Tuesday 19th of March 2024
Home / খাদ্য-পুষ্টি-স্বাস্থ্য / থাইরয়েড সমস্যার ভেষজ চিকিৎসা

থাইরয়েড সমস্যার ভেষজ চিকিৎসা

Published at সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৭

আয়শা সিদ্দিকা : থাইরয়েড হলো আমাদের গলায় অবস্থিত ছোট্ট একটি গ্রন্থি। এই গ্রন্থি থাইরয়েড হরমোন তৈরির জন্য দায়ী। প্রথমে ব্রেনের হাইপোথালামাস থেকে TRH নামে একটি হরমোন তৈরি হয়। TRH তারপর পিটুইটারি নামের অন্য একটি গ্রন্থিকে উদ্দীপিত করলে পিটুইটারি গ্ল্যান্ড থেকে TSH নামে একটি হরমোন তৈরি হয়। এই হরমোন আবার থাইরয়েড গ্রন্থিকে উদ্দীপিত করলে, খাবার থেকে প্রাপ্ত আয়োডিন কে ব্যবহার করে থাইরয়েড হরমোন তৈরি হয়। থাইরয়েড হরমোন দুই প্রকার- T3(০.১%) এবং T4(৯৯.৯%), এই হরমোন দুটি আমাদের শরীরের অনেক গুরত্বপূর্ণ কার্যাবলী সম্পাদনে ভূমিকা রাখে। হাইপোথালামাস, পিটুইটারি ও থাইরয়েড গ্রন্থি এই তিনটার যে কোন একটাতে সমস্যা থাকলেই, শরীরে থাইরয়েড হরমোন এর পরিমাণে বেশ কম হয়ে যাবে। তাছাড়া আয়োডিন এর অভাব হলেও, থাইরয়েড হরমোনের পরিমাণ কমে যাবে। যদি শরীরে থাইরয়েড হরমোনের পরিমাণ কমে যায় তবে তাকে বলে “হাইপোথাইরয়েডিসম” আর যদি বেড়ে যায়, তাকে বলে “হাইপারথাইরয়েডিসম”।

হাইপারথাইরয়েডিসম এর লক্ষণসমূহ: 
১. অতিরিক্ত ঘাম হওয়া;
২. গরম সহ্য করতে না পারা;
৩. হাত পা হালকা কাপা;
৪. নার্ভাসনেস;
৫. মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া;
৬. হার্টবিট বেড়ে যাওয়া;
৭. হঠাৎ করে ওজন কমে যাওয়া;
৮. অনেক খেয়েও ওজন বাড়াতে না পারা;
৯. অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পরা;
১০. কাজে মনোযোগের অভাব;
১১. মহিলাদের অনিয়মিত ঋতুস্রাব;
১২. ঋতুস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া;
১৩. ঘুম কম হওয়া;
১৪. বড় বড় কোটর থেকে বের হয়ে আসা চোখ।

যদিও এই সমস্যাগুলো সেইরকমভাবে আপনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবেনা। কিন্তু কারো যদি চিকিৎসাবিহীন অবস্থায় অনেকদিন হাইপারথাইরয়েডিসম থাকে, তাহলে “থাইরয়েড স্ট্রম” হতে পারে। তবে এটি খুব কমন কোন ঘটনা নয় এবং সাধারণত বৃদ্ধ বয়সে হয়। “থাইরয়েড স্ট্রম” বলতে বুঝায় হঠাৎ করে অতিরিক্ত থাইরয়েড হরমোন তৈরি হতে যাওয়া। এর ফলে প্রচন্ড জ্বর, মাথা কাজ না করা, পেটে ব্যাথা, উচ্চরক্তচাপ, হার্ট বিট অত্যন্ত বেড়ে যাওয়া এবং হার্ট ফেইলিওর হয়। তাদক্ষনিক চিকিৎসা না করলে “থাইরয়েড স্ট্রম” জীবন ঘাতি হতে পারে। সাধারণত ইনফেকশন ও স্ট্রেস হাইপারথাইরয়েডিসমের রোগীর মধ্যে “থাইরয়েড স্ট্রম” তৈরি করে।

