Friday 19th of April 2024
Home / খাদ্য-পুষ্টি-স্বাস্থ্য / পান্তা ভাতের জল, তিন পুরুষের বল  

পান্তা ভাতের জল, তিন পুরুষের বল  

Published at জুলাই ১৯, ২০২০

সমীরণ বিশ্বাস : বাঙালি জাতীয় জীবনে অন্যতম উৎসব পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ। বাঙালি জীবনে নববর্ষ আসে নতুন উদ্দীপনা সঙ্গে নিয়ে। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে এই দিনটিতে সকলে বাংলা নববর্ষকে বরণ ক’রে নেয়। বৈশাখের উৎসবকে প্রাণ দিতে খাদ্যতালিকায় থাকে ব্যাপক প্রস্তুতি। জাতীয় জীবনের এই সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক উৎসবে নানা আয়োজনের মধ্যে পান্তা ভাত একটি আকর্ষণীয় অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। পান্তা ভাত যেন আমাদের সেই পুরানো দিনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যখন ফ্রিজে রেখে খাবার ঠান্ডা করার সুযোগ ছিল না। মূলত বাঙালির ঐতিহ্যকে ধারণ করে, এমন স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য স্থান পায় এই তালিকায়। তাই নববর্ষের খাদ্যতালিকার প্রধান জায়গা জুড়ে আছে পান্তা ভাত। সাধারণত কৃষক পরিবারে রাতের বেঁচে-যাওয়া ভাত পানিতে ভিজিয়ে রেখে ঠান্ডা রাখার একটি প্রচলন অনেক আগে থেকেই রয়েছে। সেই ভাত সকালে খাওয়া হয় নাস্তা হিসেবে। সঙ্গে থাকে কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ, ভর্তা বা আগের রাতে থেকে-যাওয়া তরকারি। আর পান্তা ভাতের সঙ্গে মাটির সানকি যেন মানিক জোড়।

প্রিয় পাঠক, জেনে আশ্চর্য হবেন যে, পান্তা শুধু বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথেই জড়িত নয়, বরং এর রয়েছে বহুমুখী উপকারিতা। আজ আমরা সে-সব উপকারিতা নিয়ে আলাপ করবো। গবেষণায় দেখা যায় যে, আগের দিন রান্না করা, রাতভর পানিতে ভিজিয়ে-রাখা ভাতের মধ্যে রয়েছে ভিটামিন বি-৬ এবং ভিটামিন বি-১২। এই ভাতের মধ্যে রয়েছে অনেক উপকারী ব্যাকটেরিয়া, যা খাদ্য হজম করতে সহায়তা করে এবং বহু রোগ প্রতিরোধ করে। এই ভাতে রয়েছে হাড় ও পেশি শক্তি বৃদ্ধির উপাদান এবং বার্ধক্য প্রতিরোধ ক্ষমতা। পটাশিয়াম ও আয়রন গরম ভাতের চেয়ে অনেক বেশি।

পান্তা ভাত গ্রামীণ বাঙালি জনগোষ্ঠীর একটি জনপ্রিয় খাবার। নৈশভোজের জন্য রান্না-করা ভাত বেঁচে গেলে সংরক্ষণের জন্য পানিতে ভিজিয়ে রাখা হতো। পরদিন এই পানিতে ভিজিয়ে-রাখা ভাতের নাম হতো পান্তা ভাত। পান্তা ভাত গ্রামীণ মানুষ সকালের নাশতা হিসেবে খেয়ে থাকে। সাধারণত লবণ, কাঁচা মরিচ ও পেঁয়াজ মিশিয়ে পান্তা ভাত খাওয়া হয়, অনেকেই আবার এর সাথে আলু ভর্তা, বেগুন ভর্তা, ডাল ভর্তা, শুঁটকি ভর্তা বা সরিষার তেল দিয়ে পান্তা ভাতের রুচি বৃদ্ধি ক’রে থাকে।

