Friday 29th of March 2024
Home / মৎস্য / বিশ্বসেরা ব্ল্যাক টাইগার চিংড়ি : উৎপাদন, চাহিদা ও রপ্তানি বাড়াতে করণীয়

বিশ্বসেরা ব্ল্যাক টাইগার চিংড়ি : উৎপাদন, চাহিদা ও রপ্তানি বাড়াতে করণীয়

Published at জানুয়ারি ১৩, ২০২১

ড. ফা আনসারী : বাংলাদেশ বংশোদ্ভূত ঐতিহ্যবাহী ব্ল্যাক টাইগার  চিংড়ি (Penaeus monodon) বিশ্ববিখ্যাত। সুন্দরবনের চতুর্দিকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল হলো ব্ল্যাক টাইগার চিংড়ির চাষাবাদ ও ব্যবসার কেন্দ্রবিন্দু। বাংলাদেশের প্রায় ২ লাখ ১৬ হাজার ৪শ’ ৬৮ হেক্টর লোনাপানির অঞ্চল রয়েছে যেখানে চিংড়ি উৎপাদন হয় এবং প্রায় ০.৭ মিলিয়নের বেশি লোক এর সাথে সংশ্লিষ্ট রয়েছে। বিশ্ববাজারে ব্ল্যাক টাইগার চিংড়িটির বেশ সুনাম রয়েছে অপরদিকে ভেনামি (Litopenaeus vannamei) প্রবর্তনের পরে এবং বাংলাদেশী চিংড়ির যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাবের কারণে এর চাহিদা কিছুটা কম কিন্তু ব্ল্যাক টাইগার চিংড়ির বিশ্বব্যাপী niche / খুচরা বাজারে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তুলনামূলকভাবে ব্ল্যাক টাইগার চিংড়ি বাজারদরও ভালো। যদি সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ব্ল্যাক টাইগার চিংড়ি ভাবমূর্তি বিশ্বব্যাপী তৈরি করা  যায় তবে সর্বত্র এই ব্ল্যাক টাইগার চিংড়ির ব্যাপক চাহিদা তৈরি হবে।

বর্তমান অবস্থা

বাংলাদেশের খামারিরা সনাতন পদ্বতিতে চাষ করে উৎপাদন করে প্রায় ৩২০-৩৩০ কেজি/হেক্টর/বছর যা অন্যান্য চিংড়ি উৎপাদনকারী দেশের তুলনায় খুবই কম। উৎপাদন কমের কারণগুলোর মধ্যে আধুনিক প্রযুক্তির অভাব, মান সম্পন্ন চিংড়ি পোনা ও খাদ্যের অভাব এবং সর্বোপরি দুর্বল স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনা অন্যতম।

উৎপাদন রপ্তানি বাড়াতে করণীয়

  • সঠিক পুকুর ব্যবস্থাপনায় করণীয়।
  • অবকাঠামোগত উন্নয়ন – বিজ্ঞান সম্মত উপায়ে পুকুর তৈরি নিশ্চিত করতে হবে।
  • SPF পোনা মজুদ করা – Specific Pathogen Free (SPF) ব্ল্যাক টাইগার চিংড়ির PL নিশ্চিত করতে হবে।
  • প্রোবায়োটিক এর সঠিক ব্যবস্থাপনা – চাষকালীন সময়ে নিয়মিত প্রোবায়োটিক ব্যবহার করতে হবে।
  • পানির গুনগত মান নিরীক্ষণ – চাষকালীন সময়ে নিয়মিত পানির গুনগত মান নিরীক্ষণ করতে হবে।
  • Good Aquaculture practices (GAP) – ব্ল্যাক টাইগার চিংড়ি খামারে Vibrio spp., E. coli, Listeria spp., Salmonella ইত্যাদি ক্ষতিকর জীবাণু ও বিভিন্ন ভাইরাস এর উপস্থিতি দেখা যায়। Good Aquaculture practices (GAP) -এর মাধ্যমে চাষ পুকুরের জৈব নিরাপত্তা বিধান করার মাধ্যমে ব্ল্যাক টাইগার চিংড়িকে প্রসেসিং প্ল্যান্টের Quality RM হিসেবে সরবরাহ করার ক্ষেত্র প্রসারিত হবে।
  • পরিবহন (ফার্ম থেকে প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র) ব্যবস্থাপনায় করণীয়।
  • ফার্ম থেকে প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র প্রতিটি ধাপে Traceability নিশ্চিত করতে হবে।
  • প্রসেসিং ব্যবস্থাপনায় করণীয়।
  • Good Hygiene practices (GHP) নিশ্চিত করা- প্রসেসিং প্ল্যান্টের প্রতিটি পর্যায়ে/ধাপে এঐচ নিশ্চিত করতে হবে।
  • Good Manufacturing practices (GMP) নিশ্চিত করা- প্রসেসিং প্ল্যান্টের প্রতিটি পর্যায়ে/ধাপে GMP নিশ্চিত করতে হবে।
  • Quality Assurance নিশ্চিত করা।
  • Quality Control- HACCP rules প্রতিটি পর্যায়ে নিশ্চিত করতে হবে।
  • Quality Control & Certification – যথোপযুক্ত কতৃপক্ষের (DoF) মাধ্যমে Quality Control & Certification নিশ্চিত করতে হবে।
  • Food Safety নিশ্চিত করা- উৎপাদনকৃত চিংড়ি মানবদেহের জন্য নিরাপদ ও আমদানিকারক দেশের আইনসম্মত তা সুনিশ্চিত করতে হবে।
  • Export Licensing – উৎপাদনকৃত চিংড়ি আন্তজার্তিক মানসম্পন্ন কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে।
  • Traceability নিশ্চিত করা- চিংড়ি উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ এর প্রতিটি ক্ষেত্রে Traceability সুনিশ্চিত করতে হবে।
  • Product Testing Laboratory স্থাপন করা- মানসম্পন্ন উৎপাদনকৃত চিংড়ি ও প্রক্রিয়াজাতকৃত চিংড়ি এর সঠিক মান সুনিশ্চিত করার জন্য অচিরেই একটি স্বাধীন Product Testing Laboratory স্থাপন করতে হবে।

