নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (BPICC) ও ইউএস সয়াবিন এক্সপোর্ট কাউন্সিল (USSEC) যৌথভাবে আয়োজিত “রাইট টু প্রোটিন” বিষয়ক সেমিনার গতকাল (১৭ আগস্ট) রাজধানীর ঢাকা রিজেন্সি হোটেলে অনুষ্ঠিত হয়। দেশের খ্যাতিমান পুষ্টিবিদ, প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, ও সংশ্লিষ্ট শিল্প নেতারা এতে অংশ নেন। সেমিনারে শিশুরা, কিশোরী ও মা–মেয়েদের পুষ্টি নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রোটিন সচেতনতা ছড়ানোর ক্ষেত্রে শিক্ষক এবং মসজিদের ইমামদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তুলে ধরা হয়।
WPSA-BB–এর সভাপতি মশিউর রহমান উদ্বোধনী বক্তব্যে প্রোটিন বিষয়ে জনসচেতনা তৈরিতে মসজিদের ইমাম, স্কুল মাদ্রাসার শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মীদের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি বলেন, অন্যান্য যে কোন প্রোটিনের তুলনায় পোলট্রি থেকে উৎপাদিত প্রোটিন তুলনামূলক সাশ্রয়ী পোল্ট্রিকে নির্ভরযোগ্য প্রাণিজ আমিষ উৎস হিসেবে তুলে ধরে তিনি বলেন, আমাদের ফার্মিং ব্যবস্থাপনা আগের চেয়ে অনেক আধুনিক হয়েছে। এ সময় তিনি এ ধরনের আয়োজনে USSEC এর সহযোগিতার প্রশংসা করেন।
তিনি উল্লেখ করেন, “প্রোটিন শুধু খাদ্য নয়, এটি জাতীয় উন্নয়নের বিষয়। শিশুদের প্রোটিন গ্রহণ বাড়ানো ছাড়া সুস্থ ও উৎপাদনশীল ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সম্ভব নয়। তাই এসব বিষয়ে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।”
অনুষ্ঠানে USSEC–এর আঞ্চলিক কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স প্রধান মিস দীবা জিয়ানৌলিস (Ms. Deeba Giannoulis) রেকর্ডকৃত বক্তব্যে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র গুণগত মানসম্পন্ন সয়াবিন উৎপাদনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রয়েছে। তিনি ‘সয় সাসটেইনেবিলিটি অ্যাসিওরেন্স প্রটোকল’-কে গুণগত মানসম্পন্ন সয়াবিন উৎপাদন এবং জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সমন্বয়মূলক সমাধান হিসেবে উল্লেখ করেন।
এভারকেয়ার হাসপাতালের প্রধান পুষ্টিবিদ মিস তামান্না চৌধুরী বলেন, “আমাদের পরিবারগুলো এখনও ভাতের ওপর খুব নির্ভরশীল। একটি সুষম প্লেটে প্রতিদিন অন্তত একটি নির্ভরযোগ্য প্রোটিন উৎস থাকা অতি জরুরি—হোক তা ডিম, মাছ, মুরগি। শিশুদের শুরু থেকেই এটি শেখানো উচিত।”
তামান্না চৌধুরী বলেন, ডিম ও মুরগি সম্পর্কে আমাদের সমাজে এখনো অনেক ভ্রান্ত ধারনা রয়েছে। অনেকের ধারনা হার্টের রোগে ডিম খাওয়া যাবে না। কেউ কেউ মনে করেন ডিমের কোলেস্টরল আমাদের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু ডিমে যে পরিমাণ ও যে মানের কোলেস্টরল থাকে সেগুলো আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য বরং উপকারী।
এছাড়াও তিনি প্রোটিনকে অতিমাত্রায় হিরো বানাতে যেয়ে সেটিকে শরীরের জন্য ভিলেন বানিয়ে ফেলছে। প্রোটিনের পাশাপাশি আমাদের জন্য কার্বোহাইড্রেটের দরকার আছে। আমাদেরকে সর্বোপরি একটি ব্যালেন্স ডায়েট মেইনটেইন করতে হবে। আমরা যদি সঠিক মাত্রার প্রোটিন গ্রহণ করি সেটি অবশ্যই শরীরের জন্য ভালো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব নিউট্রিশন অ্যান্ড ফুড সায়েন্সেসের অধ্যাপক ডা. খালেদা ইসলাম ‘প্রোটিন প্যারাডক্স’ বিষয়টি তুলে ধরেন—বাংলাদেশে প্রোটিন উৎপাদনের পরিমাণ যথেষ্ট হলেও ভোক্তা গ্রহণের হারের কম। তিনি বলেন, “সয়াবিন ও পোল্ট্রি সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী। সামান্য খাবারের পরিকল্পনার মাধ্যমে বাড়তি খরচ ছাড়াই পরিবারগুলো প্রোটিন ঘাটতি মোকাবিলা করতে পারে।”
প্রভা হেলথ হাসপাতালের কর্ডিওলজিস্ট ডা. এ. জেড. এম. আহসান উল্লাহ বলেন, “প্রোটিনের ঘাটতি নিঃশব্দে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। খর্বাকৃতি, রক্তশূন্যতা ও দুর্বল রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা—এসব অপুষ্টির লক্ষণ। এখনই পদক্ষেপ না নিলে দীর্ঘমেয়াদি ভয়ানক প্রভাব পড়বে।”
BPICC–এর সভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদ সমাপনী বক্তৃতায় বলেন, “এটি শুধু BPICC বা USSEC-এর প্রচারণা নয়, এটি বাংলাদেশের জন্য একটি পুষ্টি আন্দোলন। আমরা চাই প্রতিটি পরিবার, স্কুল ও মসজিদ হোক পুষ্টি সচেতনতার কেন্দ্র। একসাথে কাজ করলে আমরা অপুষ্টি দূর করতে পারব ও গড়ে তুলব শক্তিশালী বাংলাদেশ।”
প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, ঢাকার সুপারিনটেনডেন্ট মো. কামরুজ্জামান এ প্রতিবেদককে বলেন, “শিক্ষকরা শিশুদের স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলায় সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন। একজন শিশু যদি স্কুলে প্রোটিনের গুরুত্ব শেখে, সে তা পরিবারেও পৌঁছে দিতে পারে—এভাবেই প্রকৃত পরিবর্তন শুরু হয়।”
সেমিনারের এক অংশে বক্তারা মসজিদের ইমামদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা তুলে ধরেন—খুতবায় সংক্ষিপ্ত স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বার্তা সংযোজনের মাধ্যমে ব্যাপক জনসম্মুখে প্রোটিন সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব।
সেমিনার শেষে খোলা আলোচনায় অংশ নেওয়া অতিথিরা একমত হন—শিক্ষক ও ইমামদের সম্পৃক্ত করে যদি প্রোটিন সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলে শিশু পুষ্টির ঘাটতি নিরসনে তা এক কার্যকর উদ্যোগ হবে।
সমগ্র অনুষ্ঠানটিতে সঞ্চালকের ভূমিকা পালন করেন ওয়াপসা-বিবি সাধারণ সম্পাদক ডা. বিপ্লক কুমার প্রামাণিক।