ইতিহাস ঐতিহ্যে পান্তা ভাত

ইতিহাস বলে, আজ থেকে প্রায় ৫,০০০ বছর আগে বাংলাদেশের এই অঞ্চলসহ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ভাত প্রধান খাদ্য হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করে। মোগল শাসনামলে সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা মুক্ত অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। আগত দর্শক-শ্রোতারা ঐতিহ্যবাহী পান্তাভাত খেতেন। বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে শহুরে বাঙালি ঘটা ক’রে বাংলা নববর্ষের উদ্যাপন শুরু করে। এই দিন বাঙালিয়ানার প্রতীক হিসেবে ভাজা ইলিশ মাছ সহযোগে পান্তা ভাত খাওয়া রেওয়াজে পরিণত হয়। একুশ শতাব্দীর প্রথম দশকে এসে প্রতি বছর পহেলা বৈশাখ নববর্ষের সকালে ইলিশ মাছ সহযোগে পান্তা ভাত খাওয়া বাঙালি সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। এরপর থেকেই পান্তা উৎসবের মাধ্যমে নতুন বছরকে বরণ-ক’রে-নেয়ার সংস্কৃতি চালু ও পরিব্যাপ্ত হয়েছে।

তৈরির প্রণালি

নির্দিষ্ট পরিমাণ ভাতকে পানিতে প্রায় এক রাত ডুবিয়ে রাখলেই তা পান্তায় পরিণত হয়। ভাত মূলত পুরোটাই শর্করা (Carbohydrate)। ভাতে পানি দিয়ে রাখলে বিভিন্ন গাজনকারী (Fermentation) ব্যাক্টেরিয়া বা ইস্ট শর্করা ভেঙে ইথানল ও ল্যাকটিক অ্যাসিড তৈরি করে। এই ইথানলই পান্তা ভাতের ভিন্ন রকম স্বাদের জন্য দায়ী। পান্তা ভাত মূলত ভাত সংরক্ষণের একটি পদ্ধতি।

ভাত বেশিক্ষণ রেখে দিলে তা পচে খাবার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। কিন্তু পানি দিয়ে রাখলে গাজনকারী ব্যাক্টেরিয়া সেখানে ল্যাকটিক অ্যাসিড তৈরি করে, যার ফলে পান্তা ভাতের অম্লত্ব বেড়ে যায় (pH কমে)। তখন পচনকারী ও অন্যান্য ক্ষতিকারক ব্যাক্টেরিয়া, ছত্রাক ভাত নষ্ট করতে পারে না।

১২-২৪ ঘণ্টা পরে পান্তা ভাত তৈরি হয়। যে কোনো প্রকার সংক্রমণ এড়াতে খাবারের পাত্রটি সতর্কতার সঙ্গে ঢেকে রাখতে হবে। সকাল বেলা লবণ, লেবু, মরিচ এবং পেঁয়াজ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়া হয়। খাওয়ার সময় অনেক সময় পানি আলাদা করা হয়। অনেকে পান্তা ভাতের সঙ্গে ভোজ্য তেল ব্যবহার ক’রে থাকেন।

পান্তা ভাতের উপকারিতা

পান্তা ভাত তো আমরা সবাই চিনি। শুধু বাঙালিয়ানার একটি অংশ হিসেবে পহেলা বৈশাখে পান্তা খেয়ে থাকি। কিন্তু এর গুণাগুণ যদি আমরা জানতাম, তাহলে হয়ত প্রত্যেক দিনই পান্তা ভাত খেতাম। আজ এই লেখার মাধ্যমে পান্তার গুণাগুণ জানানোর চেষ্টা করবো। কথায় আছে, পান্তা ভাতের জল, তিন পুরুষের বল। হ্যাঁ সত্যি তাই, পান্তা ভাত শরীরের জন্য খুবই উপকারী। কারণ শরীর বলিষ্ঠ ও সুস্থ রাখতে পান্তা জাদুর মতো কাজ ক’রে থাকে। পান্তা ভাত দেহে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ ক’রে দেহকে পানিশূন্যতা থেকে রক্ষা করে। তীব্র গরমে সান স্ট্রোক বা হিট স্ট্রোক থেকে রক্ষা করে। পান্তা গ্যাস্ট্রিক রোগীর জন্যও উপকারী। তবে ডায়াবেটিস রোগীর জন্য ক্ষতিকর। এছাড়া বয়স্কদের জন্যও পান্তা মোটেই ভালো নয়।

