Friday 19th of April 2024
Home / মতামত / বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস : সম্ভাবনা ও প্রত্যাশা

বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস : সম্ভাবনা ও প্রত্যাশা

Published at এপ্রিল ২৪, ২০২০

ডাঃ মো মুস্তাফিজুর রহমান পাপ্পু : বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস, সারা বিশ্বের প্রানিসেবায় কর্মরত ভেটেরিনারিয়ানদের জন্য একটি বিশেষ দিন। প্রতি বছর এপ্রিল মাসের শেষ শনিবার সারা বিশ্বে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয় এ দিবসটি। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়; “Environmental protection for improving animal and human health.”

বিশ্বের প্রতিটি দেশে নানা আয়োজনে পালিত হয় বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস। সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, ফ্রি প্রানি সেবা ইত্যাদি অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয় এই দিন। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও আয়োজন হয় নানা কর্মসুচি।

বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস এর ইতিহাস

১৮৬৩ সালে এডিনবার্গ ভেটেরিনারি কলেজের প্রফেসর জন গ্যামেজ সারাবিশ্বের ভেটেরিনারিয়ানদের ইউরোপে একটি সভাতে আমন্ত্রণ জানান। পরবর্তীতে এই সভাটিই প্রথম আন্তর্জাতিক ভেটেরিনারি কংগ্রেস নামে পরিচিতি লাভ করে। মুলত ঐ সভার মুল উদ্দেশ্য ছিলো এপিজুটিক রোগ ও এর প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করা। এই কংগ্রেস টি বিশ্ব ভেটেরিনারি কংগ্রেস হিসেবে রুপ লাভ করে। ১৯০৬ সালে ৮ম বিশ্ব ভেটেরিনারি কংগ্রেস এ বিশ্ব ভেটেরিনারিয়ান নেতৃবৃন্দ একটি কমিটি গঠন করে যার মুল উদ্দেশ্য ছিলো নিজেদের মধ্যে সাংগঠনিক যোগাযোগ রক্ষা করা।

সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে আয়োজিত ১৫ তম বিশ্ব কংগ্রেস এ স্থায়ী কমিটির নেতৃবৃন্দ একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন গঠন  ও সংবিধান প্রনয়নের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। ১৯৫৯সালে   স্পেনের মাদ্রিদে অনুষ্ঠেয় কংগ্রেসে বিশ্ব ভেটেরিনারি এসোসিয়েশন গঠিত হয়। প্রানি স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা, এবং  পরিবেশ ও জন স্বাস্থ্য সুরক্ষা করাই ছিলো মুল উদ্দেশ্য। এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্ব ভেটেরিনারি এসোসিয়েশন বর্তমানে  ওয়ার্ল্ড অরগানাইজেশন ফর এনিমেল হেলথ ( ও আই ই ), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যা (ডব্লিও এইচ ও), ফুড এন্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন( এফ এ ও) এর সাথে এক হয়ে সারা বিশ্বে কাজ করছে ।

২০০১ সালে বিশ্ব ভেটেরিনারি এসোসিয়েশন, ভেটেরিনারি পেশার সাথে কর্মরত সকল ভেটেরিনারিয়ানদের জন্য একটি বিশেষ দিন আয়োজনের প্রস্তাব গ্রহন করে। যা প্রতি বছরের এপ্রিল মাসের শেষ শনিবার । মুল লক্ষ্য হলো ভেটেরিনারি পেশাকে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে পৌছে দেওয়া এবং প্রানি ও মানুষের উন্নয়নে কাজ করা, পরিবেশের উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা এবং প্রানি পরিবহন ও কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিতকরনে ভুমিকা রাখা। বিশ্বের সকল সদস্য দেশের বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস উৎযাপনের উপর ভিত্তি করে এওয়ার্ড ও দিয়ে থাকে বিশ্ব ভেটেরিনারি এসোসিয়েশন।

বাংলাদেশে বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস

দেশে প্রথম ২০০৮ সালে দি ভেট এক্সিকিঊটিভ আয়োজন করে এই দিবসটি। ততকালীন দি ভেট এক্সিকিঊটিভ সেক্রেটারি ও বর্তমান বাংলাদেশ ভেটেরিনারি এসোসিয়েশনের মহাসচিব ড. মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান মোল্লার প্রচেষ্টায় পালন শুরু হয় এ দেশে। বর্তমানে কেন্দ্রিয়ভাবে বাংলাদেশ ভেটেরিনারি এসোসিয়েশন (বিভিএ), দি ভেট এক্সিকিউটিভ, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ ভেটেরিনারি স্টুডেন্টস ফেডারেশন (বিভিএসএফ) দিনটিকে সাফল্যমণ্ডিত করতে নানা আয়োজন করে থাকে। কর্মসুচির মধ্যে বর্ন্যাঢ্য শোভাযাত্রা, সেমিনার, বিনামুল্যে প্রানি সেবা ক্যাম্পেইন, সাংস্কৃতিক অনূষ্ঠান আয়োজন করা হয়। এছাড়া দি ভেট এক্সিকিউটিভ এর পক্ষ থেকে প্রতি বছর ভেটেরিনারি পেশায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ দি ভেট এক্সিকিঊটিভ এওয়ার্ড ও দেওয়া হয়।

বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ ভেটেরিনারি এসোসিয়েশন (বিভিএ) জাতীয় পত্র পত্রিকায় বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে।