হাইপোথাইরয়েডিসম এর লক্ষণসমূহ:
১. দুর্বলতা;
২. স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া;
৩. ঠাণ্ডা সহ্য করতে না পারা;
৪. কোষ্ঠকাঠিন্য;
৫. বিবর্ন ও শুস্ক ত্বক;
৬. পেশি এবং জয়েন্ট গুলো তে জড়তা বা ব্যাথা অনুভব করা ;
৭. মহিলাদের বেশি পরিমানে অথবা বেশি সময় ধরে ঋতুস্রাব;
৮. ডিপ্রেশন;
৯. চিকন এবং ফাটা চুল অথবা ফাটা নখ;
১০. চলাফেরায় মন্থর গতি;
১১. হঠাৎ ওজন বেড়ে যাওয়া;
১২. খুব কম খেয়েও ওজন কমাতে না পারা;
১৩. চুল পরা;
১৪. বারন্ত ছেলেমেয়েদের ধীর উচ্চতা বৃদ্ধি এবং ধীর সেক্সুয়াল ডেভেলপমেন্ট।

হাইপারথাইরয়েডিসম এর মতই এই লক্ষণগুলো আপনাকে অতটা বিরক্ত করবেনা। কিন্তু অনেকদিন চিকিৎসাবিহীন থাকলে আপনার “মিক্সএডেমা কোমা (Myxedema coma)” হতে পারে। মিক্সএডেমা কোমা বলতে বুঝায় শরীরে থাইরয়েড হরমোনের পরিমাণ হঠাৎ অতিরিক্ত কমে যাওয়া, এর ফলে আপনার ব্রেইন ঠিকমতো কাজ করবে না। ইনফেকশন, অসুস্থতা, ঠাণ্ডা আবহাওয়া এবং কিছু ওষুধ এই কোমা তৈরি করতে শরীরকে উজ্জিবীত করে এবং সাধারণত বৃদ্ধ বয়সে হয়। হাইপারথাইরয়েডিসম ফলে হওয়া “থাইরয়েড স্ট্রোম” এর মতই এই “মিক্সএডেমা কোমা” ও অতটা কমন না কিন্তু জীবনঘাতি।

তাছাড়া হাইপারথাইরয়েডিসম এবং হাইপোরথাইরয়েডিসম দুটোর কারণেই কারণে থাইরয়েড গ্রন্থি আকারে অনেক বড় হয়ে যায়। একে বলা হয় গলগন্ড। গলগন্ড হলে শ্বাসে সমস্যা হয়, খাদ্য গ্রহণে সমস্যা হয়, ব্যথা এমনকি ক্যন্সার ও হতে পারে।

সুতরাং আপনার লক্ষণগুলো যদি “হাইপারথাইরয়েডিসম” অথবা “হাইপোথাইরয়েডিসম” সাথে মিলে যায়, একজন এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট এর সাথে দেখা করুন। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে আপনার রক্তে TSH, T3 এবংT4 এর পরিমাণ নির্ণয় করলেই বোঝা যাবে যে আপনার থাইরয়েড এর সমস্যা আছে কি না। যদিও থাইরয়েড এর সমস্যা যাতে না হয়, তা আগে থেকে প্রতিরোধের উপায় নেই (যদি না আয়োডিন এর অভাবে থাইরয়েড এর রোগ হয়ে থাকে), কিন্তু যদি রোগ হয়ে যায়, তাহলে দীর্ঘমেয়াদি হলেও তার চিকিৎসা আছে। সুতরাং ভয়ের কিছু নেই, শুধু প্রয়োজন সচেতনতার।

থাইরয়েডের ভারসাম্যহীন অবস্থা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে কিছু প্রাকৃতিক ভেষজ উপাদান। এই ভেষজগুলো কেউ চাইলে এমনিতেই খেতে পারে অথবা চা তৈরি করে অথবা ক্যাপসুল বা ঔষধ হিসেবে খেতে পারে।তাই থাইরয়েড গ্রন্থির থেকে সবচেয়ে বেশি উপকারিতা পাওয়ার জন্য সঠিক পরিমানে সেসব ভেষজ ঔষধ গ্রহণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। থাইরয়েড স্বাস্থ্যকে উন্নত করতে সবারই উচিত এসব ভেষজ উপাদান গুলো সম্পর্কে জেনে রাখা এবং যে উপাদানটি যার জন্য ভালো কাজ করে তা গ্রহণ করা।