পান্তা ভাতের ক্যালরি মূল্য নির্ভর করে, কী ধরনের চাল দিয়ে রান্না করা হয়েছে, তার ওপর। চাল ভেদে ১ কাপ ভাত থেকে ২০০-২৪২ ক্যালরি পাওয়া যায়। অনেকে পান্তা ভাতের সাথে ঘি খেয়ে থাকেন। ১ টেবিল চামচ ঘি থেকে পাওয়া যায় ১১২ ক্যালরি। দই পান্তা ও জিরা পান্তার ক্যালরি মূল্য আরো বেশি। কারণ এগুলো তৈরিতে ব্যবহৃত হয় টক দই ও তেল। একটু লবণ, শুকনা মরিচ পোড়া অথবা কাঁচা মরিচ এবং পেঁয়াজ সঙ্গে থাকলে একটু আচার খেয়ে মজা পান্তা ভাত। বাংলাদেশসহ পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতে এই খাবারের প্রচলন চলে আসছে প্রাচীন কাল থেকে, বিশেষ ক’রে স্বল্প আয়ের পরিবারে। এখনও কারো গরিবি হাল বোঝাতে বলা হয়, ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়।’ এখনো পান্তা বুড়ির গল্প গ্রাম অঞ্চলে মানুষের মুখে-মুখে।

পান্তা ভাতে যা থাকে

১০০ গ্রাম পান্তা ভাতে (১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখার পর) ৭৩.৯১ মিলিগ্রাম আয়রন থাকে, যেখানে সম-পরিমাণ গরম ভাতে থাকে মাত্র ৩.৪ মিলিগ্রাম। এছাড়া ১০০ গ্রাম পান্তা ভাতে পটাশিয়ামের পরিমাণ বেড়ে হয় ৮৩৯ মিলিগ্রাম এবং ক্যালশিয়ামের পরিমাণ বেড়ে হয় ৮৫০ মিলিগ্রাম, যেখানে সম-পরিমাণ গরম ভাতে ক্যালশিয়াম থাকে মাত্র ২১ মিলিগ্রাম। এছাড়া পান্তা ভাতে সোডিয়ামের পরিমাণ কমে হয় ৩০৩ মিলিগ্রাম, যেখানে সম-পরিমাণ গরম ভাতে সোডিয়াম থাকে ৪৭৫ মিলিগ্রাম।

জনৈক আমেরিকান পুষ্টিবিদ, যিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের খাদ্যাভাস নিয়ে গবেষণা করেছেন, তিনি মন্তব্য করেছেন যে, দক্ষিণ ভারতের মানুষ আগের দিন রান্না-করা ভাত রাতভর পানিতে ভিজিয়ে রেখে পরের দিন সকালে খায়, তা সর্বোত্তম। পুষ্টিবিদরা পান্তা ভাতের আরো অনেক গুণাগুণের বিবরণ দিয়েছেন; যেমন:

পান্তার যত গুন

  • পান্তা ভাত খেলে শরীর হালকা থাকে এবং কাজে বেশি শক্তি পাওয়া যায়।
  • মানবদেহের জন্য উপকারী বহু ব্যাকটেরিয়া পান্তা ভাতের মধ্যে বেড়ে যায়।
  • পেটের পীড়া ভালো হয় এবং শরীরে তাপের ভারসাম্য বজায় রাখে।
  • কোষ্ঠবদ্ধতা দূর হয় এবং শরীরে সজীবতা বিরাজ করে।
  • রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকে।
  • অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সবল হয় এবং মন-মেজাজ ভালো থাকে।
  • অ্যালার্জিজনিত সমস্যা প্রশমিত হয় এবং ত্বক ভালো থাকে।
  • সব রকম আলসার দূর হয়।
  • শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

