Thursday 25th of April 2024
Home / অন্যান্য / খুলনাঞ্চলের এক সময়ের জীবন্ত নদীগুলো এখন মরা খাল

খুলনাঞ্চলের এক সময়ের জীবন্ত নদীগুলো এখন মরা খাল

Published at এপ্রিল ১১, ২০১৮

 ফকির শহিদুল ইসলাম(খুলনা): খুলনাঞ্চলের এক সময়ের জীবন্ত নদীগুলো মরা খাল হযে এখন কাঁদছে। নদীর জলধারা ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হওয়ার ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় এ অঞ্চলে খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিচ্ছে। নদী মাতৃক এ দেশের বৃহত্তর খুলনাঞ্চল মূলত উপকুলীয় অঞ্চল দ্বারা বেষ্টিত। নদী বেষ্টিত এ অঞ্চলের কৃষি, মৎস্য এবং পশু যেন প্রকৃতিক সম্পদের লীলা ভূমি। অনাবদ্য প্রাকৃতিক এ সম্পদ নদীগুলো মৃত্যুর যন্ত্রণায় কাঁদলেও বন্ধু প্রতিম দেশ ভারত আজও পানির ন্যায্য হিস্যা দেয়নি বাংলাদেশকে। সুন্দরবন অঞ্চল দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী বাদে অন্য নদীগুলোর ৮০ শতাংশই এখন কার্যত অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়েছে। ফলে কৃষি ও মৎস্যের পাশাপাশি হুমকির মুখে পড়ছে পশুসম্পদ সহ প্রাকৃতিক পরিবেশ।

একদিকে মানব সৃষ্টি কৃত্রিম সঙ্কট আর অন্যদিকে ফারাক্কার প্রভাবে নদ-নদীগুলো ক্রমেই তার অতীত যৌবন হারাচ্ছে। নদী শাসনের নামে চলছে সংশিষ্টদের অপশাসন। দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার পরিবর্তে বাস্তবায়িত হচ্ছে আইওয়াশ প্রকল্প। দু-একটি মেগা প্রকল্পের বরাদ্ধকৃত অর্থ নিয়ে চলছে সংশিষ্ট এলাকার প্রভাবশালীদের লুটপাট। ফলে বৃহত্তর খুলনাঞ্চলের অর্ধশত নদ-নদী ও খাল এখন অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। যত্রতত্র বাঁধ, ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করে নদী শাসন ও অপ্রয়োজনীয় স্থানে তড়িঘড়ি করে প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণে এ অঞ্চলের নদ-নদীর গভীরতা বিপন্নের দিকে ধাবিত হচ্ছে । আর লবনাক্ততা উপকুলের সবুজ বেষ্টনীকে কুরে কুরে খাচ্ছে। স্রোত নেই বললেই চলে এসব নদ-নদীতে।

খুলনা অঞ্চলের ছোট-বড় মোট ১৮৯টি নদীর জিওমরফিফোলজি, ইকোলজি এবং মাছ উৎপাদনের অবস্থা সম্পর্কে এক গবেষণায় দেখা গেছে, শতভাগ নদীরই গভীরতা কমে গেছে। ১৮০টি নদীর মাছের প্রজাতি কমে গেছে, ১৬৮টি নদীর মাছ চলাচলের রাস্তা ধ্বংস হয়েছে, ৪২টি নদী মরে গেছে, ১৭৭টি নদীতে নদী ভাঙ্গনের তীব্রতা রয়েছে। ১৭০টি নদী ভরাট হয়ে গেছে, বিভাগের ১৮৯টি অর্থাৎ শতভাগ নদীতেই লবনাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৮২টি নদীর স্রোত কমে গেছে। ১৮২টি নদীর মাছ কমে গেছে ও ৩৪টি নদীর মুখ ভরাট হয়ে গেছে। সরকার নদী, খাল ও প্রাকৃতিক জলাধারা রক্ষায় জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন গঠন করেছেন । আমাদের দেশের নদীর নাব্যতা ও ভুমিদস্যু কর্তৃক নদী খাল মুক্ত করতে এ কমিশন ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহন করেছ । সম্প্রতি ৭৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা বরাদ্দে ভদ্রা নদী ও সালতা নদী খনন প্রকল্পটি ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরে খনন কাজ শুরু হয়ে ২০১৯ সালের জুন মাসের মধ্যে শেষ করার কথা থাকলেও নানা জটিলতায় খনন শুরুর ইতিমধ্যে এক বছর পার হয়ে গেছে।

