. 5, No. 10; 2013; Published by : Canadian Center of Science and Education

4. Poultry production and the environment – a review, By : P. Gerber, C. Opio and H. Steinfeld, Animal Production and Health Division, Food and Agriculture Organization of the United Nations, Viale delle Terme di Caracalla, 00153 Rome, Italy

5. বাংলাদেশ পরিসংখ্যা ব্যুরো।

6. বাংলাদেশ পোলট্রি শিল্প সমন্বয় কমিটি।

This post has already been read 6150 times!