পুষ্টিবিদদের মতে, এই পান্তা ভাত শরীরের জন্যে বেশ উপকারী। পানি বাড়িয়ে দেয় ভাতের পুষ্টিগুণ। রাতের অবশিষ্ট ভাত সকালে কৃষকের নাস্তার পিঁড়িতে হাজির হয় আশীর্বাদ হয়ে। দিনের প্রচ- রৌদ্র মোকাবিলা করার জন্যে প্রস্তুত ক’রে তোলে তাকে।

বাংলাদেশ অ্যাগ্রিকালচার রিসার্চ কাউন্সিল-এর পুষ্টি বিভাগের এক গবেষণাপত্রে দেখা যায়, সদ্য রান্না-করা ভাতের চেয়ে পান্তা ভাত বেশি পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ। এতে আরো বলা হয়, পান্তা ভাত সহজে হজম হয়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং এর ফলে বিভিন্ন রকমের স্বাস্থ্যগত সুবিধা পাওয়া যায়।

কাউন্সিলের পুষ্টি বিভাগের পরিচালক ড. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশের লোকজন সাধারণত ক্যালশিয়াম এবং আয়রনের ঘাটতির মধ্যে থাকেন। পান্তা ভাত সেই সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে।’ পান্তা ভাতের আরো গুণের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। বিশেষ ক’রে, বয়ঃসন্ধিকালে মেয়েদের যে আয়রনের অভাব হয়, নিয়মিত পান্তা ভাত খাওয়া সেই অভাব পূরণে সহায়তা করতে পারে।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটির চিকিৎসক কাউসার আলম বলেন, ‘পান্তা ভাতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-বি এবং সি রয়েছে।’ তবে এর পাশর্^ প্রতিক্রিয়া হিসেবে ঝিমুনি ভাব-এর কথা উল্লেখ ক’রে তিনি বলেন, ‘পান্তা ভাতের পানিতে যে ব্যাক্টেরিয়া জন্ম নেয়, তা পেটে কোনো সমস্যা তৈরি করে কি-না, সে-বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে।’

এশিয়ান জার্নাল অব কেমিস্ট্রি-তে প্রকাশিত অপর এক গবেষণায় দেখা যায়, পান্তা ভাতে রয়েছে আয়রন, ফসফরাস, ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালশিয়াম এবং জিঙ্কসহ বিভিন্ন প্রকার খনিজ পদার্থ।

এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউট্রিশিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের গবেষণা জানাচ্ছে যে, ভাত পানিতে ভিজিয়ে রাখলে পাকস্থলীর প্যানক্রিয়াটিক অ্যামাইজেল-সহ আরো কিছু এনজাইমের কার্যকারিতা বহু গুণ বেড়ে যায়।

বহু যুগ ধরে দক্ষিণ ভারতের বহু মানুষের, বিশেষ ক’রে অপেক্ষাকৃত কম আয়ের পরিবারের প্রধান খাদ্য পানিতে ভেজানো ভাত। তবে সেখানেও তথাকথিত আধুনিকতার হাওয়া লেগেছে। এ ব্যবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। পানিতে ভেজানো ভাতের স্থান দখল করছে ফাস্ট ফুড বা জাঙ্ক ফুড।

পান্তা ভাত কতটা নিরাপদ?

পান্তা ভাতের উপকার বা ক্ষতি স¤পর্কে জানতে চাইলে হলিফ্যামিলি রেডক্রিসেন্ট হসপিটালের ডা. জিয়াউদ্দিন বলেন, পান্তা গ্যাস্ট্রিক রোগীর জন্য কিছুটা উপকারী হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষতিকারক। বিশেষ ক’রে ডায়াবেটিস রোগীর জন্য খুবই ক্ষতিকর। এছাড়া বয়স্কদের জন্যও পান্তা মোটেই ভালো নয়।