সংশিষ্ট সূত্রে জানা যায়, এককালের প্রমত্তা ভদ্রা নদী ভরাট হয়ে প্রভাবশালীদের দখলে চলে গেছে। ওই নদীর অবশিষ্ট কোন অংশ নেই যা দখলে নেই। ভদ্রা নদীর একাংশ সাগরের সাথে মিশেছে, অপর অংশটি ডুমুরিয়ার শোলগাতিয়ার বুড়ি ভদ্রা য় গিয়ে মিশেছে। এছাড়া ডুমুরিয়া বাজারের কাছে ভদ্রা নদীর সংযোগ থেকে শৈলমারি নদীতে মিশেছে সালতা নদীটি। নব্বই দশকের পর থেকে ভদ্রা নদীটি ভরাট হতে থাকে। ভদ্রা নদীর প্রায় ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত ভরাট হয়ে গেছে। নদী ভরাটের সাথে সাথে দখলদাররাও গ্রাস করে নেয়। ভদ্রার বুকে যে যার মত স্থাপনা গড়ে তুলেছে। নদীর বুকে সমতল ভূমিতে গড়ে উঠেছে রাইস মিল, স-মিল, বাজার, বহুতল ভবনসহ নানা অবৈধ স্থাপনা। এছাড়া ভরাট নদীর বুকে সরকার আশ্রায়ণ প্রকল্পও গড়ে তুলেছে। পানি নিষ্কাশনের পথ আটকিয়ে যত্রতত্রভাবে বেড়ি বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করছে দখলদাররা। যে কারণে ভারি বর্ষা নামলে এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে দীর্ঘ দিন ধরে। এই পরিস্থিতির মোকাবেলায় নদী খননের উদ্যোগ নেয় সরকার। একনেকে প্রকল্প বাস্তবায়নে ৭৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়। যা বাস্তবায়ন করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। কিন্তু এ নদী খনন নিয়ে একাধিকভাবে বাঁধা পড়ে দখলদারদের পক্ষ থেকে।

সূত্রমতে, জলবায়ু পরিবর্তন এবং ভারতের বৈষম্যপূর্ণ পানি নীতির কারণে উপকূলের কৃষি, মৎস, এবং পশুসম্পাদ আজ চরম প্রশ্নবিদ্ধ। আর নদীর সাথে সম্পৃক্ত কলকারখানা ও জলজ জীবের পরিবেশ সম্পূর্ণ বিপন্ন ও বিপর্যস্থ। শুধু সেমিনার এবং টকশোতেই সমস্যা আর সমাধানের পারদ ওঠানামা করছে। যে কারণে ধীরে ধীরে বৃহত্তর খুলনাঞ্চলের নদীর জলধারা ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হচ্ছে। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে এই মিষ্টিপানির প্রবাহ চরম ভাবে বাধাগ্রস্থ হতে পারে। আবার ভূগর্ভস্থ পনির প্রাপ্যতায় সীমাহীন অনিশ্চয়তাও দেখা দিয়েছে ইতোমধ্যে। পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। গভীর নদ-নদী পলি পড়ে পড়ে চরা হয়ে যাচ্ছে। নদীতে এখন আর আগের মত স্রোত নেই।