আদা

অনন্য ঔষধিগুন সম্পন্ন আদা সাধারণত বমি বমি ভাব ও পেটের সমস্যার জন্য বেশ ভাল কাজ করে আবার এটি থাইরয়েডের জন্যও আদর্শ। এর কারণ হচ্ছে আদা তে রয়েছে উচ্চ মাত্রার জিংক, ম্যাগনেসিয়াম ও পটাসিয়াম যা থাইরয়েডের অবস্থা ভালো রাখতে প্রয়োজন। তবে উপকারিতা বেশি পেতে হলে অবশ্যই তাজা আদা গ্রহণ করতে হবে।

ভালো উপকার পেতে আদা কুচি খাওয়া যায় বা আদা দিয়ে চা তৈরি করা খাওয়া যায়। আদা দিয়ে তৈরি করা চা কুসুম গরম অবস্থায় অর্গানিক মধু মিশিয়ে খেলে খুবই উপকার পাওয়া যায়। গরম অবস্থায় মধু কখনো মেশানো যাবে না কারণ এতে মধুর কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়।

তিসিবীজ

এটিও সাধারণত হজমতন্ত্রের জন্য বেশ উপকারী কারণ হচ্ছে এটি উচ্চখাদ্য আঁশ সমৃদ্ধ। তিসিবীজ থাইরয়েডের জন্যও ঔষধের মত কাজ করে। যাদের ক্ষেত্রে থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে হরমোন নিঃসরণ কম হয় তাদের ক্ষেত্রে নিয়মিত ভাবে তিসিবীজ খেলে সেই নিঃসরণের পরিমান বৃদ্ধি পায়।খুব বেশি পরিমান না খেয়ে প্রতিদিন ১ টেবিল চামচ করে খেলে এর সম্পূর্ণ উপকারিতা পাওয়া সম্ভব হবে। তিসিবীজ গুড়ো করে যেকোনো পানীয়ের সাথে মিশিয়ে খেতে পারেন নয়তো যেকোনো খাবারের সাথে মিশিয়ে খেতে পারেন।

বিছুটি পাতা

এই পাতা অতিরিক্ত কার্যকরী ও কম কার্যকরী দুই ধরনের থাইরয়েডের সমস্যার ক্ষেত্রেই উপকারী। এটি থাইরয়েডের টনিক হিসেবে খেতে বলা হয় কারণ এতে থাকে প্রচুর পরিমাণ আয়োডিন যা খেলে এই পুষ্টি উপদানের অভাব পূরণে ঔষধের মত কাজ করে। এই পাতা দিয়ে চা তৈরি করে খাওয়া হচ্ছে সবচেয়ে সহজ ও উপকারী।

এগুলো ছাড়াও প্রোটিন জাতীয় খাবার যেমন বাদাম, ডাল, মাছ ও মুরগি খেতে পারেন। শস্য জাতীয় খাবার খেতে হবে আর চিনি, ক্যাফেইন সমৃদ্ধ খাবার ও টিনজাত খাবার বর্জন করুন। কম কার্যকর থাইরয়েডের সমস্যার জন্য প্রতিরোধক হিসেবে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কাজ করে। এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বিভিন্ন ধরনের সবজি, ফল ও ভেষজ উপাদানে পাওয়া যায়, যেমন- ব্রকলি, স্কোয়াস, জাম্বুরা, রসুন ইত্যাদি।