মজার কথা হচ্ছে, ভারতের প্রথম মিস্টার ইউনিভার্স (১৯৫২) ও শরীর চর্চাবিদ মনোহর আইচ ২০১২ সালে ‘ইন্ডিয়া টুডে’-কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, তিনি দিনে চার বার পান্তা ভাত খেতেন। তার মতে, ‘পান্তা ভাতের জল, তিন পুরুষের বল’। শত বছর পূর্তি উপলক্ষে এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছিল ‘ইন্ডিয়া টুডে’। এই দীর্ঘ জীবনের রহস্যের কথা বলতে গিয়ে শরীরচর্চায় এশিয়ান গেমসে তিন-তিনবার স্বর্ণপদক জয়ী মনোহর আইচ বলেন, ‘সকাল বেলা দুধ দিয়ে এক কাপ চিড়া খাই, এরপর এক কাপ কফি। দুপুরে ভাত-ডালের সঙ্গে সবজি অথবা মাছ। বিকেলে এক কাপ কফি। রাতের বেলায় যথারীতি আবারও ভাত। তবে মাঝে-মধ্যে এক গ্লাস ক’রে ফলের রস খান।’ মনোহর আইচ আদিতে বাংলাদেশেরই সন্তান। জন্ম ১৭ মার্চ ১৯১২ সালে কুমিল্লায়। লেখাপড়া করেছেন ঢাকার জুবিলি স্কুলে। উচ্চতা মাত্র ৪ ফুট ১১ ইঞ্চি। তবে কোনো সরঞ্জাম ছাড়াই তিনি প্রতিদিন প্রায় ১২ ঘণ্টা ব্যায়াম করেন। ধূমপান, পান খাওয়া পরিহার করেছেন। তিনি সব সময় ‘জাঙ্ক’ খাবার (ফাস্ট ফুড, ভাজা-পোড়া জাতীয় খাবার) এড়িয়ে চলতেন। অথচ ইন্ডিয়া টুডে-কে জোশের সঙ্গেই তিনি বলেন, ‘আগে আমি দিনে চার বার পান্তা ভাত খেতাম।’

পান্তা ভাতের গল্প

‘পান্তা ভাতে টাটকা বেগুন পোড়া’ Ñ গরম পড়লেই বাংলার মাঠে-ঘাটে-ঘরে এই গানটির গুনগুন প্রায়ই শোনা যায়। এক কথায়, গরমের ঠান্ডা হওয়ার আদি প্রথা। রাতের গরম ভাতে জল ঢেলে মাটির হাঁড়িতে রাখা হয়। বাংলাদেশে জলকে বলা হয় পানি। পানিতে ভাত ভেজানো হয় বলে হয়ত এর নাম ‘পান্তা ভাত’ হয়েছে। একে আবার ভাত সংরক্ষণের প্রাচীন পন্থাও বলা যেতে পারে। গ্রাম-বাংলার খেটে-খাওয়া মানুষদের কাছে এই ভাত গরমে যেমন তাদের শরীর ঠান্ডা রাখে, পাশাপাশি শক্তিও যোগায়। দিনের প্রধান খাবার হিসেবে তারা পান্তা খেয়ে থাকে। পান্তা ভাতের সঙ্গে থাকে কাঁচা লঙ্কা বা শুকনো লঙ্কা পোড়া, কাঁচা পেঁয়াজ, সরষের তেল ও নুন। আর সঙ্গে থাকে ডালের বড়া অথবা মাছ ভাজা বা তরকারি। এই পান্তা ভাতের জল থেকে তৈরি করা হয় আমানি। এই আমানি এক ধরনের দেশী ঠান্ডা পানীয়। তবে এটি বেশি গেঁজিয়ে এক ধরনের সুরাও তৈরি করা হয়। গ্রামে-গঞ্জে এর প্রচলন দেখা যায়।