বিশ্বব্যাপী চাহিদা তৈরি করতে করণীয়

  • ব্র্যান্ডিং : ভেনামি (Litopenaeus vannamei) অত্যাধিক ঘনত্বে চাষ হয়ে থাকে বিধায় এর অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং চাষ পদ্ধতি ব্যয়সাপেক্ষ । বিদেশী প্রজাতি বিধায় বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুসংস্থান এর ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। উপরন্তু এই প্রজাতি নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগীতা করা বাংলাদেশের জন্য কঠিনতর। ইউরোপীয়ান ভোক্তাগণ সাধারণত খাদ্য সম্পর্কে অত্যাধিক সচেতন এবং অধিক ঘনত্বে নিবিরভাবে চাষকৃত ভেনামি নিয়ে তাদের কিছুটা সন্দেহ আছে। অপরপক্ষে ব্ল্যাক টাইগার চিংড়ি স্বাদ ও গুনাগুন নিয়ে তাদের আস্থা রয়েছে, এখন যদি পর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ব্ল্যাক টাইগার চিংড়ি এর ব্র্যান্ডিং সঠিকভাবে করা যায় তবে অচিরেই তা বিশ্বদরবারে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হবে।
  • সরকারি ভর্তুকি : এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য ব্ল্যাক টাইগার চিংড়ি এর উৎপাদন ও বাজার বৃদ্ধির একটি সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে, কিন্তু এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না গ্রহণ করলে তা অচিরেই হাতছাড়া হয়ে যাবে। বিশ্ববাজারে, ব্ল্যাক টাইগার চিংড়িগুলির দাম এখনও বাড়ছে এবং বিশ্বজুড়ে ব্ল্যাক টাইগার উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশই একমাত্র কিন্তু খামারের উৎপাদন ঘাটতির কারণে বাংলাদেশ এই সুযোগটি কাজে লাগাতে পারছে না।

বর্তমানে Govt. 10% subsidy দিচ্ছে কিন্তু Govt. subsidy -এর পরিমাণ যদি ২০%  উন্নীত করা হয় তবে খামারিরা ব্ল্যাক টাইগার চিংড়ি চাষে আরও বেশী উদ্ভুদ্ধ হবে। সাথে সাথে যদি এটা করা হয় তবে তা সত্যিকার অর্থে সময়যোগী হবে এবং এতে করে Local company গুলো ব্ল্যাক টাইগারকে International Market এ Aggressively promote করবে, ফলে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের ব্ল্যাক টাইগার চিংড়ির রপ্তানির পরিমাণ বহুগুণে বাড়বে এবং সাথে সাথে ব্ল্যাক টাইগার এর সুনাম বিশ্ববাজারে ছড়িয়ে পড়বে। সফলতা প্রাপ্তি সাপেক্ষে পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে এই ভর্তুকির পরিমাণ প্রতি বছরে ২% করে কমিয়ে ৫ বছর পরে এই ভর্তুকির পরিমাণ যদি ১০% (বর্তমানে ঘোষিত) এ নামিয়ে আনা হয় তবুও বাংলাদেশের ব্ল্যাক টাইগার চিংড়ি বিশ্ববাজারে স্বমহিমায় বিশেষ অবস্থান দখল করে থাকবে । এ ধরণের প্রনোদনার ফলে বিশ্ববাজারে  আমাদের শেয়ারের পরিমাণ ২.০ শতাংশ হতে বহুগুণ বেড়ে যাবে। সঠিক নীতি সমর্থন এবং ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই ফলন চারগুণ করা সম্ভব। সরকার নিমোক্ত ব্যবস্থাপনাগুলো গ্রহণ করলে অচিরেই এই সম্ভাবনাময় খাতটির উন্নয়ন করা সম্ভব।