সারাদেশের ভেটেরিনারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিশ্ববিদ্যালয়,কলেজ) বিভিন্ন কর্মসুচি গ্রহন করে থাকে। দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বর্নিল সাজে সজ্জিত হয়ে র‍্যালী, শোভাযাত্রা , প্রতিপাদ্য বিষয়ের উপর সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, ভেটেরিনারি মেডিকেল টিম গঠন করে বিনামুল্যে প্রানির চিকিৎসা ও পরামর্শ প্রদান, টিকাদান কর্মসুচি ইত্যাদি আয়োজন করে থাকে।

দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলায় বিভিন্ন আঞ্চলিক ভেট ডক্টরস এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ লাইভস্টক সোসাইটি, সহ ভেটেরিনারি পেশার সাথে নানা সংগঠন এ দিবস উদযাপনে নানা প্রস্তুতি গ্রহন করে থাকে।

সম্ভাবনা ও প্রত্যাশা

সারাবিশ্বের শতকরা ৭০ ভাগ রোগ –জীবানুর উৎস প্রানি (সিডিসি, আটলান্টা)। বিশ্বের মহামারি সমুহের প্রধান কারন বন্য প্রানি। অতীতে বিভিন্ন ফ্লুতে লাখ লাখ মানুষ মৃত্যুর রেকর্ড আছে। সোয়াইন ফ্লু,ইবোলা, মার্স, সার্স, এবং বর্তমান কোভিড-১৯। এই সকল বড় বড় মহামারীর উৎস প্রানি। জন স্বাস্থ্যের দিক বিবেচনায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্য হিউম্যান মেডিকেল সায়েন্স ও ভেটেরিনারি মেডিকেল সায়েন্স কে একীভুত করে ওয়ান হেলথ ইস্যুতে কাজ করছে। সমগ্র বিশ্ব এখন ওয়ান হেলথ নিয়ে কর্মব্যস্ত রয়েছে। মানুষের সুস্থ থাকার জন্য এখন প্রানীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা রাখাটা বেশী জরুরী। পৃথিবীর প্রাণীকুলের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত না থাকলে মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত থাকবে না। যার প্রমান অতীত ও বর্তমানের মহামারি দেখলেই বোঝা যায়।  প্রানীর স্বাস্থ্য সেবা, খাদ্য, চিকিৎসা, লালন পালনে একমাত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য ভেটেরিনারিয়ানদের। একজন ভেটেরিনারি গ্রাজুয়েট ই পারে বিশ্বের প্রাণীকুলের সেবা দিতে।

বিশ্ব ভেটেরিনারি  দিবস ২০২০ এর  প্রতিপাদ্য বিষয় হলো- প্রাণী ও মানব স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য পরিবেশগত সুরক্ষা”  অর্থ্যাৎ পরিবেশের নিরাপত্তা প্রদানের মাধ্যমে প্রানি ও মানুষের স্বাস্থ্যকে সুরক্ষা প্রদান করতে হবে। পরিবেশ, প্রানি, মানুষ , একটার সাথে অন্যটা অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। প্রানি , পরিবেশ ছাড়া মানুষ বাচতে পারবে না। মানুষের অস্বিত্ব টিকিয়ে রাখার নিমিত্তেই পরিবেশ ও প্রানির সুরক্ষা কতটা জরুরী সারা বিশ্বের মানুষ আজ টের পাচ্ছে। নভেল করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ এর উৎস বাদুড় বা বনরুই। অনেকের মতে চীনের উহানের বন্য প্রানীর মার্কেট থেকে এই ভাইরাসের উৎপত্তি। বাদুড় বা বন্রুই যেটাই হোক না কেন, এটা যে কোন না কোন বন্য প্রানি থেকে এসেছে এই বিষয়ে দ্বিমত করার সুযোগ নাই। লাখ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে। বিশ্বের বড় বড় ক্ষমতাধর রাষ্ট্র আজ এই ভাইরাসের কাছে মাথা নত করছে। বিশ্বের বড় বড় বিজ্ঞানীদের চোখের ঘুম হারাম করেছে কোভিড-১৯। ভেটেরিনারিয়ান ও হিউম্যান মেডিক্যাল ডাক্তার রা এক হয়ে কাজ করছে এই সংকট মোকাবেলায়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত আমাদের দেশেও এখন এই সমন্নয় করাটা খুবই জরুরি।

ভেটেরিনারিয়ানরা অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন ভাইরাস ইবোলা, সোয়াইন ফ্লু, বার্ড ফ্লু, র‍্যাবিস , ফুট এন্ড মাউন্ড ডিজিস (এফ এম ডি) এর মত জুনেটিক ডিজিস ( যে রোগ প্রানি থেকে মানুষে ছড়ায়)  নিয়ে কাজ করছেন। সেক্ষেত্রে একজন এম বিবিএস গ্রাজুয়েট  এর চেয়েও অন্তত ভাইরাস নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা অনেক বেশী এই সব ভেটেরিনারি ডাক্তারদের। সে ক্ষেত্রে এখন সমন্নয়হীনতায় ভোগা যাবে না। সবার আগে মানুষের জীবন। বিভিন্ন ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক রয়েছেন।  যারা নিয়মিত ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করেন। দেশের এই সংকট মুহুর্তে সেই সব শিক্ষকদের জ্ঞান কে কাজে লাগানোটা জরুরী।

সর্বশেষে বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস ২০২০ সফল হোক,সার্থক হোক এই প্রত্যাশা করি। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেফাজত করুন। সুস্থ্য হয়ে উঠুক প্রিয় মাতৃভূমি, প্রিয় পৃথিবী।

লেখক: যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ভেটেরিনারি এসোসিয়েশন (বিভিএ), খুলনা বিভাগ।

সাবেক প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, ভেটেরিনারি স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন (ভিএসএ),পবিপ্রবি।

Email:dr.mustafij09@gamil.com ,01771 444402

This post has already been read 3318 times!