নারিকেল তেল
নারিকেল তেলে যে ফ্যাটি এসিড আছে তা থাইরয়েড এর কাজকে ত্বরান্বিত করে, এছাড়াও বিপাকে সহায়তা করে ও এনার্জি প্রদান করে। এটা শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে যা হাইপো থাইরয়েডিজম এর রোগীদের জন্য ভালো।
– রান্নার জন্য এক্সট্রা ভার্জিন অর্গানিক নারিকেল তেল ব্যবহার করুন।
– সকালের নাস্তার সময় দুধের সাথে ২ চামচ নারিকেল তেল মিশিয়ে খেতে পারেন।

আপেল সাইডার ভিনেগার
থাইরয়েড-এর সমস্যায় আপেল সিডার ভিনেগার অনেক কার্যকরী। এটা এসিড ও ক্ষারের ভারসাম্য রক্ষা করে, শরীর কে বিষ মুক্ত করে, ওজন কমতে সাহায্য করে এবং হরমোনের নিঃসরণে সহায়তা করে।
– ১ গ্লাস উষ্ণ পানিতে ২ চামচ অর্গানিক আপেল সাইডার ভিনেগার মিশান।
– এর সাথে কিছুটা মধু যোগ করুন।
– এই মিশ্রণটি প্রতিদিন খাওয়ার চেষ্টা করুন।

ভিটামিনএ’ সমৃদ্ধ খাবার
থাইরয়েড এর সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায় হল বেশি বেশি ভিটামিন এ সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া। এর জন্য প্রচুর গাজর, হলুদ ও গাঢ় সবুজ শাকসবজি ও ডিম খেতে হবে।

অন্যান্য টিপস:
· আপনার খাদ্য তালিকায় বাদাম, শিমের বীজ, পনির সহ প্রচুর ফল ও শাকসবজি রাখুন।
· প্রতিদিন কিছু সময় ব্যায়াম করুন বা আপনার শারীরিক কার্যক্রম বাড়িয়ে দিন।এর ফলে শরীরে এমনকি থাইরয়েড গ্রন্থিতে অক্সিজেন সরবরাহ বৃদ্ধি পায়
· আয়োডিন সমৃদ্ধ খাবার যেমন- পেঁয়াজ, ভুট্টা, আনারস, টমেটো, রসূন, বাঁধাকপি ও স্ট্রবেরি খান
· অনেক পানি পান করুন
· হাই ক্যালরি যুক্ত খাবার বর্জন করুন। ভাঁজা পোড়া খাবার কম খান
· বেশি করে খনিজ লবণ সমৃদ্ধ খাবার খান
· ভিটামিন ডি গ্রহণ করুন
· কার্বোহাইড্রেট কম গ্রহণ করুন
.যদি থাইরয়েড গ্রন্থিতে ব্যাথা হয় ও ফুলে যায় তাহলে দ্রুত ডাক্তার দেখান।

থাইরয়েডের সঠিক কার্যক্রমের উপর আমাদের দেহের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ও এর কার্যক্রমের উন্নতি নির্ভর করে। থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের বিভিন্ন ধরনের হরমোন নিঃসরণের উপর দেহের বিভিন্ন ধরনের কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন হওয়া নির্ভর করে। যদি থাইরয়েড গ্ল্যান্ড খুব বেশি হরমোন নিঃসৃত করে তাহলে বুঝতে তা প্রয়োজনের অতিরিক্ত কার্যকরী। আবার যখন প্রয়োজনের তুলনায় কম হরমোন নিঃসরণ করে তখন তা কম সক্রিয়। এই দুই অবস্থাকেই থাইরয়েডের কর্মহীনতা বলে। থাইরয়েড গ্রন্থির এই দুই অবস্থাতেই হরমোনের মাত্রা তীব্রভাবে পরিবর্তনের ফলে তা দেহের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে এবং তা সঠিকভাবে কাজ করতে পারেনা। উন্নত মানের জীবনযাপনের জন্য থাইরয়েডের সমস্যা দেখা দেয়ার সাথে সাথে তা ঠিক করা জরুরি।

লেখক : ডায়েট অ্যান্ড নিউট্রিশন কনসালট্যান্ট, জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হসপিটাল এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও কনসালট্যান্ট, ইজি ডায়েট বিডি লিমিটেড।

 

This post has already been read 21500 times!