গ্রীষ্মের রাতে টিমটিম-করা লণ্ঠনের আলোয় মাটির দাওয়ায় বসে মাঝখানে মাটির হাঁড়িতে পান্তা ভাত গ্রীষ্মকালে গ্রাম-বাংলার একটি পরিচিত দৃশ্য। কিছুটা এলিয়ে-পড়া পান্তা ভাত ও আমানি বাংলার একটি নিজস্ব খাবারও বলা যেতে পারে। তবে নিছক রসনা তৃপ্তিই নয়; বাঙালির প্রিয় এই পান্তা ভাতের সঙ্গে কী থাকবে, তা নিয়ে অঞ্চলভেদে পার্থক্য দেখা যায়। মাটির হাঁড়িতে-রাখা পান্তা ভাত পরিবেশন করার সময় জল ছেঁকে নেয়া হয়। দরিদ্র মানুষের কাছে এর সঙ্গের উপাদানে বাহারি আইটেম সাধারণত দেখা যায় না। কাঁচা লঙ্কা অথবা শুকনো লঙ্কা পোড়া, কাঁচা পেঁয়াজ, নুন আর সরষের তেল। কখনো শাক ভাজা অথবা তেঁতুল। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূমের মানুষ এর সঙ্গে খেতে ভালোবাসেন মাছের টক, পোস্ত বাটা অথবা বড়া। কুড়তি কলাইবাটা, কলাই গুঁড়ো, শাক ভাজা, গন্ধরাজ লেবু এবং ডালের বড়া দিয়ে পান্তা ভাত  খেতে খুব উপাদেয় লাগে। পূর্ববঙ্গে পান্তা ভাতের সঙ্গে শুঁটকি মাছের ভর্তা খাওয়ার প্রচলন আছে।

পান্তা ভাত সাধারণত খেটে-খাওয়া মানুষের খাবার বলে পরিচিত হলেও হিন্দু শাস্ত্রে ভগবানের ভোগ হিসেবে এর উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। চ-ীমঙ্গলে পান্তা ভাতের উল্লেখ আছে। পান্তা ভাতের আরেক নাম কাঞ্জী। বৈষ্ণবরা রাধা-কৃষ্ণকে পান্তা ভোগ দেন জ্যৈষ্ঠ মাসে। এর নাম পাকাল ভোগ। এতে থাকে পান্তা ভাত, দই, চিনি, কলমি শাক ভাজা এবং দুই-এক রকমের নিরামিষ তরকারি। মা দুর্গাকেও দশমিতে পান্তা ভোগ দেয়া হয়। কথিত আছে যে, গ্রামের মেয়ে উমা অনেক দূর পেরিয়ে শ^শুর বাড়ি যাবেন। তাই সহজ পাচ্য ও শরীর ঠান্ডা করার জন্য এই ভোগ দেয়া হয়। শ^শুর বাড়িতে গিয়ে যাতে

ছেলেপুলেরা শ্মশানবাসী বাপের কাছে ঐতিহ্যপূর্ণ খাবারের গল্প না করতে পারে, তার জন্য দেয়া হয় পান্তা ভোগ। আবার অনেকের মতে, মেয়ে চলে যাচ্ছে। এই দুঃখে মা-বাবা আগের দিনের রান্না-করা খাবার খায়। অনেক বনেদি বাড়িতে এখনো এই রীতি মানা হয়। একই ভোগে থাকে পান্তা ভাত, ইলিশ মাছ, কচুর লতি, বাসি তেঁতুল অথবা আমসির চাটনি এবং মাছের মাথা দিয়ে অম্বল।

‘পান্তা ভাতে ঘি নষ্ট, বাপের বাড়ি ঝি নষ্ট’ কথাটির অর্থ কী?

এই প্রবাদের অর্থ হচ্ছে, বিয়ের পর মেয়েদের দীর্ঘদিন বাপের বাড়িতে থাকা ঠিক নয়। ঘি খেতে হয় গরম ভাত দিয়ে। কিন্তু পান্তা ভাতে ঘি দিলে ঘি নষ্ট হয়। তেমনি বিয়ের পর বেশি দিন বাপের বাড়িতে থাকলে সবাই খোঁটা দেয়। এজন্য বিয়ের পর মেয়েদের স্থান সর্বদা স্বামীর বাড়ি। বাপের বাড়ি গেলেও তা যেতে হবে স্বল্প দিনের জন্য।

লেখক: কো-অর্ডিনেটর, কৃষি ও বীজ কর্মসূচি, সিসিডিবি, ঢাকা।

This post has already been read 4737 times!