  • ইপিজেড স্থাপন : গার্মেন্টস শিল্পের মত করে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে ব্ল্যাক টাইগার চিংড়ি এর EPZ গড়ে তুলতে হবে।
  • Demo Farm স্থাপন করা : Demo Farm স্থাপন করে কিভাবে সনাতন পদ্ধতির উন্নয়ন ঘটিয়ে চিংড়ি এর উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায় তা গবেষণা অচিরেই শুরু করতে হবে
  • চিংড়ি চাষিদের জন্য সহজ শর্তে ঋন প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে
  • Strong regulation BFFEAএর হস্তক্ষেপ : বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (BFFEA) হলো চিংড়ি খাতে দেখাশোনার একমাত্র বেসরকারী ও মাতৃ সংস্থা। বর্তমানে খাতগুলি অপর্যাপ্ত কাঁচামাল, পণ্যের গুণমান এবং প্রক্রিয়াকরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য দক্ষ জনশক্তি এবং সম্প্রতি করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে পর্যাপ্ত ক্রয়ের অর্ডার না পাওয়ার মতো অনেক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। তবে এখনও বিশ্বদরবারে এই সমিতিটি চিংড়ি রফতানির ক্ষেত্রে ভাল ভাবমূর্তি ধারণ করে আছে । সরকার ও BFFEA নিম্নোক্ত ব্যবস্থাপনাগুলো গ্রহণ করলে অচিরেই এই সম্ভাবনাময় খাতটির উন্নয়ন করা সম্ভব।
  • BFFEA Joint Venture Trail Project with Govt. – BFFEA এবং বাংলাদেশে সরকারের যৌথ উযোগে সনাতন পদ্ধতির উন্নয়ন বৃদ্ধিও লক্ষ্যে BFFEA Joint Venture Trail Project with Govt. শুরু করতে হবে।
  • বাংলাদেশে সরকারের যৌথ উযোগে চিংড়ি এর মানসম্পন্ন সরবরাহ PL করতে হবে।
  • চিংড়ি চাষে AQUA Medicine / Input -এর অযাচিত ব্যবহার রোধ করতে হবে।
  • প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত জনবল এর সংখ্যা বাড়াতে হবে।

পরিশেষে

ইউরোপের বাজারগুলোতে বাংলাদেশ থেকে চিংড়ির চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ছে। বাংলাদেশের ব্ল্যাক টাইগার এর স্বাদের জন্য ব্যাপক জনপ্রিয়। বাংলাদেশী চিংড়ি সম্পূর্ণভাবে প্রাকৃতিক উপায়ে উৎপাদিত বিধায় স্বাদে উত্তম এবং ইউরোপীয় বাজারে এর ভালো চাহিদা রয়েছে। তবে বর্তমানে বাংলাদেশে উৎপাদিত চিংড়ির প্রধান সমস্যা হলো কোয়ালিটি।  চিংড়ি যখন  পানিতে থাকে তখন যত না সমস্যা হয়, তারচেয়ে বেশি সমস্যা শুরু হয় harvest করার পর। সুতরাং আমাদের লক্ষ্য হলো harvest থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাতকরণ পর্যন্ত চিংড়ির গুণগতমানকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং বাংলাদেশ বংশোদ্ভূত ঐতিহ্যবাহী ব্ল্যাক টাইগার চিংড়ির ব্র্যান্ড ইমেজ তৈরির মাধ্যমে ভোক্তা প্লেটে এক নম্বর মানের পণ্য সুনিশ্চিত করা।

লেখক: ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা

এ সি আই মোটরস লিমিটেড

এ সি আই এগ্রোলিঙ্ক লিমিটেড

প্রিমিয়াফ্লেক্স প্ল্যাস্টিকস্ লিমিটেড

এ সি আই ম্যারিন অ্যান্ড রিভারাইন টেকনোজিস লিমিটেড

এ সি আই এগ্রিবিজনেস লিমিটেড

This post has already been read 3971 times!