এদিকে, এ অঞ্চলের নদীগুলোর মুখ ক্রমেই পলিতে বন্ধ হচ্ছে। কারণ হিসেবে তারা ব্যাখ্যা করেছেন, যদি কোন নদী কম স্রোত বিশিষ্ট বা স্রোতহীন সমুদ্রে পড়ে তাহলে ঐ সমস্ত তলানী নদীর মূখে জমতে জমতে নদীর মূখ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে নদীর মুখ সমুদ্রের পানির চেয়ে বেশি উচ্চতা হয়ে যায়। তখন বিপত্তি দেখা দেয়। বৃহত্তম খুলনার নদ-নদীগুলো গঙ্গানদীর তথা হিমালয়ের পার্বত্য জলপ্রবাহ পায় মাথাভাঙ্গা গড়াই ইছামতী ও মধুমতী বলেশ্বরের মাধ্যমে। কিন্তু এই নদী গুলোর পানি প্রবাহ প্রধানত ফারাক্কা বাঁধের কারণে আগের মত নেই। বরং শাখা ও উপ-নদীগুলোকে পানি সরবরাহে বদলে এরা নিজেরাই এখন অনেক স্থানের মত প্রায় মৃত ও স্রোতশূন্য অর্থৎ অস্তিত্ব সমস্যায় উপনীত। সুতরাং এগুলোর মাধ্যমে গঙ্গা নদীর মিষ্টি পানি খুলনা অঞ্চলের নদ-নদীগুলো আর তেমন পায় না। এই কারণে খুলনাঞ্চলের নদ-নদীগুলো এখন মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েছে দিনকে দিন। এক সময়ের জীবন্ত নদীগুলো মরা খাল হযে এখন কাঁদছে।

অপরদিকে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলর প্রধান প্রধান নদীগুলো পরিচয়ের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা থাকলেও ছোট-বড় মিলিয়ে উল্লেখযোগ্য যে নদীগুলো এখানে রয়েছে সেগুলো হলো- শিবসা, পেসা, বলেশ্বর, পগুর, আড়পাঙ্গাসিয়া, খোলপেটুয়া, আগুনমুখা, ভদ্রা, আঠারোবাকী, আলাইপুর, গাসিয়াখালী, দড়াটানা, ইছামমতী, খোলপটুয়া, রায়মঙ্গল, নমুদ সমুদ্র সোনাগাঙ্গ, ভাঙ্গরাকুঙ্গ, মালঞ্চ, সাতক্ষীরা, সুতেরখালী, মারজাতী, হারিণভাঙ্গা, মহাগঙ্গ, গলাঙ্গী, হরিপুর, সোনাই বুধহাটার গাঙ্গ, ঢাকি, গলাঘেমিয়া, উজীরপুর, কাটাখাল, গুচিয়াখালী, খাল আকরার, খাল মংলা, সোলপায়ারা আগুরমুখ মহুরী মোদলাম হাডুয়াভাঙ্গা পানগুছি, মেয়ার গাং, কাজিবাছা, কাকশিয়ালি, বলেশ্বর মরাভোলা।

সূত্র মতে উল্লেখিত নদীগুলোর মধ্যে একমাত্র সুন্দরবনের নদী বাদে অন্য নদীগুলোর ৮০ শতাংশই এখন কার্যত অস্তিত্বের সংকটে কাতর। এই নদীগুলোর মধ্যে ৮০ শতাংশই আগের মতস্রোতস্বিনী বিপুলদেহী উচ্ছল ও ক্ষিপ্রগামী নেই। অনেক জায়গা শুকিয়ে যাওয়ার ফলে ভূমিদস্যু কর্তৃক ভরাট করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ হচ্ছে। অনেকগুলো আবার দেখলে বুঝবার উপায় নেই যে, এক সময়ে এখানে কোনো তীব্র স্রোততবাহী নদী ছিল। আবার কোনো কোনোটা ধীরে ধীরে ময়লা আর্বজনার স্তপে পড়ে পরিণত হয়েছে সরু খালে। অনেকগুলোর গতিপথ পরিবর্তিত বা স্থায়ীভাবে রুদ্ধ হয়ে গেছে। তবে যেসব নদী এখনও জীবিত ও গতিশীল এবং বর্ষকালে প্রচন্ড বেগবান, সেগুলো সমুদ্র দক্ষিণে বলে তার অধিকাংশই উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত।

This post has already been read 2490 times!